স্টারলিংকের যাত্রা শুরু

দেশের আইএসপিগুলো কী প্রস্তুত

আবু সুফিয়ান
প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৯: ২২

বাংলাদেশের ইন্টারনেট খাতে গত এক দশকে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটেছে। শহর থেকে গ্রাম, পাহাড় থেকে দ্বীপ- প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে পৌঁছে গেছে স্থানীয় আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) অপারেটরদের সেবা। এই খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, তৈরি হয়েছে অগণিত উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থান।

তবে বিশ্বব্যাপী স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করায় নতুন এক আলোচনা শুরু হয়েছেÑ দেশীয় খাত কতটা প্রস্তুত এই বৈশ্বিক প্রতিযোগীর মুখোমুখি হতে?

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরুর দিকে কিছু নির্দিষ্ট ও সীমিত ক্ষেত্রে স্টারলিংকের ব্যবহারই বাস্তবসম্মত।

রেস অনলাইন লিমিটেড নামে একটি আইএসপির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল হোসেন আমার দেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশের স্থানীয় আইএসপিগুলো অবশ্যই বিপুল বিনিয়োগ করেছে। এ খাতে অসংখ্য ছোট উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে, যারা অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। তবে স্টারলিংকের মতো হাই-এন্ড প্রযুক্তি এবং ব্যয়বহুল সেবার কারণে আপাতত এর প্রভাব সীমিত থাকবে বলেই আমি মনে করি।’

তার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ‘গ্রামাঞ্চলে এখনো প্রতি পরিবারে ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য মাসিক বাজেট গড়ে মাত্র ১০০ টাকা। এর বিপরীতে স্টারলিংকের প্রাথমিক স্থাপনা খরচ ৭০-৮০ হাজার টাকা এবং মাসিক সাবস্ক্রিপশন ফি প্রায় ৫০ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ছয় হাজার টাকা)। এই হিসাবেই রোঝা যায়, দেশের গড় গ্রাহকের কাছে এটি কার্যত ধরাছোঁয়ার বাইরে।’

তবে বিশেষজ্ঞরা এখনই পুরো বিষয়টি একপাক্ষিকভাবে দেখছেন না। বরং তারা স্টারলিংকের সম্ভাবনাও দেখছেন একটি সহায়ক শক্তি হিসেবেÑ বিশেষ করে এমন এলাকায়, যেখানে স্থানীয় আইএসপির পক্ষে কাঠামোগত কারণে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব।

কামাল হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, পার্বত্যাঞ্চল, সুন্দরবন এবং বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোয় এখনো বিদ্যুৎ এবং ব্রডব্যান্ড কানেকটিভিটির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এসব অঞ্চলে ফাইবার অপটিক ক্যাবল টানা ব্যয়সাপেক্ষ, সময়সাপেক্ষ এবং অনেক সময় প্রকৃতিগত কারণেও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে স্টারলিংকের মতো স্যাটেলাইটভিত্তিক সংযোগ বাস্তবিক অর্থেই বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’

তবে এক্ষেত্রেও রয়েছে বাস্তবতার দেয়াল। স্টারলিংকের মডেল এখনো অনেক ব্যয়সাধ্য। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, একটি টার্মিনাল শেয়ার করে ৫-১০ জন ব্যবহারকারী যদি সেবা নিতে পারেন, তবে তা অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী হবে এবং রিমোট এলাকায় কার্যকর মডেল হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

প্রযুক্তিগত দিক থেকেও স্টারলিংকের সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, ‘বর্তমানে দেশে তৈরি কনটেন্ট যেমন ভিডিও স্ট্রিমিং, গেমিং, লাইভ ব্রডকাস্টÑ এসবের জন্য দরকার হয় উচ্চ ব্যান্ডউইথ ও স্থিতিশীল লেটেন্সি। কিন্তু স্যাটেলাইট সংযোগে লেটেন্সি ফ্লাকচুয়েট করে, যা এসব কনটেন্ট ব্যবহারে সমস্যা তৈরি করতে পারে। এ কারণেও স্থানীয় আইএসপির সেবা এখনো অধিক কার্যকর।’

বদলে যেতে পারে যোগাযোগের মানচিত্র

টেলিকম নীতিনির্ধারক বিশ্লেষক মোস্তফা মাহমুদ হুসেইনের মতে, স্টারলিংক চালু হলে দেশের দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগের চিত্র নাটকীয়ভাবে বদলে যেতে পারে।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটে স্টারলিংক ইন্টারনেটের ডেমো প্রদর্শন পরবর্তী প্রজন্মের সংযোগব্যবস্থার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি নির্দেশ করে। তবে বাংলাদেশের বাজারে সাফল্যের জন্য মূল্য নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে। কারণ এখানে স্থানীয় ব্রডব্যান্ড সেবাগুলো তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী। বাজারে জায়গা করে নিতে হলে স্টারলিংককে প্রতিযোগিতামূলক মূল্য দিতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের আবহাওয়াÑ ঘন মেঘ ও ভারী বৃষ্টিপাত, বিশেষ করে বর্ষাকালে উচ্চমানের পারফরম্যান্স ও নির্ভরযোগ্যতা দাবি করে। এটি স্টারলিংকের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।’

তবে সম্ভাবনার দিকটি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এ উদ্যোগ স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ডের সম্ভাবনাকে তুলে ধরে, যা বিশেষ করে দুর্গম অঞ্চলে ডিজিটাল বিভাজন কমাতে এবং দেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল রূপান্তরের প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করতে পারে।’

বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স পরিচালিত স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করেছে। গত বুধবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাত্রা শুরু হয় সেবাটির। বিনিয়োগ সম্মেলন উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আগামী ৯০ দিনের মধ্যে স্টারলিংক বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা শুরু করবে। এর ফলে নিরবচ্ছিন্নভাবে ইন্টারনেট সুবিধা পাবেন গ্রাহকরা।

এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা আশা করছি আগামী ৯০ দিনের মধ্যে স্টারলিংক বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে অপারেশন শুরু করতে পারবে। এজন্য প্রয়োজনীয় যে প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো আছে সেগুলো আমরা এখন চালিয়ে যাচ্ছি।’

গত ফেব্রুয়ারিতে স্টারলিংক নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ইলন মাস্কের ভিডিও আলোচনার পরপরই এ কার্যক্রম গতি পায়। সরকার সম্প্রতি নন-জিওস্টেশনারি অরবিট (এনজিএসও) নীতিমালা পাস করায় সেবাটির পথ উন্মুক্ত হয়।

বাংলাদেশে সেবা চালুর জন্য বিডা ও বিটিআরসির অনুমোদন পাওয়ার পাশাপাশি গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণ এবং ভূমি বরাদ্দের কাজ এগিয়ে চলেছে। যদিও এটি তুলনামূলক ব্যয়বহুল এবং মূলত প্রান্তিক ও দুর্গম অঞ্চলের জন্য উপযোগী। তবুও এটি দেশের ইন্টারনেট খাতে একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে।

সরকারের হস্তক্ষেপেও এ সেবা পুরোপুরি বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব, এটি স্টারলিংকের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার একটি বৈশিষ্ট্য।

সামগ্রিকভাবে বলা যায়, স্টারলিংক বাংলাদেশের ইন্টারনেট ইকোসিস্টেমে একটি সম্ভাবনাময় সংযোজন। এটি এখনই স্থানীয় আইএসপিগুলোর জন্য ভয়াবহ কোনো হুমকি না হলেও ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও নীতিমালার ওপর নির্ভর করে এটি হয়ে উঠতে পারে একটি শক্তিশালী সহায়ক প্ল্যাটফরম। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে এর সম্ভাবনা অনস্বীকার্য।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত