ঢাকা ওয়াসায় ফের সক্রিয় তাকসিম সিন্ডিকেট

এম এ নোমান
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪১

ঢাকা ওয়াসায় তাকসিম সিন্ডিকেট আবার সক্রিয়। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের পর টিকতে না পেরে ১৪ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ওয়াসার বিতর্কিত এমডি তাকসিম এ খান। রাজত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য এবার তার আশীর্বাদপুষ্ট কুখ্যাত ‘র‌্যামস’ গ্রুপ মাঠে নেমেছে। তারা তাকসিম সিন্ডিকেটের লোক হিসেবে পরিচিত দুর্নীতিবাজ প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সালাম ব্যাপারী ও সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমানকে এমডি পদে বসানোর জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে।

বিজ্ঞাপন

ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, এ সংস্থায় প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ হয়। এসব মূলত ‘র‌্যামস’ গ্রুপ নামে একটি নির্দিষ্ট সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ওই সিন্ডিকেটই এমডি নিয়োগের পুরো কার্যক্রম দেখভাল করে থাকে। সংস্থাটিতে এমনও কথা চলছে, মোস্তাফিজুর রহমানকে এ পদে বসানোর জন্য ৫০ কোটি টাকার তহবিল তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি একই পদে নিয়োগ পেতে মোস্তাফিজুর রহমানের চেয়েও বেশি টাকার তহবিল নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটির বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সালাম ব্যাপারীর পক্ষের গ্রুপ।

স্থানীয় সরকার বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, মোস্তাফিজুর রহমান এবং আবদুস সালাম ব্যাপারী ছিলেন তাসকিম সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য। তাসকিম এ খান যে কয়জন কর্মকর্তার ওপর ভর করে সংস্থাটিতে ফ্যাসিবাদী রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারা ছিলেন তাদের শীর্ষে। দুজনই ছিলেন ঢাকা ওয়াসার কুখ্যাত গ্রুপ র‍্যামসের আশীর্বাদপুষ্ট এবং আওয়ামী সমর্থিত প্রকৌশলী পরিষদের সদস্য। এ বিষয়ে আবদুস সালাম ব্যাপারীর নামে পাবনার সুজানগর থানা আওয়ামী লীগের প্রত্যয়নপত্রও রয়েছে।

কর্মকর্তারা জানান, মোস্তাফিজুর রহমানকে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার টার্গেট নিয়ে প্রথমে ২১ মার্চ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেখানে বয়সসীমা ৬০ বছর থাকলেও অভিজ্ঞ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে বয়সসীমা শিথিল ছিল। দুদিন পর এটি আবার সংশোধন করে আবেদনের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এটি করা হয় শুধু মোস্তাফিজুর রহমানের নিয়োগ চূড়ান্ত করার জন্য।

এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ঢাকা ওয়াসার সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান ও বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সালাম ব্যাপারী আবেদন করেছিলেন। কিন্তু প্রাথমিক যাচাইয়ে আবদুস সালাম ব্যাপারী তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তা না হওয়ায় আবেদনটি বাতিল হয়।

আবদুস সালাম ব্যাপারীর দুর্নীতির ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দায়ের হয়েছে। দুদক এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে। ইতোমধ্যে দুদকের একটি অনুসন্ধান দল ওয়াসা ভবনে গিয়ে সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে নথিপত্র সংগ্রহ করেছে।

আবদুস সালাম ব্যাপারীর নামে মেসার্স হুমায়রা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ঠিকাদার আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুস নিয়ে কাজ না দেওয়ার অভিযোগ এনে ঢাকা ওয়াসা কার্যালয়ে একটি অভিযোগ দেওয়া হয়। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে আবদুস সালাম ব্যাপারীর বিরুদ্ধে ঢাকা ওয়াসা প্রশাসন ২০২১ সালে একটি বিভাগীয় মামলা দায়ের করে। ওই বিভাগীয় মামলার কারণে আবদুস সালাম ব্যাপারী প্রায় চার বছর সাসপেন্ড ছিলেন।

গত বছরের ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর ঢাকা ওয়াসার সাবেক ভারপ্রাপ্ত এমডি ফজলুর রহমান ও ঢাকা ওয়াসার সচিব মো. মশিউর রহমানের সহযোগিতায় বাঁকা পথে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং তাকে গত জানুয়ারিতে ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে পদায়ন করা হয়। পাশাপাশি তাকে চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা থেকে তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, আবদুস সালাম ব্যাপারী তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তা হওয়ার পরও তিনি যাতে এমডি হতে পারেন, সেজন্য র‌্যামস গ্রুপ জোরেশোরে তদবির চালাচ্ছে। গত ২১ ও ২৩ মার্চের বিজ্ঞপ্তি বাতিল করে নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।

কর্মকর্তারা জানান, ঢাকার প্রায় দেড় কোটি মানুষের পানির ব্যবস্থা করে আসছে ওয়াসা। বিগত তাকসিম আমলে প্রকৌশলী রফিক, আখতার, মহসিন ও সবুজের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট ওয়াসা কার্যালয়ে র‌্যামস হিসেবে পরিচিতি পায়। বহুল বিতর্কিত পদ্মা পানি শোধনাগার প্রকল্পের পিডি ছিলেন রফিকুল ইসলাম। তার নিযুক্ত ফার্ম এখনো ওয়াসায় কাজ করছে।

ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের সাবেক পিডি প্রকৌশলী আখতারুজ্জামান, দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগারের সাবেক পিডি মোহসেন আলী মিয়া এবং একটানা ১০ বছরের অধিক সংগ্রহ বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন আনোয়ার সাত্তার সবুজ। তাদের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেটই এখন ওয়াসায় এমডি নিয়োগে বিশেষভাবে তৎপর বলে জানান সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

ব্যাপারীর মতোই আবদুস সালাম ব্যাপারী

পাবনার সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত একটি প্রত্যয়নপত্রে দেখা যায়, তিনি ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং জুলাই বিপ্লবের আগে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকা একজন নিবেদিত আওয়ামী সমর্থক। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অজস্র অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক পরিচয় ও উপর মহলের তদবিরের মাধ্যমে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের কাছ থেকে তার চাকরি রক্ষা করেন। শেখ হাসিনার এরকম একজন দোসর এবং দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী ঢাকা ওয়াসার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে দুর্নীতি করে ঢাকা ওয়াসার পুরো নাগরিক সেবা ব্যাহত করেছেন।

অভিযোগ রয়েছে, স্বৈরাচার সরকারের পতনের ফলে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান থাকায় আওয়ামী লীগের আরেক দুর্নীতিবাজ আমলা ও আবদুস সালাম বেপারীর বন্ধু স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সচিব মো. নিজাম উদ্দিনকে খুশি করার মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলীর পদে নিয়োগ পান।

ঢাকা ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ থাকায় আবদুস সালাম ব্যাপারীকে পদোন্নতি দিতে রাজি হননি। সচিব মো. নিজাম উদ্দিনকে দিয়ে বলপ্রয়োগ করেন আবদুস সালাম ব্যাপারী। ঢাকা ওয়াসার ইতোপূর্বের প্রধান প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান গত ৩০ ডিসেম্বর অবসরে যাওয়ায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান বাধ্য হয়ে ৯ দিন পর মো. আবদুস সালাম ব্যাপারীকে প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেন। পরে আওয়ামী সমর্থিত সচিব মো. নিজাম উদ্দিনকে বদলি বাণিজ্যের অভিযোগে ওএসডি করা হয়।

ঢাকা ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ মনিটরিং করার দায়িত্ব অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর হলেও প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন আবদুস সালাম ব্যাপারী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্পের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকে বাইরে রেখে তিনি এককভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন।

আবদুস সালাম ব্যাপারী ২০১২ সাল থেকে বিভিন্ন সময় শর্তসাপেক্ষে হুমায়রা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাজ দেওয়ার অজুহাতে ঘুস হিসেবে নগদ অর্থ গ্রহণ করেন। ১০ কেভিএ ডিজেল জেনারেটর সরবরাহের কাজ দেওয়ার জন্য ওই ঠিকাদারের কাছ থেকে তিনি ১৫ লাখ টাকা গ্রহণ করেন এবং ২০১০ সালে চতুর্থ সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েও একজন ঠিকাদার স্পেয়ার পার্টস সরবরাহের কার্যাদেশ পান।

সালাম ব্যাপারী একটি প্রকল্পে উপ-প্রকল্প পরিচালক থাকা অবস্থায় বিভিন্ন এলাকায় পানির লাইন পুনর্বাসনকাজে এবং বিভিন্ন মালামাল সরবরাহের মতো প্রকল্পগুলোয় নিয়মতান্ত্রিকভাবে ঠিকাদার যথারীতি উত্তীর্ণ দরদাতা হওয়া সত্ত্বেও তার চাহিদা পূরণ না করায় কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে অকৃতকার্য দেখানো হয়।

ঢাকা ওয়াসার মডস্ জোন-২-এর আওতাধীন আজিমপুর এলাকায় পিডব্লিউডির কলোনিতে পানির লাইন স্থাপনের জন্য ডিপোজিট ওয়ার্ক হিসেবে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃক কাজটি করার জন্য পিডব্লিউডি কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করে। অভিযোগ উঠেছে, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করে এবং সিপিটিইউর ওয়েবসাইটে প্রচার না করে অত্যন্ত গোপনে সালাম ব্যাপারী তার পছন্দের কয়েকজন ঠিকাদারকে ঘুসের বিনিময়ে প্রায় এক কোটি ২৭ লাখ টাকার কাজ ভাগবাঁটোয়ারা করে দেন। দরপত্র আহ্বান না করে মেসার্স দীপ্ত এন্টারপ্রাইজ, আলিফ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, শ্যামলী এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স মীর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাঝে কাজগুলো ভাগবাঁটোয়ারা করার কারণে সাধারণ ঠিকাদারদের মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

অভিযোগ রয়েছে, বিগত দিনে তিনি বিভিন্ন সময় পারিবারিক প্রয়োজনের কথা বলে হুমায়রা এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে দুই কোটি টাকার বেশি ধার করেন। তার বাড়ি গিয়ে পাওনা টাকা চাইলে প্রতিষ্ঠানটিকে ঢাকা ওয়াসায় ব্ল্যাক লিস্ট করার হুমকি দেন।

অভিযোগ আছে, বর্তমানে মো. আবদুস সালাম ব্যাপারী উৎকোচের বিনিময়ে ঢাকা ওয়াসার জন্য তার পছন্দের সরবরাহকারীদের কাছ থেকে পন্য কেনার জন্য বিভিন্ন দপ্তরের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের সে অনুযায়ী স্পেসিফিকেশন ও দরপত্র তৈরি করতে বাধ্য করছেন।

এতে এখন ভারত নির্মিত নিম্ন মানের ইলেকট্রিক্যাল এবং মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতি সংগ্রহের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হলেও তাকে আর কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। আবার তিনি যদি লবিং করে ঢাকা ওয়াসার পরবর্তী ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান, তবে তো তার করা সব কুকীর্তিই ঢেকে দেওবার ব্যবস্থা তিনি করবেন। কেউ আর প্রশ্ন করার সাহস পাবে না।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ পেতে আবদুস সালাম ব্যাপারী আবেদন করেছেন।

১৫ বছরের তাকসিম রাজত্ব

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার ঢাকা ওয়াসার এমডির দায়িত্ব দেয় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক তাকসিম এ খানকে। টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি ঢাকা ওয়াসায় ‘তাকসিম বলয়’ নামে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেন। তার দুর্বিনীত দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার ছিল সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে-কলমে। ১৫ বছরে ঢাকা ওয়াসায় একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তাকসিম এ খান।

দায়িত্ব নেওয়ার পর দফায় দফায় তার মেয়াদ বাড়তে থাকে। পদত্যাগের আগ মুহূর্তেও সপ্তমবারের মতো ওই পদে আরো তিন বছরের জন্য তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০৯ সালের পর থেকে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়ে ১৬ বার।

ওয়াসার আইন অনুযায়ী ঢাকা ওয়াসা পরিচালিত হওয়ার কথা বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। তবে অনেক ক্ষেত্রেই বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে ঢাকা ওয়াসাকে পরিচালনা করেছেন তাকসিম। এ নিয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের ঘটনাও ঘটে। এতে তাকসিমের কিছুই হয়নি। বরং তার অনিয়ম, অপচয় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেওয়ায় সরে যেতে হয় সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফাকে।

তাকসিম এ খানের আমলে ঢাকা ওয়াসায় বৈদেশিক ঋণের টাকায় বেশ কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এজন্য ঢাকা ওয়াসাকে ঋণের সুদ ও আসলের কিস্তি পরিশোধে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন প্রকল্পে ঢাকা ওয়াসার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি এবং বাস্তবায়নের পর তা চালু করতে না পারার মতো কারণে সংস্থাটির ব্যয় বেড়েছে। ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে তাকসিমের মাসিক বেতন ছিল ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সর্বশেষ করোনা মহামারির মধ্যে একলাফে ওয়াসার এমডির বেতন বাড়ানো হয় পৌনে দুই লাখ টাকা।

তাকসিমের হাত ধরে ‘র‌্যামস’-এর ৫ হাজার কোটি টাকা লোপাট

ওয়াসার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাকসিম এ খানের ‘রাজত্বকালে’ পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি দুর্নীতি হয়েছে বলে অডিটে বের হয়েছে। এ দুর্নীতির সঙ্গে ‘র‌্যামস’ সরাসরি যুক্ত। পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্পের সঞ্চালনলাইন নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা, দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগার নির্মাণের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৬০০ কোটি টাকা, পানি ও পয়োবিলের তিন হাজার ২২১ কোটি টাকা, এবং ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৬২১ কোটি টাকা।

ওয়াসা সূত্র জানিয়েছে, ওয়াসার একটি প্রকল্পে বিদেশি ঋণের বিষয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও আইসিটি উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়ও যুক্ত ছিলেন। ওই ঋণের ফাইল সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ভেটিংয়ে আটকে দিলে সালমান এফ রহমান বিশেষ তদবির করে ছাড়িয়ে নেন। আনিসুল হক ও সালাম এফ রহমানের এ-সংক্রান্ত একটি অডিও কলরেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

ওয়াসার দুর্নীতির বিষয়ে সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা সাংবাদিকদের জানান, অতিষ্ঠ হয়ে ২০২৩ সালের ১৭ মে স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রকৌশলী তাকসিমের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে চিঠি লিখেছিলাম। মন্ত্রণালয় তার তদন্ত না করে উপরন্তু চারদিনের মাথায় আমাকে সরিয়ে দেয়। দুর্নীতির টাকার জোরে তিনি ধরাকে সরাজ্ঞান করেছেন। পাশাপাশি তাকে রাজনৈতিকভাবে সহায়তা করা হয়েছে।

ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ তাকসিম আমলে সংস্থাটির অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করেছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দাশেরকান্দি পয়োশোধনাগার প্রকল্প নির্মাণে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কমপক্ষে ৬০০ কোটি টাকার দুর্নীতি করা হয়। এছাড়া এ প্রকল্পের নেটওয়ার্ক না করে মূল প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় সেখান থেকে কোনো সুফল মিলছে না। এছাড়াও হাতিরঝিলের ময়লা পানি শোধনসংক্রান্ত প্রকল্পে ঢাকা ওয়াসার বছরে গচ্চা যাচ্ছে ৫১২ কোটি টাকা।

ঐক্য পরিষদের নেতাদের হিসাবমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে ঢাকা ওয়াসার তিন হাজার ২২১ কোটি টাকা খোয়া গেছে। পানির দাম ও গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিলিং পদ্ধতি ডিজিটাইজেশন হওয়ার পরও সংস্থাটির দায়িত্বপ্রাপ্তদের চুরি, অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় থেকে সংস্থাটি বঞ্চিত হচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে সংস্থাটির সিস্টেম লস ছিল ৩৪ দশমিক ৮২ শতাংশ আর তাকসিমের বিদায়ের সময় তা দাঁড়ায় ৫৪ দশমিক ৮২ শতাংশ।

কর্মচারী নেতারা জানিয়েছেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পানি ও পয়েবিলের টাকা থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি দুর্নীতি করেছে তাকসিম এ খানের র‌্যামস সিন্ডিকেট। বৈদেশিক সহায়তা নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত করেছে সংস্থাকে। আমরা সামনে আর কোনো দুর্নীতিবাজ এমডিকে চাই না।

অভিযোগের বিষয়ে প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান ও প্রকৌশলী আবদুস সালাম ব্যাপারীর বক্তব্য নিতে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে তাদের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হয়। রিসিভ না করায় ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও তারা জবাব দেননি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত