ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রুগ্নদশা-২

চরম নোংরা পরিবেশ, সংক্রমণের উচ্চঝুঁকি নিয়েই চিকিৎসা

আজাদুল আদনান
প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১০: ২৩
আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১০: ২৫

মাগুরায় চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগী শিশু আছিয়াকে গত ৬ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আনা হয়। অবস্থা সংকটাপন্ন হলে শিশুটিকে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) নেওয়া হয়।

তারপরও শিশুটির স্বজন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতারাও স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে আইসিইউতে প্রবেশ করেন। ফলে সংক্রমণের উচ্চঝুঁকি বেড়ে যায়। উপায় না পেয়ে শিশুটিকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হয়। যদিও আছিয়াকে আর বাঁচানো যায়নি।

বিজ্ঞাপন

সংক্রমণের এমন মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার রোগীর চিকিৎসা নেওয়া যেন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। প্রতিদিন দশ হাজারের বেশি মানুষ চিকিৎসা নেয় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এই হাসপাতালে। ২ হাজার ৬০০ শয্যার হাসপাতাল হলেও সব সময়ই ভর্তি থাকে দ্বিগুণ রোগী। এ ছাড়া জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগে রোগীদের উপচেপড়া ভিড়ে হিমশিম অবস্থা। প্রতিটি বিভাগেই একেকজন রোগীর সঙ্গে দুই থেকে তিনজন দর্শনার্থী। এমনকি এক শয্যায় দুজন রোগীকেও দেখা গেছে, যারা কোনো ধরনের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়াই রোগীর সঙ্গে থাকছেন; একসঙ্গে খাচ্ছেন।

দর্শনার্থীদের বাড়তি চাপের মধ্যেই সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। সমস্যা আরো বাড়িয়েছে হাসপাতালের অপরিচ্ছন্ন টয়লেট। অধিকাংশ আধুনিকায়ন হলেও রোগীদের সচেতনতার অভাব ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ঘাটতির ফলে প্রায় সময় বাইরে ময়লা, কাদাসহ দুর্গন্ধ লেগেই থাকছে। ফলে সংক্রামক জীবাণু ছড়িয়ে যাওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রোগীদের ওপরও। সুস্থ হতে দেরি হওয়ায় স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত সময় হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে তাদের।

চিকিৎসকরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে সব সময়ই ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী থাকে। বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেলের মতো প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু সংক্রমণ প্রতিরোধে জোরালো পদক্ষেপের বড় ঘাটতি রয়েছে। ঢাকা মেডিকেলে সংক্রমণ প্রতিরোধে কমিটি থাকলেও রোগীদের চাপে পেরে উঠছে না তারা। এমনকি হাসপাতালের ভেতরে রোগীদের সচেতনতায় পোস্টার লাগানো হয়েছে। তারপরও অবস্থার উন্নতি নেই।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগী আসে এ হাসপাতালে। সরকারিভাবে ডাক্তার দেখাতে পারলেও ওষুধ-খাবার কেনা এবং অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বাইরে যেতে হয়। এমনকি হাসপাতালেই পরীক্ষা হলেও এক ভবন থেকে আরেক ভবনের দূরত্ব বেশি হওয়ায় রোগীর সঙ্গে থাকা দর্শনার্থীই ভরসা। ফলে বাধ্য হয়ে রোগীদের সঙ্গে দর্শনার্থী থাকার ওপর বাধ্যবাধকতা তুলে নিতে হয়েছে।

সরেজমিনে হাসপাতালের অন্তঃবিভাগ ও বহির্বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব রোগীর সঙ্গে একাধিক স্বজন রয়েছেন। বিশেষ করে বহির্বিভাগে একজন রোগীর সঙ্গে চারজন দর্শনার্থীকেও দেখা গেছে চিকিৎসকের কক্ষে। এতে করে হাসপাতালে মারাত্মক সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

গত ১৩ এপ্রিল আলসারের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালের মেডিসিন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন মাদারীপুরের বাসিন্দা রেজওয়ানা বেগম (৪৭)। সঙ্গে স্বামী, মেয়ে ও দুই ছেলে। জানতে চাইলে মেঝ ছেলে শাহরিয়ার বলেন, ‘আলসারের পাশাপাশি মা উচ্চ রক্তচাপের রোগী। অন্যান্য জটিলতাও আছে। মূলত বাবা ও ভাই-বোনরা মিলে নিয়ে এসেছে। আমি ঢাকায় থাকায় দেখা করতে এসেছি। সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি জানলেও সেভাবে ভেবে দেখিনি।’

এমন দর্শনার্থীর চাপ দেখা গেছে অন্তঃবিভাগেও। মূত্রথলির ক্যানসারে ভুগছেন আবু তালেব (৬২)। হাসপাতালের ১১২ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এই রোগীর শয্যায় গিয়ে দেখা যায়, রোগীর বিছানায় বসা স্ত্রী ও ছেলে। কারো মুখেই নেই কোনো মাস্ক।

রোগীর বিছানায় বসলে সংক্রমণের ঝুঁকি আছে কি না জানতে চাইলে ছেলে আলামিন বলেন, ‘রোগীর সঙ্গে একজনকে তো সব সময় থাকতে হয়। বাইরে থেকে খাবার, ওষুধ ও অন্য ভবনে পরীক্ষা করতে যেতে হয়। আমার মায়ের পক্ষে এগুলো করা কঠিন, তাই আমি থাকি। সংক্রমণ হলেও আমরা কি করতে পারি?’

ওই ওয়ার্ডের দায়িত্বরত নার্স জানান, ‘রোগীদের বারবার বলা হলেও তারা মানতে চান না। এত রোগী কতজনকে বলা যায়। নিজেরা সচেতন না হলে আমরা তো মেরে বলতে পারি না।’

দুই শতাধিক মানুষের জন্য একটি টয়লেট

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় দুই ওয়ার্ডে থাকা রোগী ও স্বজন মিলে দুই শতাধিক মানুষের জন্য একটি টয়লেট। এসব টয়লেট অপরিচ্ছন্ন। টয়লেটের আশপাশে গেলেই দুর্গন্ধ বেরিয়ে আসছে। টয়লেটের ভেতর-বাইরের ময়লা ফেলতেও দেখা যায়। এতে করে কলেরা ও টাইফয়েডের মতো রোগজীবাণু ছড়িয়ে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে জানান চিকিৎসকরা।

ইউরোলজি ও শিশু বিভাগের ওয়ার্ডে দায়িত্বরত একাধিক নার্স আমার দেশকে বলেন, ‘অধিকাংশ রোগী গ্রাম থেকে আসা। তারা টয়লেট কীভাবে ব্যবহার করতে হয় জানেন না। এমনকি পর্যাপ্ত পানি ব্যবহার না করায় এমন নোংরা থাকে। আমরা বারবার বলি, তারপরও শুনতে চায় না। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সকালে-বিকালে একবার করে আসেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালের সংক্রমণ প্রতিরোধে একজন চিকিৎসককে সদস্যসচিব করে ১০ জন নার্সের একটি ইনফেকশন প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল (আইপিসি) কমিটি রয়েছে। যারা প্রতিনিয়ত সংক্রমণ নিয়ে প্রতিবেদন ও পর্যবেক্ষণ করেন।

এই কমিটির সদস্যসচিব ঢামেকের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাকলী হালদার আমার দেশকে বলেন, ‘সাধারণ ওয়ার্ডতো আছেই, এমনকি আইসিইউতে পর্যন্ত রোগীর স্বজনরা ভিড় করেন। এমনিতেই ধারণক্ষমতার চেয়ে রোগী বেশি, সেখানে আবার একেকজনের সঙ্গে দু-তিনজন থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। অথচ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে রোগীর সুস্থ হতে বেশি সময় লাগে।’

দর্শনার্থী প্রবেশে বাধ্যবাধকতা দিতে না পারার বাস্তবতা রয়েছে জানিয়ে কাকলী হালদার আরো বলেন, ‘আমাদের জোরালো কার্যক্রম থাকার পরও নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। রোগীদের সচেতনতায় সংক্রমণ প্রতিরোধমূলক পোস্টারও লাগানো হয়েছে। এজন্য দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে দরকার রোগীদের সচেতনতা।’

জানতে চাইলে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, ‘ভর্তি রোগীর ক্ষেত্রে একজন রোগীর জন্য একজন দর্শনার্থী বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। সমস্যা হলো, অনেকের সঙ্গে মহিলা স্বজন থাকে। যারা গ্রাম থেকে এসেছেন, কিছুই চেনেন না। সব ওষুধ ও পরীক্ষা এখানে না হওয়ায় তাকে বাইরে যেতে হচ্ছে। এজন্য তার পুরুষ স্বজনও প্রয়োজন হয়। আমরা একজন রোগীর জন্য সর্বোচ্চ দুজন থাকার নির্দেশনা দিয়েছি, তাও একই সময়ে নয়।’

তবে বহির্বিভাগে নিয়ন্ত্রণ একেবারে অসম্ভব জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জরুরি ও বহির্বিভাগে দুর্ঘটনার রোগী এলে অনেকের অবস্থা গুরুতর থাকে। মানবিক কারণে তাদের বের করে দিতে পারি না আমরা।’

ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক বলেন, প্রতিনিয়ত রোগীর চাপ বাড়ছে। কিন্তু আমাদের ড্রেনেজ ব্যবস্থাগুলো পুরোনো হওয়ায় জটিলতা বেড়েছে। ১২০ বছরের পুরোনো ভবনে নতুন করে ড্রেনেজ সিস্টেম বাড়ানো সম্ভব নয়। আবার অধিকাংশ মানুষ গ্রাম থেকে আসায় তাদের বারবার বলার পরও সেখানে ময়লা ফেলে। অনেকে ব্যবহার করতে জানে না। ছাদ থেকে পর্যন্ত ময়লা ফেলে। প্রতি ঘণ্টায় পরিষ্কার করলে হয়তো ভালো থাকত। কিন্তু তার জন্য যে পরিমাণ জনবল দরকার, আছে তার অর্ধেক। অথচ হাসপাতালে ১০০ ওয়ার্ড, ৪৭টি অপারেশন থিয়েটারের প্রত্যেকটিতে আমার লোক দিতে হয়। সেখানে সব মিলিয়ে আছে এক হাজারের মতো কর্মী। এর মধ্যে অর্ধেক পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা তিন শিফটে কাজ করে। লোকবল বাড়ানো গেলে অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। একই সঙ্গে রোগীদের সচেতন হওয়ার ওপর জোর দেন তিনি।

শুক্র-শনিবারও চলবে বিমানবন্দরের শুল্কায়ন কার্যক্রম

প্রধান উপদেষ্টার আদেশে জুলাই সনদের আইনি রূপ দিতে হবে

নভেম্বরের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা শুরুর দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি

আইআরআই’র সঙ্গে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা এনসিপির

দেশে মুক্তি পাচ্ছে জাপানি অ্যানিমে সিরিজ, শিশুদের দেখা নিষেধ

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত