গিয়াসউদ্দিন মিলন, চাঁদপুর
চাঁদপুরের অধিকাংশ মানুষ ইসলামপ্রিয়। শান্তিপূর্ণ জেলা হিসেবেও আছে দীর্ঘকালের খ্যাতি। স্বাধীনতার পর থেকে রাজনীতিকদের মধ্যেও ছিল দলমত-নির্বিশেষে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। পদ্মা-মেঘনার এই মোহনার ইতিহাস-ঐতিহ্য ম্লান হতে শুরু করে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর। আওয়ামী লীগের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা যাওয়ায় প্রতিযোগিতামূলকভাবে বাড়ে রাজনৈতিক সহিংসতা। প্রায় ছয়শ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এই জনপদকে লাশের নগরীতে পরিণত করেছিল ফ্যাসিবাদী দলটি।
চার বারের ক্ষমতা দখলকারী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের শোষণ ছিল দুঃস্বপ্ন। চাঁদপুরের জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল আওয়ামী সন্ত্রাসী এবং পুলিশ ও প্রশাসনের দলবাজ কর্মকর্তারা। এই সাড়ে ১৫ বছরে জেলায় ৫৯৮ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক কারণে লাশ হয়েছেন ৫২ জন। আহতের সংখ্যা অগণিত। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের দাবিয়ে রাখতে তাদের বিরুদ্ধে ৪১০টি মামলা করা হয়। এতে আসামির সংখ্যা ১৭ হাজার ৪৩৯ জন। তবে জুলাই বিপ্লবের পর এসব মামলার ৯০ শতাংশ সমাধান হয়ে গেছে। অন্যগুলোর প্রত্যাহার প্রক্রিয়া চলমান আছে।
বছরের পর বছর মসনদ টিকিয়ে রাখতে মামলাকে প্রধান হাতিয়ার বানিয়েছিল আওয়ামী লীগ। জাতীয়তাবাদী শক্তি ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের নির্যাতন-হয়রানি এবং এলাকা ছাড়া করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। আওয়ামী জাহেলিয়াতের দুঃশাসনে বহু মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এমনকি চাঁদপুরের আওয়ামী লীগের ত্যাগী, দায়িত্বশীল ও ভদ্র নেতারাও হাইব্রিড নেতাদের দাপটে কোণঠাসা ছিলেন।
চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমদ এবং সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম দুলাল পাটোয়ারীসহ বেশকিছু জ্যেষ্ঠ নেতা নিজ দলেই পরগাছার মতো ছিলেন। সদরের আসনে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সংসদ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি। তিনি এ সময়কালে তিনবার মন্ত্রীর চেয়ারে ছিলেন। সে সময় চাঁদপুরে আওয়ামী রাজনীতিতে হাইব্রিডদের পদচারণাই ছিল বেশি।
ডা. দীপু মনির বালু এবং ভূমিখেকো বাহিনী
চাঁদপুরে আওয়ামী রাজনীতিতে ডা. দীপু মনির ছিল আকস্মিক আবির্ভাব। স্থানীয় ত্যাগী ও প্রবীণ রাজনীতিকদের ডিঙিয়ে তিনি এমপি-মন্ত্রী হয়েছিলেন। তার কারণে দলে ভাঙন দেখা দিয়েছিল। প্রবীণরা ছিলেন একদিকে, আর তরুণদের নিয়ে রাজনীতি করেছেন দীপু মনি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন অনন্য। তবে তার বড় ভাই ডা. যাওয়াদুর রহিম টিপু এবং ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বালুখেকো সেলিম খানের গড়ে ওঠা একটি চক্র দীপু মনির যত অর্জন সব বিলীন করে দেয়।
টিপু হাইমচরে সরকারি জমি কারসাজি করে নিজের নামে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘টিপু নগর’। চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে ৬২ একর জমি ২০ গুণ দাম বাড়িয়ে করেছিলেন মৌজার দর পরিবর্তন। ওই জমির সরকারি মূল্য ছিল ১৯৪ কোটি টাকা। তাদের প্রতারণার কারণে দাম হয়েছিল ৫৫৩ কোটি টাকা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। চাঁদপুরে তৎকালীন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিসের কারণে তারা সরকারি সেই টাকা আর আত্মসাৎ করার সুযোগ পাননি।
মন্ত্রী দীপু মনি এবং তার ভাই টিপুর নামে চাঁদপুর শহরের কদমতলায় ৬টি ফ্ল্যাট আছে। যা তারা চাঁদপুর পৌরসভা থেকে কিনেছেন। চাঁদপুর সদর উপজেলার রামপুর ইউনিয়নে তাদের পৈত্রিক বাড়ি আছে। সেখানে শুধু থাকার জন্য একটা স্থাপনা আছে। এর বাইরে চাঁদপুরে আর তাদের কোনো স্থাপনা বা সম্পত্তি নেই। তবে তার বিরুদ্ধে নিয়োগ, তদবির এবং বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। এ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানের পর মামলা চলমান আছে। দুদকের মতে, তার বিরুদ্ধে ৮ কোটি টাকার বৈধ আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে তিনি জেলে আছেন। তার ভাই টিপু প্রবাসে। ঢাকার বনানীতে দীপু মনির বাবার পৈত্রিক বাড়িতে তারা থাকতেন।
দীপু মনির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল লক্ষ্মীপুর ইউপি চেয়ারম্যান বালুখেকো সেলিমকে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে সহযোগিতা করা। নদী থেকে সেলিমের অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের জন্য দীপু মনি মন্ত্রণালয়ে ১৫টি চিঠি দিয়েছিলেন। সেই চিঠির বলে সেলিম প্রতিদিন কোটি টাকার বালু উত্তোলন করতেন। সে হিসাব অনুযায়ী সেলিম ৮ বছরে ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার বালু উত্তোলন করেছেন। এই টাকার একটি বড় অংশ যেত দীপু মনির ভাই টিপুর কাছে।
বালু উত্তোলনের টাকায় সেলিম চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য নামে-বেনামে ৬২ একর জমি কিনেছেন। শেখ পরিবারের নামে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ঢাকার সাইনবোর্ডে ১০ তলা বাড়ি করেছেন। কাকরাইলে দুটি ৬ তলা বাড়ি কিনেছেন। চাঁদপুর শহরে একাধিক প্লট এবং ফ্ল্যাট কিনেছেন। অন্যদিকে দীপু মনির ভাই টিপু কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। শেষ পর্যন্ত ২০২৪-এর বিপ্লবে জনতার হাতে সেলিম খানের মৃত্যু হয় এবং টিপু বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
সন্ত্রাসের রাজত্ব মতলব উত্তর
১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল এবং ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মতলব উত্তর জনপদ ছিল সন্ত্রাসের আস্তানা। ওই সময়ে এই উপজেলায় রাজত্ব ছিল ঢাকার অন্যতম গডফাদার মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার। তিনি ১৯৯৬ সালে অনেকটা জোর-জুলুমের নির্বাচনের মাধ্যমে এমপি নির্বাচিত হন। শেখ হাসিনার সরকার তাকে মন্ত্রীও বানায়। সেই থেকে মতলব উত্তরে তার সন্ত্রাস শুরু। ভিন্ন মতের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তার ভয়ে ছিল এলাকা ছাড়া। তার হুকুমের বাইরে সেখানে কিছুই হয় না। জমি দখল, ব্যবসায় ভাগ বসানো, মেঘনা এবং ধনাগোদা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনসহ এমন কোনো অপকর্ম ছিল না, যা তার লোকজন করত না। এসব কারবার থেকে কমিশন নিয়ে মালিক হন শত শত কোটি টাকার।
মায়ার মেয়ে-জামাই নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনায় জড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি ক’দিন কিছুটা চুপ ছিলেন। শেখ হাসিনাও তাকে এক মেয়াদে মনোনয়ন দেননি। ওই সময় ওই এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন তার বড় ছেলে দিপু চৌধুরী (বর্তমানে প্রয়াত)। বাবার অবর্তমানে দিপু চৌধুরীর নির্দেশে চলত মতলব উত্তর-দক্ষিণের জনপদ। সব শেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলেও শেষ রক্ষা হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকেই তিনি পলাতক আছেন।
মায়ার আকাশছোঁয়া ক্ষমতা
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদপদবি এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছের মানুষ পরিচয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, ভূমি দখল, ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে শত শত দোকান বাগিয়ে নেওয়াই ছিল মায়ার প্রধান কাজ। চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর ও দক্ষিণ) আসন থেকে যখনই তিনি নির্বাচন করতেন, তখনই সে এলাকায় শুরু হতো ত্রাসের রাজত্ব। এখানে কেউ তার বিরোধিতা করলেই তাকে কঠিন মাশুল গুনতে হতো। তার ভয়ে এ পর্যন্ত বহু লোক এলাকা ছাড়া হয়েছে। মায়া অত্যন্ত চতুর ছিলেন। তিনি দখল করা জমি এবং দোকান কখনোই তার কাছে বেশিদিন রাখতেন না। স্বল্প সময়ে এসব বিক্রি করে দিতেন। মতলব থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সংসদ সদস্য প্রার্থী বলেন, মায়া ছিলেন নগদে বিশ্বাসী। তার সঙ্গে কোনো নেতা দেখা করতে গেলেও তাকে টাকা দিতে হতো। মতলব উত্তরের মোহনপুরে পৈত্রিক বাড়িতে তাদের একাধিক আধুনিক ভবন আছে। রাজধানী উত্তরায় তার নিজস্ব একটি বাড়ি আছে।
কচুয়ার গডফাদার মখা আলমগীর
প্রাণনাশের ভয়ে নাম প্রকাশ না করে উপজেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, মখা আলমগীর (ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর) ছিলেন সরকারের সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা। ১৯৯৬ সালে সচিবালয়ে জনতার মঞ্চ করে তিনি শেখ হাসিনার নজরে আসেন। হাসিনা তখন কৃতজ্ঞতা হিসেবে তাকে বিনা ভোটে টেকনোক্র্যাট কোটায় পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। তখনই তিনি কচুয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেন।
২০০৮ সালে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। সংসদে পা রেখেই শুরু করেন বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করার কার্যক্রম। তিনি বিএনপির জনপ্রিয় এমপি ও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলন এবং তার স্ত্রী বেবীর বিরুদ্ধে ৩৭টি গায়েবি মামলা দেন। বন্দুকযুদ্ধের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে হত্যা করান বিএনপি-জামায়াতের চার নেতাকর্মীকে।
২০১৩ সালে এক বছরের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মখা আলমগীর। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীকে একটার পর একটা মামলা হামলা করে এলাকা ছাড়া করেন তিনি। সাভারে রানা প্লাজা বিধ্বস্তের ঘটনায় তিনি বলেছিলেন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা ওই ভবনের কলাপসিবল গেট টানাটানি করার কারণে নাকি ভবনটি বিধ্বস্ত হয়েছিল। তার এই কাল্পনিক বক্তব্যের কারণে দেশ-বিদেশে তিনি চরম নিন্দনীয় ও হাসির পাত্র হয়েছিলেন। অবান্তর মন্তব্য করায় মন্ত্রিত্বও হারান।
মখা আলমগীর ছিলেন অন্যতম ব্যাংক লুটেরা। তিনি বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারির খলনায়ক ছিলেন। ২০১২ সালে তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ভুয়া কাগজপত্রে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। ওই টাকা থেকে ৫০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আমানত রেখে দি ফার্মার্স ব্যাংক লিমিটেডের অনুমোদন নেন। অবশিষ্ট টাকা তিনি বিদেশে পাচার করেছেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মনে করে।
পদ্মা ব্যাংকের (আগের নাম দি ফার্মার্স ব্যাংক) মালিক হয়ে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এ প্রতিষ্ঠান থেকেও তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে ৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ঘটনায় দুদক মখা আলমগীরসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের অক্টোবরে মামলা করেছে ।
টাকার কুমির ছিলেন সাবেক এমপি ড. শামসুল হক ভূঁইয়া
চাঁদপুর-৪ ফরিদগঞ্জ আসনের সাবেক এমপি ড. মোহাম্মদ শামসুল হক ভূঁইয়া ১৯৯৮ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন। সেই চাকরির সুবাদে তিনি কী পরিমাণ টাকা কামিয়েছেন তার হিসাব আজও কেউ জানে না। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার এক আইনজীবী আফসোস করে বলেন, পরপারেতো চলেই গেলেন, সম্পদতো আর আপনার সঙ্গে কবরে গেল না।
তার দেওয়া তথ্যমতে, ড. শামসুল চাকরি শেষে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ইচ্ছে ছিল এমপি হবেন, হয়েছেন। সিলেটের শ্রীমঙ্গলে তার ৬০০ এবং ৪০০ একরের দুটি চা বাগান রয়েছে। চাঁদপুর শহরে আছে স্টার আলকায়েদ নামে একটি জুট মিল। শহরতলীর বাবুরহাটে ৫২ একর জমির বাগানবাড়ি। শহরের স্টেডিয়াম রোডে ২৪ শতক জমিসহ বেশ কয়েকটি প্লট। ঢাকায় ৫০টি বাড়ি ও ৫০০ দোকান আছে।
তিনি চাঁদপুর সদর এবং ফরিদগঞ্জ থেকে মোট ৪ বার নির্বাচন করেছিলেন। ২০১৪ সালে চাঁদপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
চাঁদপুরে খুনের সংখ্যা
জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চাঁদপুরে খুন হয়েছে ৫৯৮ জন। এর মধ্যে রাজনৈতিক কারণে লাশ হয়েছে ৫ জন। তবে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক খুনের সংখ্যা ৫২টি। এর মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হত্যা করা হয়েছে ৩২ জনকে। এর আগে খুন হয়েছে ১৬ জন। সব মিলিয়ে গত সাড়ে ১৫ বছরে এ জেলায় লাশ হয়েছেন ৫৯৮ জন।
রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চাঁদপুর জেলা শহরে দুই দফায় খুন হন ৪ জন। তাদের মধ্যে ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি হাসান আলি হাই স্কুল মাঠে নিহত হন বিএনপি কর্মী আবুল হোসেন ও লিমন ছৈয়াল। ২০১৩ সালের ৩ ডিসেম্বর ৪ দলীয় জোটের বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রদল কর্মী তাজুল ইসলাম ও শিবির কর্মী মনোয়ার জাওয়াদ সিয়াম। অন্য ঘটনায় সদর উপজেলার শাহ মাহমুদপুর ইউনিয়নে বিজিবির গুলিতে খুন হন একজন। এছাড়া মতলব উত্তরে তিনজন। এছাড়া কচুয়ায় ৩, ফরিদগঞ্জে ৩, মতলব দক্ষিণে ২ ও হাইমচরে একজন খুন হয়েছে। তারা সবাই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ছিলেন।
এদিকে গণঅভ্যুত্থানে সরকারি হিসেবে চাঁদপুরে শহীদ হয়েছেন ৩২ জন। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মহসীন উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ধর্মীয় উসকানিতে খুন
২০২১ সালের ১৬ অক্টোবর কুমিল্লা পূজা মণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হন। এ বিষয়ে রান্ধুনীমুড়া এলাকার আব্বাস উদ্দিনের ছেলে রিপন বলেন, আমার ভাই শামীম ভ্যানে করে কলা বিক্রি করতে গিয়ে পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হয়। ওই ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উসকানিতে পুলিশ ১৩৯ রাউন্ড গুলি বর্ষণ করলে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে। সেদিন হাজীগঞ্জ বাজার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।
চাঁদপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সলিম উল্লাহ সেলিম বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার সময় আমাদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা হয়েছিল। রাজপথে মিছিল-মিটিং করে অধিকার আদায়ের সব আন্দোলনে আমরা পুলিশি বাধার মুখে পড়েছি । সেটাও আমরা শান্তিমত করতে পারিনি। আমাদের নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে অধিকাংশ সময়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারা অনেকে জানতেনই না কী কারণে আসামি করা হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচার দীপু মনির লোকজন আমাদের দুঃসময়ের নেতা জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিকের বাড়ি-ঘরে পরপর দুইবার হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছিল।’
জেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘আমিসহ দলের অনেক নেতাকর্মী খুনি হাসিনার দেওয়া মিথ্যা মামলায় একাধিকবার জেল খেটেছি। বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় হাজিরা দিয়েছি। আমাদের নেতাকর্মীরা ঠিকমতো বাসা বাড়িতে ঘুমাতেও পারিনি। দীর্ঘ ১৫ বছর আমাদের নেতাকর্মীদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সরকারি কোনো চাকরিতে যোগদান করতে দেওয়া হয়নি। উল্টো আমাদের বেশকিছু লোককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আমাদের একেক নেতার নামে ১৫ থেকে ২০টি করে মামলা দেওয়া হয়েছে। মাসে প্রায় ২০ দিনই আমরা আদালতের বারান্দায় হাজিরা দিতাম। অনেকে মামলার ভয়ে বাড়ি ছাড়া ছিলেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘সাড়ে ১৫ বছরে আমাদের নেতাকর্মীর নামে ১৮০টি মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৪ হাজার ৪১০ নেতাকর্মীকে। আওয়ামী দুঃশাসনে ২০১৩ সালের ৩ ডিসেম্বর চাঁদপুর শহরে একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের গুলিতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী মনোয়ার জাওয়াদ সিয়াম শিল্পকলা একাডেমির সামনে নিহত হন। ১০ জামায়াত নেতার বাড়ি-ঘর ভাঙচুর করা হয়। চাকরিচ্যুত করা হয়েছে অনেককে । এর মধ্যে মতলব উত্তর উপজেলার ছেঙ্গারচর কলেজের অধ্যাপক দেওয়ান আবুল বাশার, আল আমিন একাডেমির ৭ জন, গুনরাজদী শাখার ১ শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আরো অনেকে নানাভাবে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।’
চাঁদপুরের অধিকাংশ মানুষ ইসলামপ্রিয়। শান্তিপূর্ণ জেলা হিসেবেও আছে দীর্ঘকালের খ্যাতি। স্বাধীনতার পর থেকে রাজনীতিকদের মধ্যেও ছিল দলমত-নির্বিশেষে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। পদ্মা-মেঘনার এই মোহনার ইতিহাস-ঐতিহ্য ম্লান হতে শুরু করে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর। আওয়ামী লীগের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা যাওয়ায় প্রতিযোগিতামূলকভাবে বাড়ে রাজনৈতিক সহিংসতা। প্রায় ছয়শ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এই জনপদকে লাশের নগরীতে পরিণত করেছিল ফ্যাসিবাদী দলটি।
চার বারের ক্ষমতা দখলকারী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের শোষণ ছিল দুঃস্বপ্ন। চাঁদপুরের জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল আওয়ামী সন্ত্রাসী এবং পুলিশ ও প্রশাসনের দলবাজ কর্মকর্তারা। এই সাড়ে ১৫ বছরে জেলায় ৫৯৮ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক কারণে লাশ হয়েছেন ৫২ জন। আহতের সংখ্যা অগণিত। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের দাবিয়ে রাখতে তাদের বিরুদ্ধে ৪১০টি মামলা করা হয়। এতে আসামির সংখ্যা ১৭ হাজার ৪৩৯ জন। তবে জুলাই বিপ্লবের পর এসব মামলার ৯০ শতাংশ সমাধান হয়ে গেছে। অন্যগুলোর প্রত্যাহার প্রক্রিয়া চলমান আছে।
বছরের পর বছর মসনদ টিকিয়ে রাখতে মামলাকে প্রধান হাতিয়ার বানিয়েছিল আওয়ামী লীগ। জাতীয়তাবাদী শক্তি ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের নির্যাতন-হয়রানি এবং এলাকা ছাড়া করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। আওয়ামী জাহেলিয়াতের দুঃশাসনে বহু মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এমনকি চাঁদপুরের আওয়ামী লীগের ত্যাগী, দায়িত্বশীল ও ভদ্র নেতারাও হাইব্রিড নেতাদের দাপটে কোণঠাসা ছিলেন।
চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমদ এবং সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম দুলাল পাটোয়ারীসহ বেশকিছু জ্যেষ্ঠ নেতা নিজ দলেই পরগাছার মতো ছিলেন। সদরের আসনে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সংসদ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি। তিনি এ সময়কালে তিনবার মন্ত্রীর চেয়ারে ছিলেন। সে সময় চাঁদপুরে আওয়ামী রাজনীতিতে হাইব্রিডদের পদচারণাই ছিল বেশি।
ডা. দীপু মনির বালু এবং ভূমিখেকো বাহিনী
চাঁদপুরে আওয়ামী রাজনীতিতে ডা. দীপু মনির ছিল আকস্মিক আবির্ভাব। স্থানীয় ত্যাগী ও প্রবীণ রাজনীতিকদের ডিঙিয়ে তিনি এমপি-মন্ত্রী হয়েছিলেন। তার কারণে দলে ভাঙন দেখা দিয়েছিল। প্রবীণরা ছিলেন একদিকে, আর তরুণদের নিয়ে রাজনীতি করেছেন দীপু মনি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন অনন্য। তবে তার বড় ভাই ডা. যাওয়াদুর রহিম টিপু এবং ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বালুখেকো সেলিম খানের গড়ে ওঠা একটি চক্র দীপু মনির যত অর্জন সব বিলীন করে দেয়।
টিপু হাইমচরে সরকারি জমি কারসাজি করে নিজের নামে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘টিপু নগর’। চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে ৬২ একর জমি ২০ গুণ দাম বাড়িয়ে করেছিলেন মৌজার দর পরিবর্তন। ওই জমির সরকারি মূল্য ছিল ১৯৪ কোটি টাকা। তাদের প্রতারণার কারণে দাম হয়েছিল ৫৫৩ কোটি টাকা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। চাঁদপুরে তৎকালীন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিসের কারণে তারা সরকারি সেই টাকা আর আত্মসাৎ করার সুযোগ পাননি।
মন্ত্রী দীপু মনি এবং তার ভাই টিপুর নামে চাঁদপুর শহরের কদমতলায় ৬টি ফ্ল্যাট আছে। যা তারা চাঁদপুর পৌরসভা থেকে কিনেছেন। চাঁদপুর সদর উপজেলার রামপুর ইউনিয়নে তাদের পৈত্রিক বাড়ি আছে। সেখানে শুধু থাকার জন্য একটা স্থাপনা আছে। এর বাইরে চাঁদপুরে আর তাদের কোনো স্থাপনা বা সম্পত্তি নেই। তবে তার বিরুদ্ধে নিয়োগ, তদবির এবং বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। এ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানের পর মামলা চলমান আছে। দুদকের মতে, তার বিরুদ্ধে ৮ কোটি টাকার বৈধ আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে তিনি জেলে আছেন। তার ভাই টিপু প্রবাসে। ঢাকার বনানীতে দীপু মনির বাবার পৈত্রিক বাড়িতে তারা থাকতেন।
দীপু মনির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল লক্ষ্মীপুর ইউপি চেয়ারম্যান বালুখেকো সেলিমকে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে সহযোগিতা করা। নদী থেকে সেলিমের অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের জন্য দীপু মনি মন্ত্রণালয়ে ১৫টি চিঠি দিয়েছিলেন। সেই চিঠির বলে সেলিম প্রতিদিন কোটি টাকার বালু উত্তোলন করতেন। সে হিসাব অনুযায়ী সেলিম ৮ বছরে ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার বালু উত্তোলন করেছেন। এই টাকার একটি বড় অংশ যেত দীপু মনির ভাই টিপুর কাছে।
বালু উত্তোলনের টাকায় সেলিম চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য নামে-বেনামে ৬২ একর জমি কিনেছেন। শেখ পরিবারের নামে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ঢাকার সাইনবোর্ডে ১০ তলা বাড়ি করেছেন। কাকরাইলে দুটি ৬ তলা বাড়ি কিনেছেন। চাঁদপুর শহরে একাধিক প্লট এবং ফ্ল্যাট কিনেছেন। অন্যদিকে দীপু মনির ভাই টিপু কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। শেষ পর্যন্ত ২০২৪-এর বিপ্লবে জনতার হাতে সেলিম খানের মৃত্যু হয় এবং টিপু বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
সন্ত্রাসের রাজত্ব মতলব উত্তর
১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল এবং ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মতলব উত্তর জনপদ ছিল সন্ত্রাসের আস্তানা। ওই সময়ে এই উপজেলায় রাজত্ব ছিল ঢাকার অন্যতম গডফাদার মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার। তিনি ১৯৯৬ সালে অনেকটা জোর-জুলুমের নির্বাচনের মাধ্যমে এমপি নির্বাচিত হন। শেখ হাসিনার সরকার তাকে মন্ত্রীও বানায়। সেই থেকে মতলব উত্তরে তার সন্ত্রাস শুরু। ভিন্ন মতের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তার ভয়ে ছিল এলাকা ছাড়া। তার হুকুমের বাইরে সেখানে কিছুই হয় না। জমি দখল, ব্যবসায় ভাগ বসানো, মেঘনা এবং ধনাগোদা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনসহ এমন কোনো অপকর্ম ছিল না, যা তার লোকজন করত না। এসব কারবার থেকে কমিশন নিয়ে মালিক হন শত শত কোটি টাকার।
মায়ার মেয়ে-জামাই নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনায় জড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি ক’দিন কিছুটা চুপ ছিলেন। শেখ হাসিনাও তাকে এক মেয়াদে মনোনয়ন দেননি। ওই সময় ওই এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন তার বড় ছেলে দিপু চৌধুরী (বর্তমানে প্রয়াত)। বাবার অবর্তমানে দিপু চৌধুরীর নির্দেশে চলত মতলব উত্তর-দক্ষিণের জনপদ। সব শেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলেও শেষ রক্ষা হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকেই তিনি পলাতক আছেন।
মায়ার আকাশছোঁয়া ক্ষমতা
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদপদবি এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছের মানুষ পরিচয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, ভূমি দখল, ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে শত শত দোকান বাগিয়ে নেওয়াই ছিল মায়ার প্রধান কাজ। চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর ও দক্ষিণ) আসন থেকে যখনই তিনি নির্বাচন করতেন, তখনই সে এলাকায় শুরু হতো ত্রাসের রাজত্ব। এখানে কেউ তার বিরোধিতা করলেই তাকে কঠিন মাশুল গুনতে হতো। তার ভয়ে এ পর্যন্ত বহু লোক এলাকা ছাড়া হয়েছে। মায়া অত্যন্ত চতুর ছিলেন। তিনি দখল করা জমি এবং দোকান কখনোই তার কাছে বেশিদিন রাখতেন না। স্বল্প সময়ে এসব বিক্রি করে দিতেন। মতলব থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সংসদ সদস্য প্রার্থী বলেন, মায়া ছিলেন নগদে বিশ্বাসী। তার সঙ্গে কোনো নেতা দেখা করতে গেলেও তাকে টাকা দিতে হতো। মতলব উত্তরের মোহনপুরে পৈত্রিক বাড়িতে তাদের একাধিক আধুনিক ভবন আছে। রাজধানী উত্তরায় তার নিজস্ব একটি বাড়ি আছে।
কচুয়ার গডফাদার মখা আলমগীর
প্রাণনাশের ভয়ে নাম প্রকাশ না করে উপজেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, মখা আলমগীর (ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর) ছিলেন সরকারের সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা। ১৯৯৬ সালে সচিবালয়ে জনতার মঞ্চ করে তিনি শেখ হাসিনার নজরে আসেন। হাসিনা তখন কৃতজ্ঞতা হিসেবে তাকে বিনা ভোটে টেকনোক্র্যাট কোটায় পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। তখনই তিনি কচুয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেন।
২০০৮ সালে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। সংসদে পা রেখেই শুরু করেন বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করার কার্যক্রম। তিনি বিএনপির জনপ্রিয় এমপি ও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলন এবং তার স্ত্রী বেবীর বিরুদ্ধে ৩৭টি গায়েবি মামলা দেন। বন্দুকযুদ্ধের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে হত্যা করান বিএনপি-জামায়াতের চার নেতাকর্মীকে।
২০১৩ সালে এক বছরের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মখা আলমগীর। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীকে একটার পর একটা মামলা হামলা করে এলাকা ছাড়া করেন তিনি। সাভারে রানা প্লাজা বিধ্বস্তের ঘটনায় তিনি বলেছিলেন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা ওই ভবনের কলাপসিবল গেট টানাটানি করার কারণে নাকি ভবনটি বিধ্বস্ত হয়েছিল। তার এই কাল্পনিক বক্তব্যের কারণে দেশ-বিদেশে তিনি চরম নিন্দনীয় ও হাসির পাত্র হয়েছিলেন। অবান্তর মন্তব্য করায় মন্ত্রিত্বও হারান।
মখা আলমগীর ছিলেন অন্যতম ব্যাংক লুটেরা। তিনি বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারির খলনায়ক ছিলেন। ২০১২ সালে তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ভুয়া কাগজপত্রে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। ওই টাকা থেকে ৫০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আমানত রেখে দি ফার্মার্স ব্যাংক লিমিটেডের অনুমোদন নেন। অবশিষ্ট টাকা তিনি বিদেশে পাচার করেছেন বলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মনে করে।
পদ্মা ব্যাংকের (আগের নাম দি ফার্মার্স ব্যাংক) মালিক হয়ে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এ প্রতিষ্ঠান থেকেও তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে ৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ঘটনায় দুদক মখা আলমগীরসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের অক্টোবরে মামলা করেছে ।
টাকার কুমির ছিলেন সাবেক এমপি ড. শামসুল হক ভূঁইয়া
চাঁদপুর-৪ ফরিদগঞ্জ আসনের সাবেক এমপি ড. মোহাম্মদ শামসুল হক ভূঁইয়া ১৯৯৮ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন। সেই চাকরির সুবাদে তিনি কী পরিমাণ টাকা কামিয়েছেন তার হিসাব আজও কেউ জানে না। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার এক আইনজীবী আফসোস করে বলেন, পরপারেতো চলেই গেলেন, সম্পদতো আর আপনার সঙ্গে কবরে গেল না।
তার দেওয়া তথ্যমতে, ড. শামসুল চাকরি শেষে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ইচ্ছে ছিল এমপি হবেন, হয়েছেন। সিলেটের শ্রীমঙ্গলে তার ৬০০ এবং ৪০০ একরের দুটি চা বাগান রয়েছে। চাঁদপুর শহরে আছে স্টার আলকায়েদ নামে একটি জুট মিল। শহরতলীর বাবুরহাটে ৫২ একর জমির বাগানবাড়ি। শহরের স্টেডিয়াম রোডে ২৪ শতক জমিসহ বেশ কয়েকটি প্লট। ঢাকায় ৫০টি বাড়ি ও ৫০০ দোকান আছে।
তিনি চাঁদপুর সদর এবং ফরিদগঞ্জ থেকে মোট ৪ বার নির্বাচন করেছিলেন। ২০১৪ সালে চাঁদপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
চাঁদপুরে খুনের সংখ্যা
জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চাঁদপুরে খুন হয়েছে ৫৯৮ জন। এর মধ্যে রাজনৈতিক কারণে লাশ হয়েছে ৫ জন। তবে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক খুনের সংখ্যা ৫২টি। এর মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হত্যা করা হয়েছে ৩২ জনকে। এর আগে খুন হয়েছে ১৬ জন। সব মিলিয়ে গত সাড়ে ১৫ বছরে এ জেলায় লাশ হয়েছেন ৫৯৮ জন।
রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চাঁদপুর জেলা শহরে দুই দফায় খুন হন ৪ জন। তাদের মধ্যে ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি হাসান আলি হাই স্কুল মাঠে নিহত হন বিএনপি কর্মী আবুল হোসেন ও লিমন ছৈয়াল। ২০১৩ সালের ৩ ডিসেম্বর ৪ দলীয় জোটের বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রদল কর্মী তাজুল ইসলাম ও শিবির কর্মী মনোয়ার জাওয়াদ সিয়াম। অন্য ঘটনায় সদর উপজেলার শাহ মাহমুদপুর ইউনিয়নে বিজিবির গুলিতে খুন হন একজন। এছাড়া মতলব উত্তরে তিনজন। এছাড়া কচুয়ায় ৩, ফরিদগঞ্জে ৩, মতলব দক্ষিণে ২ ও হাইমচরে একজন খুন হয়েছে। তারা সবাই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ছিলেন।
এদিকে গণঅভ্যুত্থানে সরকারি হিসেবে চাঁদপুরে শহীদ হয়েছেন ৩২ জন। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মহসীন উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ধর্মীয় উসকানিতে খুন
২০২১ সালের ১৬ অক্টোবর কুমিল্লা পূজা মণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হন। এ বিষয়ে রান্ধুনীমুড়া এলাকার আব্বাস উদ্দিনের ছেলে রিপন বলেন, আমার ভাই শামীম ভ্যানে করে কলা বিক্রি করতে গিয়ে পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হয়। ওই ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উসকানিতে পুলিশ ১৩৯ রাউন্ড গুলি বর্ষণ করলে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে। সেদিন হাজীগঞ্জ বাজার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।
চাঁদপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সলিম উল্লাহ সেলিম বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার সময় আমাদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা হয়েছিল। রাজপথে মিছিল-মিটিং করে অধিকার আদায়ের সব আন্দোলনে আমরা পুলিশি বাধার মুখে পড়েছি । সেটাও আমরা শান্তিমত করতে পারিনি। আমাদের নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে অধিকাংশ সময়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারা অনেকে জানতেনই না কী কারণে আসামি করা হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচার দীপু মনির লোকজন আমাদের দুঃসময়ের নেতা জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিকের বাড়ি-ঘরে পরপর দুইবার হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছিল।’
জেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘আমিসহ দলের অনেক নেতাকর্মী খুনি হাসিনার দেওয়া মিথ্যা মামলায় একাধিকবার জেল খেটেছি। বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় হাজিরা দিয়েছি। আমাদের নেতাকর্মীরা ঠিকমতো বাসা বাড়িতে ঘুমাতেও পারিনি। দীর্ঘ ১৫ বছর আমাদের নেতাকর্মীদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সরকারি কোনো চাকরিতে যোগদান করতে দেওয়া হয়নি। উল্টো আমাদের বেশকিছু লোককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আমাদের একেক নেতার নামে ১৫ থেকে ২০টি করে মামলা দেওয়া হয়েছে। মাসে প্রায় ২০ দিনই আমরা আদালতের বারান্দায় হাজিরা দিতাম। অনেকে মামলার ভয়ে বাড়ি ছাড়া ছিলেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘সাড়ে ১৫ বছরে আমাদের নেতাকর্মীর নামে ১৮০টি মামলা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে ৪ হাজার ৪১০ নেতাকর্মীকে। আওয়ামী দুঃশাসনে ২০১৩ সালের ৩ ডিসেম্বর চাঁদপুর শহরে একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের গুলিতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী মনোয়ার জাওয়াদ সিয়াম শিল্পকলা একাডেমির সামনে নিহত হন। ১০ জামায়াত নেতার বাড়ি-ঘর ভাঙচুর করা হয়। চাকরিচ্যুত করা হয়েছে অনেককে । এর মধ্যে মতলব উত্তর উপজেলার ছেঙ্গারচর কলেজের অধ্যাপক দেওয়ান আবুল বাশার, আল আমিন একাডেমির ৭ জন, গুনরাজদী শাখার ১ শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আরো অনেকে নানাভাবে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।’
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে বিভিন্ন মেরূকরণ। এ নির্বাচনে কোন দল ক্ষমতায় আসবে, কোন দল কার সঙ্গে সমঝোতা বা জোট করে ভোট করবেÑএসব বিষয় নিয়ে আলোচনা ও তৎপরতাও জোরদার হচ্ছে। বিশেষ করে ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে সাধারণ ভোটারদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মহলে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেনীলের দেশখ্যাত নীলফামারী দীর্ঘদিন শোষণ করেছিল ইংরেজরা। তাদের স্থানীয় নিপীড়ক নীলকরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন উত্তরের এই জেলার চাষিরা। ২০০ বছর পর সেই নিষ্ঠুর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করেন আওয়ামী ‘কসাই’খ্যাত আসাদুজ্জামান নূর।
১১ ঘণ্টা আগেআগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় জেলা প্রশাসকদেরই (ডিসি) রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার দুজন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন ডিসিসহ ৬৬ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে।
১ দিন আগেবছরের প্রায় ১০ মাস পার হলেও মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ শুরু হয়নি। এমনকি পাঠ্যবইয়ের কনটেন্টও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি; এখনো চলছে পরিবর্তন-পরিমার্জনের কাজ। এছাড়া ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনও মেলেনি এখনো।
১ দিন আগে