সাড়া নেই চসিকের ডোর টু ডোর প্রকল্পে

এম কে মনির, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪: ৫৭

নগরের বাসা-বাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহের জন্য গত জুলাইয়ে ‘ডোর টু ডোর’ প্রকল্প চালু করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কিন্তু সেই প্রকল্প খুব একটা কাজে আসছে না। সুফলও পাচ্ছে না নগরবাসী। সড়কে, অলিগলিতে যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা; ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ, বাড়ছে জনদুর্ভোগ।

বিজ্ঞাপন

প্রকল্পের কাজ পাওয়া ঠিকাদার ও চসিকের নিজস্ব পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি অনেক এলাকার বাসিন্দা বাসা-বাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহে চসিকের এই প্রকল্পে তেমন সাড়াও দিচ্ছেন না।

চসিক নির্ধারিত বিলের বেশি টাকা আদায় না করতে সতর্কতা জারির পাশাপাশি নিয়মনীতি মেনে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন সিটি মেয়র। পাশাপাশি ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি সিটি গড়তে নগরবাসীকেও সহযোগিতা করার আহ্বান জানান তিনি।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, বেশিরভাগ ঠিকাদার ময়লা সংগ্রহে ঠিকমতো না গেলেও বাড়তি টাকা আদায় করছেন ঠিকই। করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রতি ফ্ল্যাট বা বাসা থেকে ৬০-৭০ টাকার বেশি আদায় না করার জন্য বারবার নির্দেশনা দিলেও বেশিরভাগ ঠিকাদারই তাতে কর্ণপাত করছেন না।

নগরবাসীর অভিযোগ, সব এলাকায় ৬০-৭০ টাকার স্থলে ১০০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে দুর্ব্যবহারও করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে বেশকিছু আবাসিক এলাকার সমিতি নেতারাও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ প্রকল্প চালুর পর বিভিন্ন এলাকায় থাকা সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিন তুলে নিয়েছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। এতে দিনের পর দিন ময়লা না আনায় বাসিন্দারা নিজে ডাস্টবিনে গিয়েও ময়লা ফেলতে পারছেন না ।

তাদের ভাষ্য, অধিকাংশ ঠিকাদার রাজনৈতিক দলের কর্মী বা নেতা হওয়ায় বাসাবাড়ির লোকজনের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেও প্রতিবাদ করতে পারছেন না কেউ।

গত ১৫ জুলাই এ-সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা অনুমোদন করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এতে বাসাবাড়ি থেকে ময়লা আনতে ৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল-রেস্তোরাঁ, শপিংমলের জন্য আলাদা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহে মেয়রের ঠিক করে দেওয়া ৭০ টাকা রেট মানছেন না কেউই। কাজ কমিয়ে দিয়েছেন পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মীরাও। প্রকল্প চালুর পর থেকে আর ময়লা তুলছেন না তারা।

এদিকে অভিযোগ উঠেছে, চসিকের প্রায় চার হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মীর অনেকেই রুটিন ডিউটি বাদ দিয়ে নিজেরাই বাসাবাড়ি থেকে ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ করে টাকা আদায় শুরু করেছেন। অথচ তাদের দায়িত্ব ডাস্টবিনে থাকা ময়লা ডাম্পিং বা মিনি ডাম্পিংয়ে নিয়ে যাওয়া।

নগরের বায়েজিদনগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সাজ্জাদ হোসেন জানান, প্রতিটি বাসা থেকে ১০০ টাকা করে আদায় করছে ঠিকাদার। তাদের ৬০-৭০ টাকার কথা বলা হলেও তারা তা মানতে নারাজ। আমাদের আবাসিকে ৪১০টি ফ্ল্যাট থেকে মাসিক ৪১ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে।

একই অভিযোগ করেন কর্নেল হাটের বাসিন্দা আকতার হোসেন। তিনি বলেন, ঠিকাদারের লোকজন আসার পর থেকে ময়লা নিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে ঝামেলা লেগেই আছে। কেউ নিজে গিয়ে ফেলে এলেও টাকা দিতে হয়। আবার তারা সময়মতো আসেও না; কিন্তু ময়লার টাকার জন্য হাজির হয় যথারীতি।

এদিকে চসিকের এ প্রকল্পে দ্বিমত পোষণ করেছেন অনেকেই । হিলভিউ আবাসিক এলাকা সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মনিরুল আলম বলেন, ময়লার জন্য টাকা দিয়ে কোনো সুফল আসবে না—অতীতেও আসেনি। আমরা কিন্তু হোল্ডিং ট্যাক্সের সঙ্গে সাত শতাংশ পরিচ্ছন্ন কর পরিশোধ করছি।

প্রকল্পের কারণে দুবার টাকা আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু ড্রেন, নালা—এগুলো পরিষ্কার করা হয় না। সারা বছর নোংরা থাকে। তদবির করেও মশার ওষুধ ছিটানো যায় না। একটি আবাসিকে ৯ জন ঠিকাদার কাজ করছে ময়লা নিয়ে। এখানে মাস্তানির প্রভাব খাটানো হয় এবং খারাপ ব্যবহার করা হয়। আমরা কতজনের সঙ্গে লেনদেন করব? এজন্য আমরা নিজস্বভাবেই ময়লা ফেলার ব্যবস্থা করছি। চসিকের কোনো আইনে এ ধরনের প্রকল্পের নিয়ম আছে কি না আমাদের জানা নেই।

একই কথা বলেন কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকার সভাপতি খোরশেদ আলমও। তিনি জানান, আমরা এখনো চসিকের এ প্রকল্পের সঙ্গে একমত নই। তারা এর বিনিময়ে আমাদের কোন কোন সুবিধা নিশ্চিত করবে, তা বলেনি। আমরা এর নিশ্চয়তা না পেলে ময়লা তাদের হাতে দেব না।

পাহাড়িকা আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. আলম জানান, নিয়মিত কেউ ময়লা নিতে আসে না। এতে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়; কিন্তু টাকা আদায় করা হচ্ছে ঠিকই। যার কাছ থেকে যা পারছে, তা-ই আদায় করছে। কোনো নীতিমালা কেউ মানছে না। আমরা দুটি ডাস্টবিনের জন্য মেয়রের কাছে আবেদন করেছি।

অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করে সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী জানান, আমাদের অনেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী ময়লা সংগ্রহ না করে নিজেরাই বাসাবাড়ি থেকে ময়লা নেওয়ার ব্যবসা শুরু করেছে। এতে তারা বেতনসহ দুদিকেই টাকা আয় করছে। ফলে ঠিকাদাররা পড়েছেন বেকায়দায় ।

আমরা বারবার বলছি, কেউ ৭০ টাকার বেশি নিলে আমাদের অভিযোগ দিতে হবে। আমি প্রথমে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করব; পরপর তিনবার এই অভিযোগ এলে কাজের চুক্তি বাতিল করা হবে। আমরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর।

এ বিষয়ে চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আমার দেশকে বলেন, এই প্রকল্প আগেও ছিল। কিন্তু ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করা হতো। কোনো বিশৃঙ্খলা যেন না হয়, সেজন্য প্রকল্পটা করে চার্জ নির্ধারণ করে দিয়েছি। কেউ এর আওতায় আসতে না চাইলে আমরা জোর করছি না।

তবে সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত চার্জের বেশি টাকা আদায়ের অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মূলত এ প্রকল্পের লক্ষ্য হলো আবর্জনা নিয়ে পুরো নগরীতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত