ভূমিকম্পে গতকাল শুক্রবার সকালে সারা দেশ প্রচণ্ডভাবে কেঁপে ওঠে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। এ সময় রাজধানীর পুরান ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, নরসিংদী এবং গাজীপুরে তিন শিশুসহ ১১ জন নিহত হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে হুড়োহুড়ি করে ভবন থেকে নিচে নামার সময় এবং অন্যান্য দুর্ঘটনায় তিন শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভবনে ফাটলের খবর পাওয়া গেছে। এতে সারা দেশে জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ আরো বড় ধরনের ভূমিকম্পের শঙ্কার মধ্যে রয়েছে।
ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি ধসে এবং অন্যান্য দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিতের কথা জানিয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ। এছাড়া ভূমিকম্পে হতাহতের ঘটনায় সমবেদনা জানিয়েছে জাতিসংঘ ও মার্কিন দূতাবাস।
ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের মতে, শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটের দিকে ভূমিকম্প হয়। এর তীব্রতা ছিল ৫ দশমিক ৭। উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর মাধবদী এলাকা। তবে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা বলছে, ভূমিকম্পটির তীব্রতা ছিল ৫ দশমিক ৫। কেন্দ্রস্থল নরসিংদী থেকে ১৪ কিলোমিটার পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে। গভীরতা ১০ কিলোমিটার। ইউরোপিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৬। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাসহ আশপাশের এলাকায়ও ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের ইনচার্জ রুবাইয়াত কবির আমার দেশকে বলেন, শুক্রবারের ভূমিকম্পটি মাঝারি মাত্রার হলেও এমন প্রচণ্ড ঝাঁকুনির ভূমিকম্প দেশবাসী আর কখনো দেখেনি। গত তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প ছিল এটি।
পুরান ঢাকায় নিহতরা হলো-রাফিউল ইসলাম (২০), হাজী আবদুর রহিম (৪৮) ও তার ছেলে মেহরাব হোসেন (১২)। এছাড়া রাজধানীর মুগদা এলাকায় একটি নির্মাণাধীন ভবনের রেলিং ভেঙে পড়ে মারা যান মাকসুদ (৫০) নামে একজন নিরাপত্তাকর্মী। তিনি ঘটনাস্থলে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হলে হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত্যু নিশ্চিত করেন চিকিৎসক। নিহতের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলায়।
রাত ১০টার দিকে ঢাকার জেলা প্রাশসক রেজাউল করিম জানান, ভূমিকম্পে ঢাকায় চারজন মারা গেছে।
এছাড়া গাজীপুরের কালীগঞ্জে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তার নাম সুজিৎ দাস (৩৮)। জানা গেছে, কালীগঞ্জের চানখোলা এলাকার সুবুদের বাড়িতে গাছ কাটতে গেলে গাছের উপরে থাকাবস্থায় ভূমিকম্প হয়। তাতে গাছ থেকে পড়ে সুজিতের মৃত্যু হয়। সুজিত নাগরী ইউনিয়নের আড়াগাঁও এলাকার সুখ মোহনের ছেলে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ফাতেমা নামে ১০ মাসের একটি শিশু মারা গেছে। একটি দেয়াল ধসে তার মৃত্যু হয়। এ সময় তার মা কুলসুম বেগম ও প্রতিবেশী জেসমিন আক্তার আহত হন।
নরসিংদীতে নিহতরা হলো-কাজম আলী (৭৫), হাফেজ ওমর ফারুক (৮) ও তার বাবা দেলোয়ার হোসেন উজ্জ্বল, নাসির উদ্দীন (৬৫) এবং ফোরকান মিয়া (৩৫)। নিহতরা সদর, পলাশ ও শিবপুর উপজেলার বাসিন্দা।
পুরান ঢাকায় নিহত রাফিউল ইসলাম স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষার্থী। আবদুর রহিমের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রকোনায়। তিনি পরিবার নিয়ে সুরিটোলা স্কুলের পেছনে ভাড়া বাসায় থাকতেন। একই সময় তার স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেহরাব হোসেনও মারা যায়।
রাতে ঢাকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সালাউদ্দীন আল ওয়াদুদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শুক্রবারের ভূমিকম্পে ঢাকায় মোট ১৪টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রাতে জেলা প্রশাসক জানান, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৩ জন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৯ জন চিকিৎসাধীন। এছাড়া দুর্ঘটনার পরপরই সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। দুর্ঘটনাসম্পর্কিত সার্বিক তথ্য আদান-প্রদানের জন্য জরুরি নিয়ন্ত্রণকক্ষের নম্বরে (০২৪১০৫১০৬৫ ও ০১৭১০০৭১৬৬৭৮) যোগাযোগের জন্য সবার প্রতি বিশেষ অনুরোধ করা হয়েছে।
গতকাল রাতে স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, বর্তমানে ঢাকায় ৫০, গাজীপুরে ১৫৬ এবং নরসিংদীতে ৫৫ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. আবু হোসেন মোহাম্মদ মঈনুল আহসান আমার দেশকে বলেন, আমাদের কাছে এ পর্যন্ত পাঁচজন নিহত হওয়ার তথ্য রয়েছে। ভূমিকম্পে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। আহতদের চিকিৎসায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে জরুরি মেডিকেল টিম কাজ করছে।
আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিতের কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। তিনি বলেন, ভূমিকম্পে আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সব হাসপাতালে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড মাস্টার সাজ্জাদ বলেন, ভূমিকম্পের পর তিনজনের লাশ আনা হয়। পুরান ঢাকা থেকে তাদের লাশ আনা হয়।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, আরমানিটোলার কসাইটুলি এলাকার একটি আটতলা ভবনের পাশের দেয়াল এবং কার্নিশ থেকে ইট ও পলেস্তারা খসে নিচে পড়ে, যেখানে একটি গরুর মাংস বিক্রির দোকান ছিল। সেখানে থাকা ক্রেতা ও পথচারীরা আহত হন। ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় লোকজন তাদের হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তিনজনকেই মৃত ঘোষণা করেন।
বংশাল থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, নিহতরা হলো- রাফিউল, আবদুর রহিম ও তার ছেলে মেহরাব।
পুরান ঢাকার বংশাল এলাকার বাসিন্দা জামাল উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, এমন ভূমিকম্প এর আগে কখনোই দেখিনি। এর মাত্রা যাই হোক, ঝাঁকুনি এতটা প্রবল ছিল যে, বড় বিল্ডিংগুলো দোল খাচ্ছিল। এ সময় আমার মনে হচ্ছিল মৃত্যু সুনিশ্চিত। কিছুক্ষণের মধ্যে শত শত মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে এসে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন।
এদিকে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভূমিকম্পে দেয়াল ধসে ফাতেমা নামে ১০ মাসের একটি শিশু মারা যায়। এ সময় শিশুটির মা কুলসুম বেগমসহ (৩০) দুজন আহত হন। উপজেলার গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের ইসলামবাগের ৫ নম্বর ক্যানেল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
এছাড়া ভূমিকম্পে ঢাকা, নরসিংদী, গাজীপুরে তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ভূমিকম্পে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ জন আহত হয়েছেন। গাজীপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে ২৫২ জন চিকিৎসা নিয়েছেন।
ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল থেকে লাফ দিয়ে গুরুতর আহত হন অন্তত চার শিক্ষার্থী। সব মিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ১০ শিক্ষার্থীর আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
নরসিংদী জেলা হাসপাতালে আসা আহত ৪৫ জনের মধ্যে তিনজনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। নরসিংদীর ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে আহত হয়েছেন ১০ জন।
গাজীপুরে বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানা থেকে নামতে গিয়ে অনেক শ্রমিক আহত হয়েছেন। ভূমিকম্পে আহত হয়ে জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোয় সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৫২ জন ভর্তি হন। তাদের বেশিরভাগই পোশাকশ্রমিক বলে জানা গেছে।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভবনে ফাটল
ভূমিকম্পের কারণে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বেশকিছু ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। এতে রাজধানীর বাসিন্দারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে রাস্তায় নেমে আসেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এরই মধ্যে অনেকে ফাটল ধরা বিভিন্ন ভবনের ছবি প্রকাশ করেছেন। এতে রামপুরার উলন রোডে একটি ভবনের পিলারে ফাটল দেখা গেছে।
এছাড়া বাড্ডা লিংক রোড, দক্ষিণ বাড্ডা, মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক, মহাখালী, বারিধারা, গুলশান-২, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ভবনে ফাটল ধরেছে।
এদিকে, আরমানিটোলার কসাইটুলিতে আটতলা ভবন ধসে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। সদরঘাট ও সিদ্দিকবাজার ফায়ার স্টেশন থেকে দুটি ইউনিট সেখানে যায়। তবে ভবনের কোনো ক্ষতি হয়নি।
সূত্রাপুরের স্বামীবাগে আটতলা একটি ভবন অন্য ভবনের ওপর হেলে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। ফায়ার স্টেশন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। পরে জানা যায়, এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
এছাড়া কলাবাগানের আবেদখালী রোডের একটি সাততলা ভবন হেলে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশন থেকে একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গেছে। সেখানে হতাহতের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

