ব্যাংক ঋণের চড়া সুদে বিনিয়োগে খরা

সৈয়দ মিজানুর রহমান ও রোহান রাজিব
প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ০৬: ১৪

ব্যাংক ঋণের চড়া সুদহারে বেকায়দায় পড়েছেন দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এটি হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা দিয়ে নিয়মিত ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারছেন না ছোট, মাঝারি, বড় খাতের বিনিয়োগকারীরা। অতিরিক্ত সুদ ও বিদ্যুৎ-জ্বালানির বাড়তি মূল্যের কারণে রপ্তানি খাতের নতুন কিছু কারখানাও রুগ্ণ হওয়ার পথে। খরচ বাড়ায় কর্মী ছাঁটাই করে ব্যয় কমিয়ে উৎপাদনের চাকা সচল রাখার চেষ্টায় আছেন তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি আমার দেশকে জানান, এখনই ঋণের সুদহার কমিয়ে আনার সুযোগ নেই। কারণ দেশের অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি । আমরা আশা করছি মূল্যস্ফীতি অন্তত পাঁচ থেকে ছয় শতাংশে নামবে। তখন হয়তো ঋণের সুদ বা ব্যাংক সুদহার কমবে।

বিজ্ঞাপন

যদিও সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির সুফল খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। গত আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত আগস্টে এ হার ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এভাবে মূল্যস্ফীতির কথা বলে চড়া সুদে কেউ ব্যবসা চালাতে পারবে না। আবার মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এভাবে সুদহার বাড়লে গোটা আর্থিক খাতে আরেক দফা বিপর্যয় আসবে। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড পিস স্টাডিজের (সিএসপিএস) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মিজানুর রহমান মনে করেন, মূলত দাতা সংস্থাগুলোর পরামর্শেই বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিসূদহার বাড়ায়। দাতারা যে দৃষ্টিতে দেশের অর্থনীতি দেখেন, তা বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই উল্টো ফল বয়ে আনে। এভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক ঋণের ফাঁদে ফেলে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোকে তাদের আয়ের উৎসে পরিণত করে।

ব্যাংক ঋণের সুদ কত

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট শেষে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ১৫ শতাংশ। যদিও ব্যাংকভেদে এটি ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত ছিল। এর আগে ২০২৪ সালের আগস্ট শেষে গড় সুদহার ছিল ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০২৩ সালের একই সময়ে ছিল ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর ২০২২ সালে ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ।

গত আগস্টে খাতভিত্তিক সবচেয়ে বেশি সুদ ছিল এসএমই খাতে। এ খাতে আগস্টে গড় ঋণ সুদহার ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এরপর বৃহৎ শিল্পে ছিল ১২ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং কৃষি খাতে ১১ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

কোন ব্যাংক বেশি সুদ নিচ্ছে

চলতি বছরের আগস্টে সবচেয়ে বেশি ঋণে সুদ নিয়েছে দুর্বল পদ্মা ব্যাংক। ওই মাসে ব্যাংকটির সুদহার ছিল ১৬ দশমিক ২২ শতাংশ। সিটিজেন ব্যাংক ১৫ দশমিক ১৭ শতাংশ, ন্যাশনাল ১৫ দশমিক ০১ শতাংশ, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ১৪ দশমিক ৫২ শতাংশ, কমিউনিটি ও এনআরবি ব্যাংক ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ এবং মধুমতি ১৪ দশমিক ১৬ শতাংশ, মেঘনা ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। এছাড়া ১৩ থেকে ১৪ শতাংশের নিচে সুদ বা মুনাফা নিচ্ছে আল-আরাফাহ, ফার্স্ট সিকিউরিটি, আইএফআইসি, যমুনা, মার্কেন্টাইল, এনআরবিসি, ওয়ান ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক।

নতুন বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ

উচ্চ সুদের কারণে উদ্যোক্তারা নতুন কোনো বিনিয়োগে যাচ্ছে না। এজন্য বেসরকারি খাতের ঋণও তেমন বাড়ছে না। গত আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে, যা ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন । গত জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ । জুনে ছিল ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে একবার প্রবৃদ্ধি কমে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমেছিল। করোনাভাইরাসের মধ্যেও বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশের ওপর ছিল। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত বছরের জুন শেষে ছিল ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি বোঝার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস (জুলাই-আগস্ট) মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ২৬৪ মিলিয়ন ডলার, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৬২ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বৃদ্ধি মাত্র শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ।

পোশাক উৎপাদনে বাড়তি চাপ

সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ হওয়ায় দেশের গার্মেন্টস উৎপাদনে ব্যয় গড়ে ১ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। নোমান গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার সিফাত হোসেন ফাহিম আমার দেশকে বলেন, তাদের উৎপাদন খরচ গত এক বছরে গড়ে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এ সময় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ব্যাংক ঋণের বাড়তি চাপ পড়েছে উদ্যোক্তাদের ওপর। এর পুরো দায় বিগত দেড় দশকে আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলার। সেই সঙ্গে বর্তমানে দাতা সংস্থাগুলোর বিভিন্ন পরামর্শ উদ্যোক্তাদের একেবারে পথে বসিয়েছে।

পোশাক খাতের রপ্তানির গতি, প্রকৃতি ও আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ে গবেষণা করেন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক ও গার্মেন্টস খাতের উদ্যোক্তা মহিউদ্দিন রুবেল। তিনি আমার দেশকে বলেন, শুধু ব্যাংক ঋণের বাড়তি সুদের কারণে প্রতি পাঁচ ডলারের রপ্তানিতে প্রায় ৭ থেকে ১০ সেন্ট অতিরিক্ত খরচ যোগ হয়েছে। একক পণ্যে এ খরচ কম মনে হলেও মিলিয়ন পিস উৎপাদনের ক্ষেত্রে এর প্রভাব অনেক বড়।

তিনি আরো বলেন, দেশের অনেক গার্মেন্টস কারখানা তাদের কার্যক্রম চালাতে ঋণের ওপর নির্ভর করে। এ ঋণের টাকায় কাঁচামাল যেমন- তুলা, কাপড় ও আনুষঙ্গিক সামগ্রী আমদানি, শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ (রপ্তানি মূল্য আদায়ের আগেই), এবং যন্ত্রপাতি কেনা বা কারখানা সম্প্রসারণের খরচ মেটানো হয়। এ ধরনের ব্যয় সাধারণত স্বল্পমেয়াদি ব্যাংক ঋণ বা কার্যকরি মূলধনের ঋণ থেকে আসে। তাই সুদের হার বাড়লেই অর্থায়নের খরচ বেড়ে যায়।

বিনিয়োগবান্ধব সিদ্ধান্তে হাঁটছে না সরকার

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ জিয়াউর রহমান আমার দেশকে বলেন, বিগত দেড় দশকে আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলার মধ্যেই বর্তমান সরকার কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত উদ্যোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। যেসব বড় কেলেঙ্কারি আর্থিক খাতে হয়েছে, তার কোনোটির বিচার এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে যেসব ব্যবসায়ী পালিয়ে যাননি, তাদের ওপরই নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করছে ব্যাংকগুলো।

তিনি বলেন, এখন দরকার ছিল সরকারের নীতি সহায়তা বাড়িয়ে আর্থিক খাতকে সচল করা, কিন্তু দেখা যাচ্ছে তার উল্টো নীতি। ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়ানো হয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বেড়েছে, বন্দরে কয়েকগুণ শুল্ক বাড়ানো হয়েছে এগুলো মোটেও বিনিয়োগবান্ধব সিদ্ধান্ত নয়। এতে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কাঁচামাল বা যন্ত্রাংশ আমদানির পরিকল্পনা স্থগিত বা বাতিল করেছে।

মুনাফার চেয়ে সুদহার বেশি

ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) জানিয়েছে, দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তারা ব্যবসার মুনাফা পান সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১১ শতাংশ, কিন্তু তারা ব্যাংক ঋণের সুদ দিচ্ছেন ১৪ থেকে সাড়ে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত। এতে বাড়তি সুদ গুনতে পুঁজি চলে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় এফবিসিসিআইয়ের একটি প্রতিনিধিদল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে । তারা সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার দাবি জানান।

বিদেশি বিনিয়োগেও বড় পতন

রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ না আসার পেছনে আরেকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, চড়া সুদের কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) এফডিআই আগের প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় ৬২ শতাংশ কমে গেছে। যদিও প্রথম প্রান্তিকে আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধি দেখা গিয়েছিল, দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিনিয়োগ হঠাৎ করেই তলানিতে নেমে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান আমার দেশকে বলেন, কিছু ব্যাংক অনিয়মের কারণে তারল্য সংকটে ভুগছে। সংকট কাটাতে এসব ব্যাংক চড়া সুদহারে আমানত সংগ্রহ করছে। এজন্য ঋণে দেওয়ার ক্ষেত্রে অধিক সুদ নিচ্ছে। আবার কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। এসব ব্যাংক তাদের প্রভিশন সংরক্ষণের জন্য অধিক সুদ চার্জ করছে। এ কারণেই ব্যাংক ঋণের সুদহার ঊর্ধ্বমুখী।

রপ্তানি খাতে প্রতিযোগী দেশে সুদহার কত

তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, চামড়াসহ অন্যান্য খাতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বের প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে আছে পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম ও চীন। এসব দেশের মধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদহার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ব্যবসার বিনিয়োগে ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ। যেমন-পাকিস্তানে গড় সুদহার সাড়ে ৮ শতাংশ, ভারতে ৯ থেকে ১২ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১৩ শতাংশ, ভিয়েতনামে সবচেয়ে কম ৬ থেকে ৭ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক ঋণের চড়া সুদহার দীর্ঘমেয়াদি চলতে থাকলে অনেক উদ্যোক্তাকেই পথে বসতে হবে। সেই সঙ্গে নতুন বিনিয়োগ আসবে না, চাকরির মন্দা বাজারে আরো বিপর্যয় তৈরি হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত