সরকারের নানা উদ্যোগেও নাখোশ জুলাইযোদ্ধারা

মাহমুদুল হাসান আশিক
প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০: ১৯

স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালানোর পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর তিনি ঘোষণা দেন, গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। আহত সবার চিকিৎসার ব্যয় বহন করবে সরকার। সে লক্ষ্যে পরে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়।

এরপর শহীদ পরিবার, আহত জুলাইযোদ্ধাদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসায় নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ। এতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম। তবে গৃহীত উদ্যোগ অপ্রতুল দাবি করে নিজেদের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন শহীদ পরিবারের সদস্য ও জুলাইযোদ্ধারা।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২৪ সালের ১২ ডিসেম্বর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতদের কল্যাণ এবং যাবতীয় বিষয়ের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওপর। এজন্য ২০২৫ সালের ২৮ এপ্রিল প্রতিষ্ঠা করা হয় জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ৮৪৪ জন শহীদ এবং আহত হওয়ার ধরন অনুযায়ী তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করে ১৩ হাজার ৮০০ জুলাইযোদ্ধার গেজেট প্রকাশ করা হয়। সবশেষে গেজেটভুক্ত শহীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৩৬ জন। আহত হওয়ার ধরন অনুযায়ী করা তিনটি শ্রেণি ক, খ ও গ-তে শ্রেণিভুক্ত রয়েছেন যথাক্রমে ৬০২, ১ হাজার ১১৮ এবং ১২ হাজার ৮০ জন জুলাইযোদ্ধা।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন

গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ৮১৯ জনের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা করে মোট ৪০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। আহত ৫ হাজার ৯৪৪ জনকে ৭১ কোটি ২০ লাখ ২৬ হাজার ৬৫৫ টাকা সহায়তা করেছে সংস্থাটি।

অর্থ সহায়তার পাশাপাশি শহীদ পরিবার ও জুলাইযোদ্ধাদের পুনর্বাসনে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের পুনর্বাসনে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া কোনো কোনো পরিবারকে দেওয়া হয়েছে গরু, কাউকে দেওয়া হয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসার পুঁজি এবং কেউ পেয়েছেন অটোরিকশা।

শহীদ পরিবার ও আহত জুলাইযোদ্ধাদের চিকিৎসা সহায়তা নিশ্চিতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে ফাউন্ডেশনটি। ২৪ ঘণ্টা সশরীরে, অনলাইনে ও মুঠোফোনে কল করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারে আহত যোদ্ধা ও শহীদ পরিবার। দেওয়া হয় বিনামূল্যে ওষুধসহ চিকিৎসাসামগ্রীও। চোখের সমস্যায় ভোগা জুলাইযোদ্ধাদের জন্য চক্ষু হাসপাতালের পাশাপাশি ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও প্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া ১১টি তফসিলি ব্যাংক নিয়ে তহবিল গঠন করা হয়েছে, যা থেকে জুলাই শহীদ পরিবার ও যোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবাসহ অন্যান্য কাজে সহায়তা করা হবে।

জুলাইযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্যও নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—গণভবনকে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ করা। এছাড়া পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহায়তায় সারা দেশে ‘১ শহীদ, ১ বৃক্ষ’ রোপণ কর্মসূচি পালন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়

প্রথম পর্বে শহীদ পরিবারের কল্যাণে এককালীন ১০ লাখ টাকা করে ৭৭২ পরিবারকে ৭৭ কোটি ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। দ্বিতীয় পর্বে ১০০ পরিবারকে ২০ কোটি ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয়। এছাড়া জুলাইযোদ্ধাদের ১৩০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হয়।

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৪৫০টি শহীদ পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে মোট ৯০ লাখ টাকা ভাতা দেওয়া হয়েছে। জুলাইযোদ্ধাদের ‘ক’ শ্রেণিভুক্তদের ২০ হাজার টাকা, ‘খ’ শ্রেণিভুক্তদের ১৫ হাজার টাকা ও ‘গ’ শ্রেণিভুক্তদের ১০ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে।

গণঅভ্যুত্থানে আহত যোদ্ধাদের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব সরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া চলমান থাকবে। এর মধ্যে উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে ৭৮ জুলাইযোদ্ধাকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে।

জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের পুনর্বাসনে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন মোট ৪৪৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা খরচ করেছে।

জুলাই গণহত্যার বিচার

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে। পাশাপাশি স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার শাসনামলে হওয়া গুম-খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারও এই ট্রাইব্যুনালে করা হচ্ছে। তবে ট্রাইব্যুনালে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে জুলাই গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। এ বিচার কার্যক্রম গতিশীল করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করেছে সরকার। এখন পর্যন্ত ৪৫০টি অভিযোগ, ৩০টি মিস কেস ও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের হয়েছে চার মামলায়। এর মধ্য থেকে দুটি মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান। প্রথমটিতে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনকে আসামি করে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। ইতোমধ্যে ৮১ জন সাক্ষীর মধ্য থেকে ৩৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। অপরটিতে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২৮ আগস্ট তার বাবা মকবুল হোসেনসহ বেশ কয়েকজন সাক্ষ্য দিয়েছেন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজমকে একাধিকবার কল করা হলেও তা রিসিভ হয়নি। তবে এ বিষয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, শহীদ এবং আহতদের জন্য সরকারের গৃহীত কর্মসূচি যে ধারায় বর্তমান অবস্থায় যাচ্ছে, তাতে আমি ব্যক্তিগতভাবে সন্তুষ্ট। কিন্তু আরো বেশি দ্রুত হলে ভালো হতো। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে (চেতনা) ধারণ করেই আমাদের রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে—এই বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে চাই। আমরা আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অভিযাত্রা শুরু করেছি।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কামাল আকবর বলেন, সরকার এখন পর্যন্ত অর্থসহায়তা, ভাতা চালু ও চিকিৎসাসেবাসহ যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা সন্তোষজনক। তবে ভবিষ্যতে সব মন্ত্রণালয় যদি পুনর্বাসনের জন্য এগিয়ে আসে এবং চিকিৎসাসেবায় জুলাইযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার দেয় সেটি আরো ভালো হবে।

এ বিষয়ে শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তি আমার দেশকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে আসামিদের জামিন হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা আশা করেছি তারা (সরকার) শক্তপোক্তভাবে বিচারকার্য শুরু করবে। বিচার তাদের প্রাইম ডিউটি ছিল। সেখানে আমরা আশানুরূপ ফলাফল পাইনি। আমরা দেখিনি যে ইন্টেরিম শক্তপোক্তভাবে বিচারের যে ভার সেটি হাতে নিয়েছে। কারণ এখন পর্যন্ত আমরা দৃশ্যমান কোনো কিছু দেখিনি।

আহত জুলাইযোদ্ধাদের চিকিৎসায় অবহেলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শহীদদের যদি জাতীয় বীর বলা হয়, আহতরাও অবশ্যই জাতীয় বীর। এই বীরদের সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ সরকারের তরফ থেকে করা হচ্ছে না। তারা স্বাস্থ্য খাতে অবশ্যই ব্যর্থ হয়েছে। দেশের প্রয়োজনে যারা ঝাঁপিয়ে পড়ল, এতদিন পরে এখন তাদের নার্ভ শুকিয়ে যাচ্ছে, হাত কেটে ফেলতে হচ্ছে, পা কেটে ফেলতে হচ্ছে। প্রথম দিন থেকেই যদি তারা সঠিক চিকিৎসা পেত তাহলে এমনটি হতো না।

গত বছরের ১৯ জুলাই উত্তরায় জুমার নামাজের সময় গুলি চালানো বন্ধ রাখতে পুলিশের কাছাকাছি গিয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়া জুলাইযোদ্ধা রাইসুর রহমান রাতুল বলেন, আজ জুলাই বিপ্লবের কত মাস? এখনো শহীদ ও আহত পরিবার অবহেলিত হচ্ছে। আমাদের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে না। শোনা হচ্ছে না আমাদের সমস্যার কথা। রীতিমতো আমাদের নিয়ে জুলাই ব্যবসা করা হচ্ছে। প্রচার করা হচ্ছে আমরা ভালো আছি। কিন্তু আদৌ কি ভালো আছি? আমরা সুচিকিৎসা ও সুরক্ষা পাচ্ছি না। পাশে থাকার মতো কেউ নেই। সব উপদেষ্টা ও দায়িত্বরতরা প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাসের গেম খেলছে। আমরা আহত ও শহীদ পরিবার হতাশ।

ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আইআরআই প্রতিনিধি দলের বৈঠক

শুক্র-শনিবারও চলবে বিমানবন্দরের শুল্কায়ন কার্যক্রম

প্রধান উপদেষ্টার আদেশে জুলাই সনদের আইনি রূপ দিতে হবে

নভেম্বরের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা শুরুর দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি

আইআরআই’র সঙ্গে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা এনসিপির

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত