বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিতে জালিয়াতির আশঙ্কা

ব্যাংকক দূতাবাসের ইমেইল হ্যাকড, দানা বাঁধছে রহস্য

পীর জুবায়ের
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯: ২৬
আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০: ০২
ছবি: সংগৃহীত

থাইল্যান্ডস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কল্যাণ উইংয়ের ইমেইল আইডি হ্যাক হয়েছে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর এটি হ্যাক হয়। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নিয়ে দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম) ফাহাদ পারভেজ বসুনিয়া ঘটনার তিনদিন পর অর্থাৎ ১৭ সেপ্টেম্বর দূতাবাস থেকে বিষয়টি জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোকে (বিএমইটি) চিঠির মাধ্যমে জানান।

এই চিঠিতে ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে যদি কোনো কাগজপত্র সত্যায়ন করা হয়ে থাকে তবে তা বাতিলের অনুরোধ করা হয়। ইমেইল হ্যাক হওয়ার পর তাৎক্ষণিক ও যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়ায় সমালোচনা শুরু হয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে।

বিজ্ঞাপন

বিএমইটি সূত্র ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি সংক্রান্ত বিষয়াদি দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে থাইল্যান্ডস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কল্যাণ উইং। ফলে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দপ্তর। এর ইমেইল হ্যাক হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার উচিত ছিল তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু তিনি তা না করে অপেশাদার ও শিশুশুলভ আচরণ করেছেন। কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন তিনদিন পর। ফলে এ ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সুতরাং ঘটনাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তদন্ত করলে প্রকৃত তথ্য বের হয়ে আসবে।

বিএমইটিতে ‘শ্রম উইংয়ের দাপ্তরিক ইমেইল হ্যাক করে প্রেরিত জাল সত্যায়ন বাতিল প্রসঙ্গে’ শিরোনামে দূতাবাসের শ্রম কল্যাণ উইংয়ের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, থাইল্যান্ডের শ্রম কল্যাণ উইংয়ের দাপ্তরিক ই-মেইলে গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ঢোকা যাচ্ছে না। বিষয়টি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রোগ্রামার আসফাককে মোবাইল ফোনে অবহিত করে নতুন পাসওয়ার্ড প্রেরণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। প্রোগ্রামার আসফাক ১৭ সেপ্টেম্বর দাপ্তরিক ইমেইলের জন্য একটি নতুন পাসওয়ার্ড প্রেরণ করেন। ইতোমধ্যে সেই পাসওয়ার্ডটিও রিসেট করা হয়েছে।

চিঠিতে আরো বলা হয়, গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে দূতাবাসের দাপ্তরিক ইমেইল হ্যাক করে বিভিন্ন স্মারকে বিএমইটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বরাবর বেশকিছু ইমেইল পাঠানো হয়েছে। যার সবই জাল। জালিয়াতচক্র দূতাবাসের দাপ্তরিক ইমেইল মাঝেমাঝেই হ্যাক করে আগেও বিএমইটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বরাবর বেশকিছু ইমেইল পাঠিয়েছে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। এর আগের সত্যায়ন সংক্রান্ত বিএমইটিতে প্রেরিত জাল ইমেইলসমূহও শ্রম কল্যাণ উইং থেকে যাচাই-বাছাইয়ের কার্যক্রম চলমান।

আরো বলা হয়, জালিয়াতচক্র দূতাবাসের দাপ্তরিক ইমেইল ব্যবহার করার পর ইমেইলের সেন্ট অপশন থেকে ইমেইলগুলো ডিলিট করে ফেলেছে। ফলে এই জালিয়াতির বিষয়টি শ্রম উইং থেকে উদঘাটন করা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ইমেইল থেকে পাঠানো সব ইমেইল বাতিল করে এসব মেইলের আলোকে বিএমইটি থেকে কোনো ধরনের স্মার্ট কার্ড ইস্যু না করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

এই চিঠি আসার পর থেকেই সমালোচনার ঝড় বইছে বিএমইটিতে। সংস্থাটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এমনিতেই সংস্থাটির দুর্নীতি নিয়ে সম্প্রতি নানা নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হওয়ায় কর্মকর্তারা বিব্রত। এমন পরিস্থিতিতে এই ইমেইল হ্যাকের ঘটনা ঘটল, যা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে।

বিএমইটি সূত্র জানায়, সাধারণত শ্রম উইং থেকে সত্যায়নের মেইল পেলে বিএমইটি বহির্গমন ছাড়পত্র দিয়ে দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা দেওয়া হয় সত্যায়ন নিশ্চিতের ১ থেকে ২ দিনের মধ্যে। তাহলে ধরা যায়, মেইল হ্যাক হয়ে যেসব সত্যায়ন হওয়া নথি এসেছে সেগুলোর ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। আর এখানে বিএমইটির দায় নেই। কারণ হ্যাক যদি হয়ে থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বুঝতে এত সময় লাগবে কেন? আবার এটাও বলা হচ্ছে মাঝে মধ্যে হতে পারে। সুতরাং বিষয়টি রহস্যজনক।

বিএমইটির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে জানান, ফাহাদ পারভেজ বসুনিয়া দীর্ঘদিন ধরে থাইল্যান্ডস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কল্যাণ উইংয়ে কর্মরত থাকার সুযোগে বিএমইটির একজন প্রভাবশালী এডিজি এবং একজন সহকারী পরিচালকের সঙ্গে মিলে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। মেইল হ্যাকের নাটকের পেছনে রয়েছে এই সিন্ডিকেট। ভালো করে তদন্ত করলে পুরো বিষয় বের হয়ে আসবে।

হ্যাকিংয়ের বিষয়ে পাঠানো চিঠিতে যে ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিঠিতে লেবার কাউন্সেলর যেসব শব্দ চয়ন করেছেন তা রহস্যজনক। চিঠিতে বলা হয়েছে ‘জালিয়াতচক্র দূতাবাসের দাপ্তরিক ইমেইল মাঝেমাঝেই হ্যাক করে এর আগেও বিএমইটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বরাবর বেশকিছু ইমেইল প্রেরণ করেছে বলে ধারণা করা যাচ্ছে’। একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যদি এমন কথা বলেন, তাহলে বুঝে নিতে হবে এখানে কোনো রহস্য রয়েছে। তার এ বক্তব্য দায়িত্বহীনতারই নমুনা। এভাবে যদি দূতাবাসের দাপ্তরিক ইমেইল মাঝেমধ্যেই হ্যাক হয় তাহলে গুরুত্বপূর্ণ নথি এবং স্পর্শকাতর তথ্য পাচার যে হয়নি তার নিশ্চয়তা কি?

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একটি ফাইল সত্যায়ন করতে সরকারি ফি নেওয়া হয় ৩০ ডলার বা প্রায় চার হাজার টাকা। অতীতেও যদি ইমেইল হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র নেওয়া হয়ে থাকে তাহলে সরকার বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের দাবি, এরকম স্পর্শকাতর ইস্যু তৃতীয় পক্ষ দিয়ে তদন্ত করা হোক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়টি তদন্ত করানো যায়। তারা তাদের অধীনস্থ কোনো গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে এ তদন্ত করতে পারে। তাহলে এ ইমেইল হ্যাকিংয়ের পেছনের ঘটনা বের হয়ে আসবে।

ইমেইল হ্যাক, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জালিয়াতি, দায়িত্বে গাফিলতির মতো অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে চাইলে ব্যাংককস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কল্যাণ উইংয়ের কাউন্সেলর (শ্রম) ফাহাদ পারভেজ বসুনিয়া আমার দেশকে বলেন, মেইল হ্যাকের বিষয়টি বুঝতে পেরে আমি বিএমইটিকে অবগত করেছি। ইমেইল হ্যাকের পেছনে জড়িত একটি অসাধু চক্র। তারা চায় আমাদের এই খাতটি বিতর্কিত হোক।

ইমেইল হ্যাকের পেছনে সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমিই যদি করতাম তাহলে কি আমি কর্তৃপক্ষকে অবগত করতাম?

মাঝেমধ্যে এই ইমেইল হ্যাক হওয়া নিয়ে চিঠিতে যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, আমি বলিনি হয়েছে, বলেছি হতে পারে। পরবর্তী বিষয় বিএমইটি দেখবে।

ইমেইল হ্যাকের বিষয়ে কোনো তদন্ত করা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ব্যাংককস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের এই কর্মকর্তা বলেন, আমি চিঠি পাঠিয়েছি হ্যাক হয়ে যেগুলো মেইল গেছে সেগুলোর সত্যায়ন বাতিল করার জন্য। এখন বিএমইটি সবকিছু দেখে ব্যবস্থা নেবে।

ইমেইল হ্যাকের ঘটনায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি, কর্মসংস্থান) আব্দুল হাই আমার দেশকে বলেন, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সময়ের পার্থক্য প্রায় দুই ঘণ্টার। এখন শ্রম কাউন্সেলর চিঠিতে বলেছেন, ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আসা মেইলগুলো বাতিল হিসেবে ধরার জন্য। কিন্তু সময়ের পার্থক্য হওয়ায় আমরা বুঝতে পারছি না কোন সময় থেকে কোন সময় পর্যন্ত তিনি বলছেন। আমাদের যে মেইল করা হয়েছে সেগুলো আমরা শ্রম কাউন্সেলর বরাবর পাঠিয়েছি। যাতে তিনি বুঝতে পারেন কোন মেইল সঠিক এবং কোন মেই হ্যাক হয়ে আসছে। তিনি তা নিশ্চিত করলে আমরা ব্যবস্থা নেব।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির আমার দেশকে বলেন, ইমেইল হ্যাকের বিষয়টি হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল জায়গা থেকে বিষয়টি বুঝতে তিন দিন সময় লাগার কথা নয়। এটি আমাদের জন্য ভয়াবহ বার্তা বহন করে। ইমেইল রক্ষণাবেক্ষণে কর্মকর্তার গাফিলতি অপেশাদার আচরণ। তাছাড়া যে ভাষায় তিনি চিঠি লিখেছেন তা অপেশাদার ও শিশুশুলভ। বিষয়টি সরকারের গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। তৃতীয় মাধ্যম অর্থাৎ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে এই বিষয় খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দিতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের কিছু ঘটতে পারে।

ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আইআরআই প্রতিনিধি দলের বৈঠক

শুক্র-শনিবারও চলবে বিমানবন্দরের শুল্কায়ন কার্যক্রম

প্রধান উপদেষ্টার আদেশে জুলাই সনদের আইনি রূপ দিতে হবে

নভেম্বরের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা শুরুর দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি

আইআরআই’র সঙ্গে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা এনসিপির

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত