নির্বাচনি সরঞ্জাম পরিবহনে থাকবে জিপিএস ট্র্যাকিং

গাজী শাহনেওয়াজ
প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৫, ১০: ০১

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট ডাকাতি বন্ধসহ ভোটে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারি বাড়াতে মনোযোগী নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ লক্ষ্যে নির্বাচনি সামগ্রী পরিবহনে বিশেষ করে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স পরিবহনকারী বাহনের অবস্থান শনাক্তে কাজে লাগানো হবে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) ট্র্যাকিং পদ্ধতি। পথে সন্ত্রাসীদের কবল থেকে নির্বাচনি মালামাল লুট ঠেকাতে মূলত কমিশন ওই ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়ার চিন্তা করছে।

বিজ্ঞাপন

শুধু এই প্রযুক্তিই নয়, বরং ভোট তদারকির জন্য আরো ছয় ধরনের স্পর্শকাতর পদ্ধতিকে আগামী নির্বাচনে কাজে লাগাতে তৎপর ইসি। এ ক্ষেত্রে বেশকিছু সুবিধা-অসুবিধা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে কমিশনকে, যা ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এগুলোর মধ্যে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় গোপন ক্যামেরা (সিসিটিভি) স্থাপন এবং প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় সহকারী রিটার্নিং অফিসারের অধীনে পর্যবেক্ষণ টিম গঠন করে ভোটের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা, সংবেদনশীল ভোটকেন্দ্রে আকাশপথে সরাসরি পর্যবেক্ষণের জন্য ড্রোনের ব্যবহার, ভোটকেন্দ্র পরিচালনাকারী প্রিসাইডিং অফিসারদের ভোটের গতিবিধি অতিগোপনে পর্যবেক্ষণ, তদারকি করা ও সরাসরি লাইভ টেলিকাস্ট করার জন্য তাদের (প্রিসাইডিং অফিসার) কাছে বডিক্যাম সরবরাহ (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও ভোট পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বডিক্যাম দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে)।

এ ছাড়া লাইভ ভোট ডেটা পর্যবেক্ষণের জন্য ‘কপট’ অ্যাপের সহায়তা নিয়ে উন্নত প্রযুক্তির সংমিশ্রণ ঘটানো এবং প্রকৃত (রিয়েল টাইম) নির্বাচনি ফলাফল ও ভোটের অনিয়ম শনাক্ত করা, ভোটারদের দ্বারা ছবি-ভিডিওসহ ভোটের গোপন কক্ষের প্রকৃত চিত্র পর্যবেক্ষণ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ভোটের অনিয়মের প্রতিবেদন প্রদানে মোবাইল অ্যাপ চালু করা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে অনলাইন গুজব, বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য, ভুল তথ্য শনাক্ত ও প্রতিরোধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার ঘটানো।

এসব কাজের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহ্নত করা। আগামী সংসদ নির্বাচনে ৪৫ হাজার ৯৮টি ভোটকেন্দ্র চূড়ান্ত হয়েছে। এসব কেন্দ্রে সিসিটিভি স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় অবকাঠামোগত সমস্যা ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংকট প্রকট রয়েছে। এর বিকল্প হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সম্পন্ন করে এর আলোকে সৌরবিদ্যুৎ বা জেনারেটরের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার চিন্তা করছে ইসি। ভোট শুরু থেকে গণনা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত যাতে সিসিটিভি এক মুহূর্তের জন্যও সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়, সে জন্য ইসি ওই পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। আগামী অক্টোবরের মধ্যে এ বিষয়ে সার্বিক কার্যক্রম সম্পন্ন করবে ইসি।

সংবেদনশীল ভোটকেন্দ্রগুলো আকাশপথে ড্রোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বা ভুল ব্যবহারে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের আশঙ্কা রয়েছে বলে কমিশন সংশ্লিষ্টদের কাছে চিহ্নিত হয়েছে। এর অপব্যবহার রোধে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে শুধু পূর্বঘোষিত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সীমিত রাখার চিন্তা করছে কমিশন।

জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ব্যালট পরিবহনের ক্ষেত্রে উচ্চ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত কার্যকারিতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। এ ইস্যুতে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে কমিশন কর্তৃক নির্বাচিত শহরাঞ্চলে পাইলট প্রকল্প অথবা বিকল্প হিসেবে চেক-ইন প্রটোকল ব্যবহার করে পথে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স ছিনতাই প্রতিরোধ করার চিন্তা করছে কমিশন। কারণ, গত দশম সংসদ নির্বাচনে পথে ব্যালট ছিনতাই হয় এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগের দিন রাতে ভোট হয়ে যায়।

আর ভোটারদের ভোটদানে বাধা এবং একজনের ভোট অন্যজনের মাধ্যমে সম্পন্ন করার রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ভোটের অনিয়ম ভোটাররা ইসির মনোনীত মোবাইল অ্যাপে প্রতিবেদন আকারে তুলে ধরতে পারবেন। নির্বাচন কমিশন ভোটারদের এ ধরনের স্বাধীনতা দিলেও সেটির যাতে অপপ্রয়োগ না ঘটে, সে জন্য এআইভিত্তিক মডারেশনের মাধ্যমে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে যাচাই কমিটি গঠন করা হচ্ছে।

এদিকে, বিগত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের অপবাদ ও অপসংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছে সরকার। এ উপলক্ষে আগামী ১৩তম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গণতন্ত্রে ফিরতে ডিজিটাল মাধ্যমে ছড়ানো ভুল তথ্য, রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বনকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে ইসি। এআইর অপব্যবহার রোধে পাঁচ ধরনের কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে ইসি।

এর মধ্যে বহুপক্ষীয় মনিটরিং সেল গঠন, তাৎক্ষণিক কনটেন্ট মডারেশন, যেমন—এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘৃণামূলক ভাষা, গুজব ও সমন্বিত বট কার্যক্রম শনাক্ত করা, ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্ব সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করা এবং ডেমোক্রেসি ড্যাশবোর্ডে প্রকাশ করা, যাতে জনগণ তাৎক্ষণিকভাবে সত্যতা জানতে পারে।

এ ছাড়া আছে ডিজিটাল সাক্ষরতা কর্মসূচি গ্রহণ এবং প্ল্যাটফর্ম সমন্বয় করা (যেমন— মেটা, গুগল, টিকটকসহ আন্তর্জাতিক সামাজিকমাধ্যম), প্রতিষ্ঠানগুলোর আঞ্চলিক অফিসের সঙ্গে সমন্বয় করে দ্রুত কনটেন্ট রিভিউ প্রক্রিয়া চালু এবং প্রার্থী, প্রতিষ্ঠান বা জাতিগত গোষ্ঠীকে লক্ষ করে ভাইরাল হওয়া ভুল তথ্য মোকাবিলায় একটি র‌্যাপিড রেসপন্স প্রটোকল গঠন করা।

এ প্রসঙ্গে গত সোমবার নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, আগামী নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করে মিথ্যাচার বা অপপ্রচার চালালে শুধু প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলেই নয়, গণমাধ্যমও শাস্তির মুখে পড়বে। একইসঙ্গে নারীদের লক্ষ করে সাইবার বুলিং রোধে আচরণবিধিতে নতুন ধারা যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বিধান রাখা হয়েছে।

এর আগে সিইসি এএমএম নাসির উদ্দীন এআইয়ের অপব্যবহার একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত