ভয়াল ৪ আগস্ট

ফেনীতে ৭ হত্যাসহ ২২ মামলার সব রাঘববোয়ালই অধরা

এস এম ইউসুফ আলী, ফেনী
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০৫: ২৮
আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ০০

স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের দাবিতে গতবছরের ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফেনীর মহিপাল উড়ালসেতুর নিচে সাতজনকে হত্যা করে আ.লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা হলেন, ফুলগাজীর ইশতিয়াক আহম্মেদ শ্রাবণ, দাগনভূঞার সারওয়ার জাহান মাসুদ, সোনাগাজীর মাহবুবুল হাসান মাসুম, জাকির হোসেন শাকিব, ফেনী সদরের সাইদুল ইসলাম, ওয়াকিল আহম্মেদ শিহাব, পৌর এলাকার মোহাম্মদ সবুজ।

বিজ্ঞাপন

এসময় দাগনভূঞার তাজিম উদ্দিন, নাসির উদ্দীন, ফেনী সদরের মহিউদ্দিন, আবু জাফর, পৌর এলাকার বাহার মিয়া, আবদুর রব, জগলু মিয়া রিয়াজ, সোনাগাজীর বোরহান উদ্দিন, আফসার হোসাইন, সাইদুল রহমান, আসিফুল ইসলাম আহাদ, জামশেদুল আলম, এনামুল হক, ছাগলনাইয়ার ফরহাদ হোসেন, কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের আবদুল হান্নানসহ অন্তত দেড়শতাধিক ছাত্র-জনতাকে হত্যা চেষ্টা চালিয়েছে।

ওইদিনের ঘটনায় ৭ হত্যাসহ ২২ মামলার ৬ হাজার ১৯৯ জন আসামির সব রাঘববোয়ালই এখনও অধরা রয়ে গেছে। এ নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ জানিয়েছেন শহীদদের বাবা ও মায়েরা।

সেদিন রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো মহিপাল এলাকা। আহত ও নিহতদের ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান আন্দোলনের সহযোদ্ধারা। হাসপাতালের সব ডাক্তার চলে আসেন জরুরি বিভাগে। হাসপাতালের প্রত্যক্ষদর্শী সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. তরিকুজ্জামান বলেন, ৪ আগস্ট আমরা সকালে ডিউটিতে ছিলাম। আমি, সাজ্জাদ ও আলো দিদি। বেলা আনুমানিক সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার দিকে হঠাৎ রোগী আসা শুরু করলো। যেগুলো ছিল গানশট ইনজুরি। প্রথমে মনে করেছিলাম গণ্ডগোল পর্যায়ের কিছু রোগী। কিন্তু এরপর থেকে আসা শুরু করলো সব স্টুডেন্ট। গোটা জরুরি বিভাগের চেহারা পাল্টে গেছে। ইমার্জেন্সিতে শুধু রক্ত আর রক্ত। কেউ নিয়ে আসছে ডেড বডি, কেউ নিয়ে আসছে আহতদের। এখানে পা ফেলার জায়গা ছিলো না। যে যেভাবে পেরেছি সেবা দিয়েছি। সব ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ডাক্তাররা ছুটে এসেছিলেন। সিনিয়র নার্স, ওয়ার্ড থেকে হেল্পিং নার্সরা এসেছিলেন সেবা দিতে। সবাই মিলেই সেবা দিয়েছি।

মেডিকেল অফিসার নাজমুল হক সাম্মি বলেন, ৪ আগস্ট ছিল পীড়াদায়ক। ডাক্তার হিসেবে এ অবস্থা আমরা ফেইস করেছি। কী বিপজ্জনক অবস্থা ছিলো ইমারজেন্সি রুমের! ঠিক দুপুরে খবর এলো গুলিবিদ্ধ কিছু রোগী আসছে, সবাই প্রস্তুত হয়ে যান। নার্স-ডাক্তার যে যেভাবে ছিলেন সবাই প্রস্তুত হয়ে থাকেন। আমরা প্রস্তুত হলাম। দুপুর একটার দিকে একটার পর একটা রোগী আসতে লাগলো। প্রতিটি রোগীর ক্রিটিক্যাল অবস্থা। বিশেষ করে ব্লিডিং বেশি ছিলো বলে আমরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম।

জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ওই ঘটনায় মোট ২২টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ৭টি হত্যা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টা। এসব মামলায় ২ হাজার ১৯৯ জন এজাহারনামীয় ও আরও ৪ হাজার অজ্ঞাত আসামি রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় সব কয়টিতে ফেনী-২ আসনের সাবেক সাংসদ নিজাম হাজারীকে এবং বেশ কয়েকটিতে ফেনী-১ আসনের সাবেক সাংসদ আলাউদ্দিন আহমেদ নাসিম ও ফেনী-৩ আসনের সাবেক সাংসদ মাসুদ উদ্দিনকে এবং ১টি হত্যাকাণ্ডে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে আসামি করা হয়েছে।

এসব মামলায় উল্লেখযোগ্য অন্য আসামিরা হলেন, ফেনী সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীল, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী, ছাগলনাইয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল, দাগনভূঞা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সভাপতি দিদারুল কবির রতন, পরশুরাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার সাবেক মেয়র নিজাম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সাজেল, সোনাগাজী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন, যুবলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম পিটু, জিয়া উদ্দিন বাবলু প্রমুখ।

আন্দোলনে শহীদ শ্রাবণের পিতা নেছার আহম্মদ হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অনেক আসামি দেশের বাইরে চলে গেছে। আবার অনেকে দেশে থাকা সত্ত্বেও এখনো আইনের আওতায় আসেনি। বিচার নিশ্চিত না হলে আমাদের হাজারো সন্তানের রক্ত ও আত্মত্যাগ বৃথা যাবে। কোটি কোটি টাকা বা অট্টালিকা আমরা চাই না। সন্তানের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারই একমাত্র চাওয়া।আমাদের এখন আর কোনো আনন্দ নেই।

শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার শিউলি বলেন, ৪ আগস্টের পর থেকে সব আনন্দ চলে গেছে। আমাদের গোছানো একটা জীবন অগোছালো হয়ে গেছে। জীবনের সব আনন্দ ওইদিনই শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু সুষ্ঠু একটি বিচারই আমাদের চাওয়া। এজাহারনামীয় আসামিরা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড় বড় আসামিরা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে।

একাধিক হত্যা মামলার আইনজীবী মেজবা উদ্দিন ভুঞা বলেন, গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার অবস্থান কর্মসূচিতে নির্বিচারে গুলি করে অস্ত্রধারীরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি ও সিসি টিভি ফুটেজে দেখা গেছে, অস্ত্রধারীরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। কিন্তু এসব মামলার ৬১৯৯ আসামির সব রাঘববোয়ালরা এখনও অধরাই রয়ে গেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফেনীর পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ১ হাজারের বেশি আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১১ জন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে একটি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত