গ্রামের চেয়ে আক্রান্তের হার শহরে ২১ গুণ

এমরানা আহমেদ
প্রকাশ : ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১১: ২২

দেশে অটিজমে (জন্মগত স্নায়ুবিক দুর্বলতা) আক্রান্তের উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া গেছে। শহরে ৩ শতাংশ শিশুর এ সমস্যা রয়েছে। গ্রামে পরিস্থিতি এখনো সে পর্যায়ে যায়নি। তবে গড়ে প্রতি ৭০০-এর মধ্যে একটি শিশু অটিজমে ভুগছে। অর্থাৎ গ্রামের চেয়ে শহরে বিশেষ এ বৈশিষ্ট্যের শিশু শনাক্তের হার ২১ গুণ। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজমের (ইপনা) জরিপের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে এসেছে। তবে দেশে এখন কত শিশু এ সমস্যায় ভুগছে তা স্পষ্ট নয়।

বিজ্ঞাপন

চিকিৎসকরা বলছেন, অটিজম হচ্ছে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা। বিশেষজ্ঞরা একে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার বা এএসডি বলেন। শিশুর জন্মের প্রথম তিন বছরের মধ্যে এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ ধরনের শিশুর বাইরের জগৎ সম্পর্কে আগ্রহ কম থাকে। বিশেষ করে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন বা অন্য ব্যক্তির প্রতি আগ্রহ না থাকা। কে কী করছে, তা নিয়ে কৌতূহল না থাকা। অন্যের আচরণ বুঝতে না পারা। কথা বলতে না শেখা। কোনোমতে কথা বলতে পারলেও অন্যের সঙ্গে আলাপচারিতা করতে সমর্থ না হওয়া। পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করে। অর্থাৎ একই কাজ বারবার করা। বাংলাদেশে অটিজম আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

সরেজমিনে বিএমইউ শিশু নিউরোলজি বিভাগে দেখা গেছে, হাসপাতালটির এই বিভাগে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ অটিজমে আক্রান্ত শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে। সে হিসাবে নতুন-পুরোনো মিলিয়ে প্রতি মাসে ৩০ হাজারেরও বেশি অটিজমে আক্রান্ত শিশু সেখানে সেবা নিচ্ছে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলমান প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ বলছে, ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা প্রায় ৮৬ হাজার ১৪২। এর মধ্যে ছেলে ৫২ হাজার ৮৩৮ ও মেয়ে ৩৩ হাজার ২৫০। এ ছাড়া হিজড়া সম্প্রদায়ের রয়েছে ৫৪ জন। অর্থাৎ অটিজম শনাক্তদের ৬১ দশমিক ৩৩ শতাংশই পুরুষ।

দেশে প্রতি ৫৮৯ শিশুর মধ্যে একজন অটিজমে (জন্মগত স্নায়ুবিক দুর্বলতা) আক্রান্ত। প্রতি ৪২৩টি ছেলে শিশুর মধ্যে একটি এবং ১ হাজার ২৬ মেয়ে শিশুর মধ্যে অটিজমে আক্রান্ত হচ্ছে একজন। মেয়ের তুলনায় ছেলে শিশু আক্রান্ত হচ্ছে আড়াইগুণ। শহরে প্রতি ১০ হাজারে ২৫ এবং গ্রামে প্রতি ১০ হাজারে ১৪টি শিশু অটিজমে আক্রান্ত হচ্ছে। ইপনার সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। দেশের আট বিভাগের ৩০ জেলায় ৩৭ হাজার ৯৪২ বাড়িতে ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সি ১ লাখ ৮৬ হাজার ৬৮ শিশুর ওপর এ জরিপ চলে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, গড়ে প্রতি ১২৫ শিশুর মধ্যে ১টি অটিজমের উপসর্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। অটিজমের নির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এর একাধিক কারণ রয়েছে। একটি শিশুর অটিজমের বৈশিষ্ট্য থাকবে কি না, তা জিনের মধ্যে নির্ধারণ করা থাকে। পরিবেশ যদি তার প্রতিকূলে থাকে সেটার জন্যও অটিজম দেখা দিতে পারে। কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশু কিংবা গর্ভাবস্থায় যে মায়েদের পুষ্টিহীনতা থাকে সেই গর্ভের শিশুদেরও অটিজমের ঝুঁকি থাকে।

ডিজঅ্যাবল্ড চাইল্ড ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাসরিন জাহান বলেন, অটিজম নিয়ে সমাজে যে নেতিবাচক ধারণা ছিল তা অনেকটাই কেটে গেছে। এরপরও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের এই শিশুদের অধিকাংশই থাকছে চিকিৎসা বা শিক্ষার বাইরে। এ ক্ষেত্রে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু এ ধরনের শিশুর সঠিক বিকাশ হচ্ছে কি না, তা খেয়াল রাখা জরুরি। সে বিষয়ে সংশয় দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। পাঁচ বছর বয়সের পর মস্তিষ্কের বিকাশ সম্পূর্ণ হয়, তখন অনেক সমস্যা সমাধানের বাইরে চলে যায়। জন্মের দেড় থেকে তিন বছরের মধ্যে লক্ষণ চিহ্নিত করে অটিজম শনাক্ত করা গেলে ৯০ শতাংশকেই স্বাভাবিক জীবনে রাখা সম্ভব।

ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজমের ট্রেনিং কোঅর্ডিনেটর ডা. মাজহারুল মান্নান বলেন, যদি কোনো শিশু আ, উ শব্দ না করে, মুখ থেকে একটানা লালা পড়ে অথবা মা যদি শিশুর মুখ দেখে বুঝতে পারেন যে শিশুর কোনো একটি ঘাটতি আছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিতে হবে। এরপর থেকেই নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এটাই ওই শিশুর চিকিৎসার অংশ।

তিনি আরো বলেন, একটি শিশু দেড় মাস বয়সে প্রথম মায়ের দিকে তাকিয়ে বড় করে হাসি দেয়, কিন্তু ছয় মাসের মধ্যেও যদি কোনো শিশু এটা না করে, তাহলে সেই শিশুকে লাল পতাকা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। ছয় মাস বয়সে একটি শিশু বাবলিং (বাববাব্বা) শব্দ করে। এক বছরের মধ্যে যদি শিশুর কোনো বাবলিং সাউন্ড না আসে এবং শিশুটি যদি তার প্রয়োজন আঙুল দিয়ে নির্দেশ না করে তাহলে এটিকেও লাল পতাকা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।

ডা. মাজহারুল বলেন, এক বছরের শিশু একটু একটু কথা বলে। যেমন- বাবা, দাদা ও মামা। কিন্তু দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে যদি একটি শিশু এ শব্দগুলো না বলতে পারে এবং দুই বছরের একটি শিশু যদি দুই শব্দকে একসঙ্গে বলতে না পারে তাহলে ওই শিশু লাল পতাকা চিহ্নিত হবে। এ ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

অটিজমের কারণ প্রসঙ্গে বিএমইউর সহকারী অধ্যাপক ডা. সানজিদা আহমেদ বলেন, নারীদের গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, জ্বর এবং সঙ্গে র‌্যাশ হলে, শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থাকলে গর্ভস্থ শিশু অটিজমের শিকার হতে পারে। এ ছাড়া চল্লিশোর্ধ্ব নারী সন্তান ধারণ করলে এবং পরিবেশগত কারণে শিশু অটিজমের শিকার হতে পারে। তবে এটি কোনো রোগ নয়, শিশুর জন্মগত স্নায়ুবিক দুর্বলতা। জন্মের দুই থেকে তিন বছর বয়সের মধ্যে এটি দেখা দিতে পারে।

তিনি আরো বলেন, অটিজমের বৈশিষ্ট্য থাকা শিশুদের লক্ষণ ও উপসর্গের মাত্রা বিচিত্র। তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসাও নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাদের স্পিচ থেরাপি, কাউন্সিলিংসহ বিভিন্ন সেবা দেওয়া হয়। এতে তারা অনেকে সুস্থ হয়ে ওঠে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ জানান, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এরই মধ্যে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্ষমতায়ন ও অন্তর্ভুক্তির জন্য বহুমুখী কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি অটিজম ও এনডিডি সেবাদান কেন্দ্র স্থাপন, বাবা-মা-অভিভাবক ও শিক্ষকদের শিশুদের যত্ন ও পরিচর্যা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্যে দক্ষতা কার্যক্রম প্রশিক্ষণ দেওয়া, আর্থিক চিকিৎসা সহায়তা হিসেবে অনুদান, ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র স্থাপন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভাতা ও উপবৃত্তি প্রদান, প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদদের জন্য শহীদ ফারহান ফাইয়াজ খেলার মাঠ তৈরি, আট বিভাগে আবাসন এবং শিক্ষা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ উল্লেখযোগ্য।

বিষয়:

অটিজম
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত