ব্যতিক্রমী স্বস্তির ঈদ এবার

রকীবুল হক
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৫, ১০: ৫২

বিদায়ের পথে মাহে রমজান। সবার দুয়ারে কড়া নাড়ছে ঈদের অনাবিল আনন্দ। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপনে প্রস্তুত বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্ব। আজ দেশের আকাশে শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলে কাল সোমবার উদযাপিত হবে এই ঈদ। আর আজ চাঁদের দেখা না মিললে ঈদ হবে মঙ্গলবার। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুথানে দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দুঃশাসনমুক্ত পরিবেশে এবার বাংলাদেশের মানুষ ভিন্ন আমেজে নতুন উদ্দীপনায় ব্যতিক্রমী ঈদ উদযাপন করবেন। রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে, পাড়া-মহল্লায়, রাস্তাঘাটে সর্বত্রই বিরাজ করছে স্বস্তিময় ঈদের প্রকৃত এক আবহ। কষ্টের সাগরে ডুবে থাকা জুলাই বিপ্লবে শহীদ পরিবার এবং আহতদের মধ্যেও ঈদের আনন্দ পৌঁছতে নানাভাবে সহায়তা করছে বিভিন্ন মহল।

সোমবার ঈদ হওয়ার সম্ভাবনা ধরে নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছেন দেশবাসী। শাওয়ালের চাঁদ দেখার খবর শোনার পর সর্বত্র বেজে উঠবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই ঐতিহ্যবাহী ও হৃদয়গ্রাহী গান ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...।’ পাড়ায়-মহল্লায় মসজিদের মাইকে ভেসে আসবে ঈদ মোবারক ধ্বনি। ঈদের দিন সকালে সবার সাধ্যমতো নতুন জামাকাপড় পরে ঈদগাহ বা মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়েই মূলত ঈদ পর্ব শুরু হবে। ঈদের নামাজ শেষে ধনী-গরিব, ছোট-বড় ভেদাভেদ ভুলে কোলাকুলি করবেন সবাই।

বিজ্ঞাপন

দেশের প্রধান ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় ঈদগাহে সকাল সাড়ে ৮টায়। আর আবহাওয়া প্রতিকূল হলে প্রধান জামাত সকাল ৯টায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে আয়োজন করা হবে। ঈদ জামাতের জন্য জাতীয় ঈদগাহ প্রাঙ্গণে ব্যাপক সাজসজ্জা ও বিশেষ নিরাপত্তাসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বায়তুল মোকাররমে সকাল ৭টা থেকে পৌনে ১১টা পর্যন্ত পাঁচটি ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হবে। ঈদ জামাতের জন্য রাজধানীসহ সারাদেশের সব ঈদগাহ সজ্জিত করা হয়েছে।

ঈদুল ফিতরের আনন্দ উদযাপনের প্রস্তুতি শুরু হয় বেশ আগে থেকেই। দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনমুক্ত দেশে এবার ঈদের সার্বিক প্রস্তুতি চলছে বেশ স্বস্তিময় পরিবেশে। অন্য সময়ের মতো এবারের রমজানে দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং ছিল না। ফুটপাথ-মার্কেটগুলোতে এবার চাঁদাবাজদের দাপটও ছিল তুলনামূলক কম। রমজানে নিত্যপণ্যের দাম সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় ছিল অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। ঈদ মার্কেটেও বাড়তি দাম নিয়ন্ত্রণে তৎপর ছিল ভোক্তা অধিকারসহ বিভিন্ন সংস্থা। ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর যানজট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ছিল ট্রাফিক পুলিশ। চাকরিজীবীরা অনেকটা সময়মতোই বেতন-বোনাস পেয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে বেতন-বোনাসের দাবিতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনে নামতে দেখা গেলেও ব্যাপকতা আগের বছরগুলোর তুলনায় ছিল সীমিত। প্রবাসীরাও তাদের স্বজনদের জন্য দেশে রেকর্ড পরিমান রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিও বেশ চাঙা। তাই এবার মানুষ বেশ স্বস্তির সঙ্গে সাধ্যমতো ঈদের কেনাকাটা করেছেন। ঈদের বাজার ছিল বেশ সরগরম।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি মার্চের প্রথম ২৬ দিনে দেশে রেকর্ড ২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮২ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স এলো দেশে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঈদুল ফিতরের কারণে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছে।

মা-বাবা ও স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে কর্মজীবী মানুষ ছুটে চলেছেন গ্রামের বাড়িতে। সরকারি চাকরিজীবীরা এবার টানা ৯ দিনের ছুটি পেয়েছেন। বেসরকারি কর্মজীবীদের অনেকে বাড়তি ছুটি নিয়ে শহর ছেড়ে নিজ এলাকায় যাচ্ছেন। এরই মধ্যে প্রায় সবাই নিজ গন্তব্যে পৌঁছেছেন। অনেকে এখন রাস্তাঘাটে বাড়ির পথে আছেন। ব্যস্ততম রাজধানী ঢাকা এখন অনেকটাই ফাঁকা। অন্যবারের চেয়ে এবারের ঈদযাত্রা বেশ স্বস্তিময় হচ্ছে বলে যাত্রীরা জানিয়েছেন। পবিত্র রমজানে এবার স্কুল-কলেজ সব বন্ধ ছিল। তাই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকেই তাদের সুযোগ-সুবিধামতো কেনাকাটা ও গ্রামের বাড়িতে পৌঁছিয়েছেন।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সরকারের উদ্যোগ ছিল বলেই ঈদযাত্রায় স্বস্তি এসেছে। ঈদের পর নিরাপদে যাতে ঢাকায় মানুষ ফিরতে পারেন সে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ঈদ যাত্রায় যারা অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কোনো ধরনের নাশকতার হুমকি নেই। কোনো হুমকি থাকলে সেটা সবাইকে নিয়ে মোকাবিলা করা হবে। জনগণ ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করলে কেউ নাশকতা করতে পারবে না। শনিবার সকালে রাজধানীর গাবতলী টার্মিনাল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।

নতুন জামা-কাপড় ছাড়া ঈদ উদযাপন যেন পূর্ণ হয় না। তাই তো সন্তানসন্ততি ও পরিবার-পরিজনের জন্য শেষ মুহূর্তের কেনাকাটায় ব্যস্ত সবাই। শুধু জামা-কাপড় নয়, ঈদের দিন ভালোমন্দ খাওয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন সবাই। সেজন্য সেমাই, পোলাও-কোরমাসহ নানা পদের রান্নার আয়োজন চলছে ঘরে ঘরে। নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি পাড়া-প্রতিবেশীকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবেন অনেকে। ঈদ উপলক্ষে বিয়েসহ বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানেরও ধুম পড়ে যায়।

ঈদের আনন্দ সবার মাঝে ভাগাভাগি করে নিতে গরিবদের মধ্যে সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন সবাই। সামর্থ্যবানরা জাকাত-ফিতরা আদায় করেন। অনেকে আবার গরিবদের মধ্যে নতুন জামা-কাপড় ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেন। বিত্তবানদের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে এসব সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। জানা গেছে, আমিরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানের নির্দেশে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সময়ে সব বীর শহীদ এবং জুলাই বিপ্লবের শহীদ পরিবারের কাছে ঈদ উপহার পৌঁছানো হয়েছে।

দীর্ঘ ১৬ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের পতনের পর এবার বেশ মুক্ত পরিবেশে শঙ্কামুক্তভাবে ঈদ উদযাপন করবেন রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে গণসংযোগের সুযোগ কাজে লাগাতে সম্ভাব্য প্রার্থী এবং দলীয় শীর্ষনেতাদের অনেকেই এবার ঈদ করবেন নিজ এলাকায়। এরই মধ্যে এলাকাবাসীর মধ্যে জাকাত বিতরণসহ নানা উপহার সামগ্রী দিয়েছেন নেতারা। ঈদের দিন শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন তারা। তাই সারাদেশে এবার ঈদ উৎসবের ভিন্ন আমেজ দেখা যাবে।

যদিও জুলাই বিপ্লবে খুনসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগে পতিত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপি এবার কারাগারে ঈদ করবেন। অনেকে আত্মগোপনে আছেন। পাশাপাশি ফ্যাসিস্ট আমলে দায়ের করা বানোয়াট মামলায়ও অনেকে এখনো কারারুদ্ধ আছেন। তাদেরও ঈদ কাটবে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্টে।

এবারের স্বস্তিময় ঈদ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক প্রফেসর ড. মুহা. হাছানাত আলী আমার দেশকে বলেন, নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবার স্বস্তিময় ঈদের নজির স্থাপন করছে। প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত এবং ব্যক্তিস্বার্থ না থাকলে ঈদযাত্রা ও বাজারের কেনাকাটা কতটা স্বস্তিময় হতে পারে তার নজির এবার পাওয়া গেছে। নির্বিঘ্নে ঈদযাত্রা, দ্রব্যমূল্য না বাড়া সামগ্রিকভাবে মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট একটা ঈদ হতে যাচ্ছে এবার। বাংলাদেশে বহুদিন পর এ ধরনের বাধাহীন ও আনন্দময় ঈদ জাতি উদযাপনের সুযোগ পাচ্ছে।

তিনি বলেন, আগামী দিনে যারা ক্ষমতায় আসবে তাদের এবারের ঈদ থেকে শিক্ষা নিয়ে আরো ভালো পরিবেশ যাতে হয়, পেছনে যেন না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একই সঙ্গে রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, সেজন্য চালকদের সতর্কতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং ঈদের সময় ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে কেউ যাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য সজাগ এবং আস্থা বজায় রাখতে সংশ্লিষ্টদের আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ আমার দেশকে বলেন, দীর্ঘ বন্দিজীবন থেকে মুক্ত পরিবেশে বিএনপি ও সারাদেশের মানুষ এবারের ঈদুল ফিতর উদযাপন করবে। ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের মানুষকে এমনভাবে বন্দি করেছে যে, কেউ স্বাধীনভাবে পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পারেনি। ১৫ বছরে কেউ জেলখানায়, কেউ আত্মগোপনে, কেউ পরিবারের প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ঈদ উদযাপন করেছে। এবার শেখ হাসিনামুক্ত বাংলাদেশে আমরা বাধাহীন ঈদ উদযাপন করব।

পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এছাড়া শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম, খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক ও মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদসহ বিভিন্ন দলের নেতারা।

জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান তার বাণীতে বলেন, জাতি এমন এক মুহূর্তে ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে যাচ্ছে, যখন দেশ ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করেছে। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা জালিমের হাত থেকে মুক্ত হয়ে দেশের মানুষ মুক্ত পরিবেশে শ্বাস নিতে পারছে। দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে এবং শান্তি-স্বস্তিতে চলাফেরা করতে পারছে।

তবে বিদেশে পালিয়ে থাকা ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার তাদের দোসরদের দিয়ে দেশে নানাভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করে দেশবিরোধী সব অপতৎপরতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।

পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে ঈদ র‌্যালি বের করা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান র‌্যালিতে নেতৃত্ব দেবেন। সকাল ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ মসজিদুল জামিআ’য় ঈদুল ফিতরের প্রথম জামাতের পর র‌্যালি শুরু হবে।

এদিকে ঈদ ঘিরে রাজধানীসহ দেশের বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ঈদের ছুটির দিনগুলোতে অনেকেই সপরিবারে বিনোদনকেন্দ্রে ভিড় করবেন।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

ঈদুল ফিতর
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত