ইরানের প্রতিরোধ যুদ্ধ ও বিশ্বরাজনীতি

শাহজাদা সাজ্জাদ
প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৫, ০৯: ২২

নতুন শতকের কূটনীতি ও যুদ্ধনীতি আজ আর পুরোনো সংজ্ঞায় বাঁধা থাকছে না। প্রযুক্তিনির্ভর, বহুপক্ষীয় ও অর্থনৈতিক স্বার্থে আচ্ছন্ন এই নতুন ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্য যেন হয়ে উঠেছে এক জ্বলন্ত পরীক্ষাগার, যেখানে প্রতিনিয়ত পরীক্ষিত হচ্ছে শক্তির ভারসাম্য, প্রতিরক্ষা কৌশল ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের স্থায়িত্ব। সম্প্রতি সংঘটিত ইরান-ইসরাইল দ্বন্দ্ব সেই বাস্তবতারই এক অনিবার্য বহিঃপ্রকাশ।

মাত্র ১২ দিনের লড়াই, কিন্তু তার অভিঘাত কেবল দুই দেশের সীমায় আবদ্ধ নয়; বরং এতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে আমেরিকা, ইউরোপীয় শক্তি, এমনকি আরব বিশ্বেরও নানা দেশ। যুদ্ধের শেষে আপাতত কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি কেবল অস্ত্রের নিস্তব্ধতা নয়, বরং এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে প্রতিটি পক্ষ নিজেদের লাভ-লোকসান হিসাব করছে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে।

বিজ্ঞাপন

শুধু যুদ্ধের সামরিক বা কৌশলগত বিশ্লেষণ নয়, বরং এর ভূরাজনৈতিক প্রভাব, অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাস, কূটনৈতিক চতুরতা এবং ভবিষ্যৎ যুদ্ধনীতি সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি তুলে ধরতে চেষ্টা করলে তবেই বোঝা যাবে—কে হেরেছে, কে জিতেছে?

কিছুটা আঞ্চলিক, কিছুটা রাজনৈতিক, আবার অনেকটাই বাস্তবতানির্ভর চিন্তা করতে গেলে ট্রাম্পের নোবেলপ্রত্যাশা থেকে শুরু করে ইরানের আত্মবিশ্বাস, ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষার সীমাবদ্ধতা এবং বিশ্বব্যাপী নিউক্লিয়ার সাম্য রচনার আকাঙ্ক্ষা—সবকিছুই এক সূত্রে গাঁথা। তাই এই যুদ্ধ-উত্তর মূল্যায়ন হতে পারে আমাদের এই সময়ের এক বিস্ময়কর রাজনৈতিক পাঠ, যেখানে প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র একটি বার্তা, প্রতিটি কূটনৈতিক বিবৃতি এক নতুন মোড় এবং প্রতিটি নীরবতা এক গোপন চুক্তির ইঙ্গিত বহন করেছে।

১২ দিন লড়াই করার পর ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের সমাপ্তি হলো আপাতত যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে। এই যুদ্ধে ইরান একা লড়াই চালিয়ে গেলেও ইসরাইলের পক্ষে ছিল আমেরিকা, ইউরোপ থেকে শুরু করে আরব বিশ্বের দেশগুলোও। নীরবতাই যেখানে সম্মতির লক্ষণ, সেখানে আরবরা যুদ্ধের শুরু থেকে নীরব থেকে আর গত রাতে কাতারের উদেইদ বিমানঘাঁটিতে হামলা করার পর ইরানের নিন্দা করে বিবৃতি দিয়ে ইসরাইলের পক্ষ নিয়েছে—এতে কোনো সন্দেহ নেই।

এই যুদ্ধে কার কী লাভ হলো, কে কী বুঝে নেবে? শুরুতেই কোনোমতে একটা সিজফায়ারের ব্যবস্থা করে নোবেল পাওয়ার রাস্তাটা আরেকটু পরিষ্কার করলেন ট্রাম্প। ট্রাম্প নোবেল পাবেন কি পাবেন না, সেটা সময়ের ওপর ছেড়ে দিলেও ট্রাম্প যে এ বিষয়ে সিরিয়াস তা যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের ফিল্ড মার্শাল আসিফ মুনিরকে ডেকে নিয়ে আপ্যায়ন করা ও পাকিস্তানকে দিয়ে বিবৃতি দেওয়ানোর মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়েছে।

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা বাডি কার্টার এই পুরস্কারের জন্য ট্রাম্পকে মনোনীত করেছেন।

অন্যদিকে তেল আবিব পুনর্গঠনের কাজ পাবেন ট্রাম্প। আমেরিকায় ইহুদি লবিস্টদের কাছ থেকে এখন বিপুল পরিমাণ অর্থ পাবে ইসরাইল সরকার। ক্ষতিগ্রস্ত সমরাস্ত্র ও আবাসন কাঠামোর মেরামত করা হবে এসবের আওতায়। এদিকে ইরান মেরামতের কাজ নেবে চীন। তারাও একইভাবে ইরানে ধ্বংস হওয়া পাওয়ার প্ল্যান্ট, তেল শোধনাগার ও অস্ত্রশস্ত্রের কাজ নেবে।

মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে আবারও ইউরোপিয়ান আর আমেরিকানদের দেদার অস্ত্র বিক্রি শুরু হবে। ইসরাইলের এয়ার ডিফেন্স ফাঁকি দেওয়াসহ একযোগে গালফের একাধিক দেশে মিসাইল মেরে ইরান তার মিসাইলের সক্ষমতা দেখিয়ে এখন স্বস্তিতে। এদিকে আমেরিকা তাদের বিমানঘাঁটিতে ইরানের মিসাইল অ্যাটাকের পরেও কোনো রিটালিয়েশনে না গিয়েই যুদ্ধবিরতি কার্যকর করেছে।

ইরান যেভাবে একাই দাঁড়িয়ে গিয়ে সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়ে গেছে, তা পশ্চিমাদের দম্ভে আঘাত হেনেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর ক্ষমতা ও মিডিয়া প্রচারণায় আপাতদৃষ্টিতে এটাকে একটি যুদ্ধবিরতি মনে হলেও কার্যত এই যুদ্ধে জয়ী ইরান। বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর ট্যাংক-মর্টার যুদ্ধ বাদ দিয়ে শুধু মিসাইল, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও ড্রোন দিয়েই একটা যুদ্ধে যে এমন ফলাফল এনেছে, তাতে ভবিষ্যৎ যুদ্ধের চিত্রই বদলে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের অন্তরালে এক আশ্চর্য কূটনৈতিক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, যার প্রতিটি পদক্ষেপের আড়ালে ছিল চরম সতর্কতা, নিঃশব্দ বার্তা, আর রাজনৈতিক কৌশলের সূক্ষ্ম বুনন। আমেরিকা একদিকে প্রকাশ্যে ইসরাইলের পাশে দাঁড়ালেও অন্যদিকে গোপনে আরব দেশগুলোর নেতাদের ফোন করে জানিয়েছে, ইরানে তাদের রেজিম চেঞ্জ করার কোনো অপারেশনের আগ্রহ নেই। একই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে তেহরানেও—ইরান আক্রমণের অব্যবহিত পরেই। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে, এই হামলা ছিল এককালীন, কোনো বৃহৎ যুদ্ধের সূচনা নয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেও বলেছেন, সামরিক বাহিনীর কাজ শেষ, তাদের আর প্রয়োজন নেই। তবে শান্তি ফিরে না এলে আবার ‘প্রিসাইস অ্যাটাক’-এ ফিরে আসবে তারা। এসবই ইঙ্গিত দেয়, ট্রাম্প কোনো দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চান না—এটি রাজনৈতিকভাবে তার জন্য সম্ভবও নয়।

ট্রাম্প পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে যেভাবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গ্রহণ করেছেন, তা নজিরবিহীন। এর পেছনে নিছক সৌজন্য নয়, বরং একটি কৌশলগত বার্তা লুকিয়ে রয়েছে—বিশ্বের একমাত্র মুসলিম নিউক্লিয়ার শক্তিধর রাষ্ট্রকে সময়মতো সতর্ক করে দেওয়া। ট্রাম্প হয়তো সরাসরি জানাননি কবে আক্রমণ হবে, তবে সম্ভবত ইঙ্গিত দিয়েছেন, আমেরিকার আক্রমণের সময় যেন পাকিস্তান ইরানের পাশে না দাঁড়ায়। এত বড় বার্তা না থাকলে এমন একটি অস্বাভাবিক বৈঠক নিছক কাকতালীয় বলে মেনে নেওয়া কঠিন।

অন্যদিকে আমেরিকার বিশ্লেষকেরা জানাচ্ছেন, ইস্পাহান বোমিংয়ের সময় যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে তিনটি স্থাপনায় আক্রমণ করেনি, কারণ সেগুলোর নিচে ছিল পারমাণবিক রিয়্যাক্টর। একইসঙ্গে ইরানও কাতার ও আমেরিকাকে আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছে, তাদের ঘাঁটিতে আক্রমণের পরিকল্পনা রয়েছে এবং তা শুধু প্রতীকী, ব্যাপক ধ্বংসের উদ্দেশ্যে নয়। পুরো ঘটনার ওপর ছায়ার মতো লেগে রয়েছে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রভাব। অনেক দল এই যুদ্ধে নেমেছে কেবল নিজেদের অনুসারীদের কাছে নিজেদের অবস্থান প্রমাণের জন্য—এটি একটি ‘পলিটিক্যাল থিয়েটার’। ইরান যতই ভয় দেখাক, ততোধিক সতর্কভাবে ট্রাম্পকে অনুরোধ করেছে যুদ্ধ থামাতে। অন্যদিকে ইসরাইল চাপ প্রয়োগ করেছে ট্রাম্পের ওপর; কিন্তু ট্রাম্পের রাজনৈতিক ঘাঁটি যেহেতু যুদ্ধ চায় না, তাই তিনি খুব সংক্ষিপ্ত ও কৌশলগত যুদ্ধেই ইতি টেনেছেন।

এখন প্রশ্ন, ইরান আগামী ক’বছরে পরমাণু অস্ত্র বানাতে পারবে কি না? পুরো মধ্যপ্রাচ্য এখন সেই প্রস্তুতিতেই আছে—কারো কারো লক্ষ্য নিজস্ব উন্নয়ন, আবার কেউ নগদ টাকায় কিনে নেবে। কে আগে যুদ্ধ থামাতে বলেছে, সেটাই বড় প্রশ্ন নয়—প্রশ্ন হলো, সবাই যুদ্ধ থামাতে চাচ্ছে এবং খুব দ্রুতই। এই সংঘাতের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি মেধাক্রমে ভাগ করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসরাইল, তারপর আমেরিকা এবং সবশেষে ইরান। ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্র নির্মাণে যেখানে সময় লেগেছিল চার বছর, সেই সময়েই ভারত ও পাকিস্তানও বানিয়েছিল। এবার ইরান, এমনকি অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্য দেশও সেই পথেই হাঁটবে। ইসরাইলের একক সামরিক শক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে তাদের জনগণের কাছেই। অনেকেই তাদের স্বদেশে ফিরে যেতে চাইবেন। এখন ইসরাইলে বসবাসকারী ২০ লাখ রুশ বংশোদ্ভূত ছাড়া বাকিরা হয়তো দেশ ছেড়ে চলে যাবেন, বিনিয়োগ তুলে নেবেন; ফলে ইসরাইল এক ভয়াবহ মেধা ও পুঁজির সংকটে পড়বে।

ইরানের পরমাণু অস্ত্র হাতে পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। ভবিষ্যতে তারা ৫০০ ফুট মাটির নিচে রিয়্যাক্টর বসাবে, কারণ এবার তারা জেনে গেছে, আমেরিকার বোমার কতটুকু গভীরে পৌঁছানোর ক্ষমতা রয়েছে। আমেরিকা কখনো এমন বোমা এর আগে ব্যবহার করেনি। ইরানের জন্যও এই যুদ্ধ ছিল এক বড় আর্থিক আঘাত। অনেক সিনিয়র নেতা ও বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়েছে। ফলে নেতৃত্বে দেখা দেবে সংকট। উপরন্তু ইসরাইলি গুপ্তচরদের চিহ্নিত করতে গিয়ে সমাজে অভ্যন্তরীণ অবিশ্বাস ও বিভাজন আরো বাড়বে—ইরানে শুরু হবে ‘ইন্টারনাল ব্লিডিং’। এই যুদ্ধের পুরোটা সময় পর্দার আড়ালে ছিল আত্মসংযম, অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্য, কৌশলগত প্রদর্শনী এবং এক নতুন বাস্তবতার জন্ম—যেখানে পরমাণু অস্ত্রই হয়ে উঠেছে শেষ অবলম্বন।

বিষয়:

মতামত
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত