নেছারাবাদে ভাসমান কাঠের হাট

গোলাম মোস্তফা, নেছারাবাদ (পিরোজপুর)
প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৫, ১৩: ৪৬

দেশের কাঠ ব্যবসার সর্ববৃহৎ মোকাম হিসেবে পরিচিত পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলা। এখানকার এই কাঠের ব্যবসার ঐতিহ্য প্রায় ৩৫০ বছরের।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার সোহাগদলের ষজুরুদ্দিন, কুড়িয়ানার বিষ্ণুপ্রসাদ ও দ্বারকানাথ এবং বিন্না গ্রামের ব্রজগোপাল ১৬৯৩ সালে সুন্দরবনের সুন্দরী ও বার্মার বার্মাটিক কাঠ নিয়ে এলাকাভিত্তিক কাঠুরিয়াদের মাধ্যমে প্রথম ব্যবসা শুরু করেন।

এরশাদ সরকার ১৯৮৭ সালে ফরেস্ট অ্যাক্ট-১৯২৭ সংশোধন করে সুন্দরবনের পরিবেশ ও বনজ সম্পদ রক্ষায় সুন্দরী গাছ কাটার পারমিট ও নিলাম বন্ধ করে দেয়। আগা-মরা সুন্দরী গাছের নিলামও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সুন্দরবনেই সুন্দরী গাছসহ নানা ধরনের কোটি কোটি টাকার গাছ মাটিতে দেবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

খুলনা বিভাগীয় বন সংরক্ষক দপ্তর সূত্রে জানা যায়, পারমিট বন্ধ হওয়ায় প্রতি বছর প্রায় ২৪ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। আবার আধুনিক সভ্যতায় সুন্দরবনের গোলপাতার ব্যবহার প্রায় বিলীন, এসব নানা প্রতিকূলতায় নেছারাবাদসহ দক্ষিণাঞ্চলের বাওয়ালীদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ছে।

১৯৯৯ সালে মেহগনি, চাম্বল, রেইনট্রি, গামারি, শিমুল, আকাশবেলা, আকাশমনি, কাঠবাদামসহ বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় গাছ সুন্দরবনের গাছের অবস্থান দখল করে নেয়।

২০০৩ সালে সন্ধ্যা নদী সংলগ্ন নেছারাবাদ সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের খালেরচর, শীতলা খাল, বরছাকাঠি কালিবাড়ি খালচর, বয়ারউলা, ডুবি, চামী, ভাইজোড়া, মাহামুদকাঠি, বিন্না, একতা, নাওয়ারাসহ পর্যায়ক্রমে এসব স্থানে ২৬টি ভাসমান কাঠের চরের হাট গড়ে উঠে। নেছারাবাদেও প্রায় সহস্রাধিক শ্রমজীবী মানুষ পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে কাঠের ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে।

পিরোজপুর জেলা বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের সূত্রমতে ‘বরিশাল, খুলনা, চাঁদপুর, বাগেরহাট, মুলাদী, মুন্সীগঞ্জ, যশোর, ঝিনাইদহ, নোয়াখালী, ফরিদপুর, বাগেরহাট ও হবিগঞ্জসহ দেশের ৬৪টি জেলার প্রায় তিন কোটি মানুষ এখনো নেছারাবাদের এই ভাসমান কাঠের ব্যবসায় জড়িত থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাঠের মোকাম গড়ে তুলছেন।’

নদীপথে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে আসা কাঠ ব্যবসায়ীরা জলদস্যুদের ভয়ে ২৫-৩০টি নৌকার বহরে একসঙ্গে নেছারাবাদের ভাসমান কাঠের মোকামে আসে। বেচাকেনা শেষে, আবার সারিবদ্ধ নৌকাগুলো নদীপথে চলে যায়। স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ী হারুন বলেন, অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা গাছ কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রির আশায় খালের চরে স্তূপ করা হয়।

তিন শতাংশ জায়গার চরভাড়াও গুনতে হয় বছরে প্রায় লাখ টাকা। কাঠ ব্যবসায়ী আড়তদার মতিউর রহমান মৃধা বলেন, সারা বছরই কাঠ ব্যবসার মৌসুম, সপ্তাহের বৃহস্পতি ও সোমবার এ দুদিন গাছ ও কাঠের ভাসমান হাট বসে। হাটে বিপুলসংখ্যক ক্রেতা ও বিক্রেতার সমাগমে কোটি কোটি টাকার কাঠ বেচাকেনা হয়। নেছারাবাদের ভাসমান কাঠের হাট বা চরের হাট থেকেই ট্রাক, ট্রলার ও কার্গোযোগে এসব কাঠ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়ে থাকে।

বরছাকাঠি কাঠের আড়তদার বৃদ্ধ হাসেম আলী জানান, প্রায় ৪১ বছর ধরেই চার ছেলে কাঠ ব্যবসায় জড়িত থেকে তারা এখন স্বাবলম্বী। চরের ভাসমান কাঠ ব্যবসায়ী সেলিম বলেন, কাঠ মোকামের কারণে এখানে অসংখ্য স মিল ও ফার্নিচারসহ কাঠের কুটিরশিল্প গড়ে উঠেছে। তাতে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্পকে আরো প্রসারিত করা সম্ভব।

স্থানীদের অভিযোগ, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, কাঠের চরের হাটে রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা না পাওয়া, দালালচক্রের উৎপাত, নদীপথে জলদস্যুদের আক্রমণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিকল্পিত বনায়ন তৈরি না হওয়াসহ নানা কারণে ঐতিহ্যবাহী এ ব্যবসাটি হুমকির মুখে।

নৌপুলিশ কর্মকর্তা ও নেছারাবাদ থানা ইনচার্জ বনি আমিন বলেন, ভাসমান কাঠের হাটে ডাকাতি, ছিনতাই, দালাল চক্রের উৎপাতসহ কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া আছে। নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, দালালচক্রের উৎপাত, নদীপথে জলদস্যুদের আক্রমণ, প্রতিরোধে আমাদের নৌপুলিশ বাহিনী রয়েছে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত