বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ বছরেও হয়নি ছাত্র সংসদ

মাসুদ রানা, ববি
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ৩৮
আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ৫৯

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে বইছে নির্বাচনি হাওয়া। সেই হাওয়ায় ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসংসদ নির্বাচন। নির্বাচনি এই দৌড়ে এগিয়ে আছে ডাকসু, জাকসু, রাকসু, চকসুর মতো বৃহৎ ক্যাম্পাসের ছাত্রসংসদগুলো। অন্যান্য ক্যাম্পাস যেমন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও শহীদ আবু সাঈদের বেরোবিতেও বইছে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের হাওয়া।

তবে ভিন্নচিত্র দেখা যাচ্ছে দক্ষিণবঙ্গের বাতিঘরখ্যাত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ববি)। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যাপীঠে ১৫ বছরেও হয়নি ছাত্রসংসদ। গত মে মাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দূরত্ব ও দাবি-দাওয়া না মানায় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিদায় ঘটে উপাচার্য শুচিতা শরমিনের । এরপর নতুন ভিসি হিসেবে ১৫ মে যোগ দেন রাবি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম।

বিজ্ঞাপন

যোগদানের ১০ দিন পর তার কাছে ৮২ দফা দাবি দেয় শিক্ষার্থীরা। সেগুলোর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ৪১টি দাবির অন্যতম ছিল দ্রুত সময়ের মধ্যে ছাত্র সংসদ আয়োজন করা। তবে আগের মতো আশ্বাসেই সীমাবদ্ধতা দেখতে পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

বর্তমানে ববিতে উন্নয়ন, আয়তন সম্প্রসারণ ও পরিবহন সংকট নিরসনে তিন দফার আন্দোলন চলমান থাকলেও, সেখানেও ছাত্র সংসদ স্থান পায়নি। সব মিলিয়ে ছাত্র সংসদ ইস্যুতে যেন কার্যত নীরব ববি।

গণভোটের রায় : ৮২ শতাংশ চান ছাত্রসংসদ

গত ২২-২৭ জুলাই ছাত্রসংসদের পক্ষে-বিপক্ষে গণভোটের আয়োজন করে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, ববি শাখা। সেখানে ৮২.২ শতাংশই ছাত্র সংসদের পক্ষে ভোট দেন। বিপক্ষে ভোট দেন মাত্র ১১ শতাংশ। এর প্রেক্ষিতে ছাত্র সংগঠনটি গত ৩ আগস্ট উপাচার্যের কাছে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন।

তাতেও তেমন সাড়া মেলেনি বলে জানান শিক্ষার্থীরা। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর প্রাণের দাবি হলেও তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না প্রশাসনের পক্ষ থেকে, এমনটিই অভিযোগ তাদের।

ছাত্র-সংগঠনের অভিমত

এ বিষয়ে ববি গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সংগঠক অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ভূমিকা সরকার আমার দেশকে বলেন, কিছুদিন আগের গণভোটেই ছাত্র সংসদ নিয়ে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে।

এ বিষয়ে আমরা প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানালেও এখনো দৃশ্যমান কোনো আলাপ দেখিনি, আশা করছি শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবিটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গুরুত্বসহ দেখবে এবং দ্রুত ছাত্র সংসদের রোডম্যাপ দেবে।

ববি সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়, গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং বৈষম্যহীন ক্যাম্পাস গড়তে ছাত্রসংসদ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

আমি মনে করি, ছাত্রসংসদই পারে ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সমস্যার সমাধান এবং অধিকার আদায়ের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তুলতে। যেখানে কোনো শিক্ষার্থী হয়রানির ঘটনা ঘটবে না, আবাসিক হল ও ক্যাম্পাসে কোনো শিক্ষার্থীকে জিম্মি হয়ে থাকতে হবে না।

জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্যাম্পাস ছাত্র-সংসদ নিয়ে ইতিমধ্যে সরগরম হলেও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি দেখছি না আমরা । আমরা চাই, প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ছাত্রসংসদ সংক্রান্ত জটিলতা দূর করে, দ্রুত ছাত্রসংসদ চালুর পদক্ষেপ নেবে।

ছাত্রসংসদ বিষয়ে জানতে চাইলে ববি শাখা ছাত্রদল নেতা ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী মোশাররফ হোসেন আমার দেশকে বলেন, ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি, ছাত্রদল সব সময় শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে তাদের পাশে আছে।

দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের ছাত্রসংসদ প্রয়োজন, তবে আমরা চাই তার আগে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিচার কার্যক্রম নিশ্চিত করতে, ফ্যাসিস্টমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তারপর ছাত্র সংসদের আয়োজন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়কে ফ্যাসিস্টমুক্ত না করলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হবে না। তাই দ্রুত বিচার কার্যক্রম নিশ্চিত করে প্রশাসনের কাছে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের দাবি জানাই।

এ বিষয়ে ববি শাখা শিবিরের সভাপতি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি ছাত্রসংসদ। ছাত্রসংসদের রোডম্যাপ ঘোষণা না হওয়ার পেছনে রয়েছে প্রশাসনের দুর্বলতা এবং জুলাই বিপ্লবকে ধারণ করতে ব্যর্থতা। যা দুঃখজনক। প্রশাসন দ্রুত সময়ের মধ্যে ছাত্রসংসদের রোডম্যাপ ঘোষণা করবে বলে আশা রাখি আমরা।

যা বলছে প্রশাসন

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনার পরিচালক সহযোগী অধ্যাপক সুজন চন্দ্র পাল এ বিষয়ে আমার দেশকে বলেন, শিক্ষার্থীরা আমাকে বিষয়টি জানিয়েছে, আমি উপাচার্যকে অবহিত করেছি, প্রশাসন বিষয়টি আলোচনা করে আইনে সংযুক্ত করে দ্রুত ছাত্র সংসদ চালুর ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করছি।

এ বিষয়ে প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) ড. রাহাত হোসাইন ফয়সাল আমার দেশকে বলেন, ছাত্র সংসদ ইস্যুতে ববি প্রশাসন খুবই পজিটিভ। যেহেতু এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে নেই তাই সরাসরি করা যাচ্ছে না। তবে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে আমরাও সেভাবে করার চিন্তা করছি।

শিক্ষার্থীদের বারবার দাবি জানানোর পর ছাত্র সংসদের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মুহসিন উদ্দিন বলেন, আমি এর অগ্রগতি সম্পর্কে কিছুই জানি না।

আমি জানি, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিন্ডিকেট সভায় ছাত্র-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের রাজনীতি সম্পর্কিত কোনো সংগঠন থাকতে পারবে না এমন একটি বিষয় পাস রয়েছে, তবে এটির কার্যকারিতা নেই সবাই সব করছে, আমরাও কিছু বলছি না।

আইনে ছাত্রসংসদ সংযুক্ত করার উদ্যোগের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি আইনে সংযুক্ত করার কোনো সুযোগ নেই, বিশ্ববিদ্যালয় আইনে এটা থাকবে তাও নেই, থাকতে পারবে না তাও নেই। তবে প্রতিনিধি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট একটি ধারার অধীনে নিয়ে সিন্ডিকেট থেকে একটা নিয়ম করা যেতে পারে। তবে কাজটি সহজ নয়।

উপাচার্যের বক্তব্য

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম বলেন, ছাত্র সংসদ নিয়ে আমি খুবই ইতিবাচক। আমি মনে করি, নির্বাচিত বডি এলে আমার দায়িত্ব অনেক কমে যাবে। তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখান থেকে নেতৃত্ব তৈরি হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ছাত্রসংসদের কথা উল্লেখ নেই, তাই জটিলতা তৈরি হয়েছে।

তবে আমি শুনেছি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় আগাচ্ছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শেষ হলে আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু করব।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত