চট্টগ্রামে চামড়া কিনে লোকসানে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৫, ২২: ২২
আপডেট : ০৭ জুন ২০২৫, ২৩: ২৯

চট্টগ্রামে কোরবানির পশুর চামড়া কিনে বিপাকে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। আশানুরূপ দাম না পেয়ে এবং চামড়া সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় লোকসানের মুখে পড়েছেন তারা। চামড়ার দাম না পাওয়ায় অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাদের দাবি, পতিত সরকার আমলে কয়েক বছর ধরেই নিয়মিত লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। এ বছর চামড়া শিল্প রক্ষায় সরকারের নানামুখী পরিকল্পনার কথা শুনে লাভের আশায় বাজারে এসেছিলেন। কিন্তু সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে এবারো লোকসানে পড়তে হয়েছে তাদের।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম নগরীর সবচেয়ে বড় কাঁচা চামড়ার বাজার আতুরারডিপো। ২৫ থেকে ৩০ জন আড়তদার এই বাজারের বিভিন্ন গুদামে চামড়া কিনছেন দুপুর থেকে। বাজারকে কেন্দ্র করে মুরাদপুর থেকে আমিন জুটমিল পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে চামড়া নিয়ে বসে আছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বেচাকেনা কম। বিভিন্ন পাড়ামহল্লা থেকে চামড়া কিনে এনে বাজারে বিক্রি করতে পারছেন না তারা। কারণ ক্রেতা নেই বাজারে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আড়তদার সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে দিয়েছেন। কাঙ্ক্ষিত দাম তো দূরের কথা, খরচের টাকাও উঠছে না অনেকের। একই চিত্র বহদ্দারহাট ও চৌমুহনী কাঁচা চামড়া বাজারের।

আতুড়ার ডিপো বাজারে ৮৫ পিস চামড়া নিয়ে এসেছেন ফল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সুজন। ২০ বছর ধরে কোরবানির ঈদের দিন চামড়া কিনে বিক্রি করেন এই বাজারে।

তিনি জানান ২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত ভালো লাভ করতেন একদিনের এই ব্যবসায়। এরপর গত ৮ বছর ধরে চালান তোলা দায় হয়ে পড়েছে। গেল বছর ১৫০ পিস চামড়া কিনে প্রায় ৪০ হাজার টাকা লোকসান দিয়েছেন। তখন থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর বাজারে না আসার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের চামড়া শিল্প নিয়ে নানামুখী পরিকল্পনার কথা গণমাধ্যমে শুনে বাজারে এসেছিলেন। কিন্তু বরাবরের মতো সিন্ডিকেটের অপতৎপরতায় এবারো লোকসানে পড়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।

বিবিরহাট বাজারের সামনে চামড়া নিয়ে বসে আছেন মৌসুমি ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন। তিনি জানান, দুপুর ২টা থেকে তিনি বসে আছেন বিকেল ৫টা পর্যন্ত। কোনো ক্রেতা আসেনি তার কাছে। ৫টার পর ২/১ জন ক্রেতা এসেছেন, কিন্তু কেউ বড় চামড়া প্রতি পিস ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার বেশি দাম করছেন না। অথচ সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সেই হিসাবে লবণের দাম বাদ দিলেও প্রতি পিস চামড়ার দাম ৬০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা।

মৌসুমি ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা ভেবেছিলাম বাজারে ভালো দাম পাবো। কিন্তু আড়তে গিয়ে দেখি কেউ ৩০০ টাকার বেশি দিতে চায় না। এভাবেই চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী বছরগুলোতে বাজারে মৌসুমি ব্যবসায়ীর সংখ্যা আরো কমে যাবে।

তবে কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির সাবেক সভাপতি মোসলেম উদ্দিন জানান, সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে। কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এই হিসাব না বুঝে বেশি দামে চামড়া কিনে লোকসানে পড়ছেন। প্রতি বর্গফুট চামড়ায় লবণ, লেবার ও সংরক্ষণ খরচ বাদ দিলে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা প্রতি বর্গফুট হিসেবে চামড়া কিনতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু এই দামে চামড়া বেচতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী আবদুল কাদের জানান, চট্টগ্রামে মাত্র একটা ট্যানারি শিল্প আছে, তাই এখানকার বাজার পুরোটাই ঢাকার ওপর নির্ভরশীল। ঢাকার ট্যানারি মালিকরাও সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনে না। কোরবানি ঈদের প্রথম কয়েকদিন সরকারের বিভিন্ন দফতর চামড়ার বাজারের খোঁজ খবর রাখেন। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনতে আসেন অন্তত ১৫ দিন পরে। বাকিতে চামড়া বিক্রি করে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মতো তারাও কয়েক বছর ধরে লোকসান গুনছেন বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রামের একমাত্র ট্যানারি রীফ লেদারের পরিচালক মোখলেছুর রহমান জানান, কাঁচা চামড়ার গুণগত মান ভালো না হলে রপ্তানি বা প্রক্রিয়াজাতকরণে সমস্যা হয়। তারা মানসম্পন্ন চামড়ার ন্যায্যমূল্য দিতে আগ্রহী, কিন্তু নিম্নমানের চামড়ার কারণে তারা লোকসান গুনতে চান না। অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী দাম পাওয়ার আশায় চামড়া ধরে রাখেন। আবার অনেক আড়তদার কম দামে কেনার আশায় দেরিতে চামড়া কিনতে আসেন। সঠিক সময়ে লবণ দিতে না পারায় চামড়ার গুনগত মান নষ্ট হয়। প্রক্রিয়াজাত করার সময় যা স্পষ্ট হয়। তাই কাঁচা চামড়া সংগ্রহে সরকারের একটা মনিটরিং থাকা জরুরি বলে জানান তিনি।

ট্যানারি সংশ্লিষ্টরা জানান, মৌসুমি ব্যবসায়ী, আড়তদার, ফড়িয়া সবাই একটি চেইনের অংশ। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এভাবে প্রতি বছর লোকসান গুনে মাঠ ছাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে পুরো শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানান তারা। তাই চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিপণনের ক্ষেত্রে একটি টেকসই ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত