চাঁদপুর-শরীয়তপুরের মধ্যে হচ্ছে দেশের দীর্ঘতম সেতু

গিয়াসউদ্দিন মিলন, চাঁদপুর
প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ৩৯

দেশের সবচেয়ে বড় ক্যাবল-স্টেইড সেতু নির্মিত হতে যাচ্ছে চাঁদপুরে। চাঁদপুর-শরীয়তপুর নামের সেতুটির সম্ভাব্যতা যাচাই ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। প্রকল্পটিতে অর্থায়নের আগ্রহ জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান।

প্রস্তাবিত এ সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৮ দশমিক ০৪ কিলোমিটার। প্রায় ১৫ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য এ প্রকল্প ২০৩৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সেতুটি জাতীয় অর্থনীতিতে ০ দশমিক ৭৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যোগ করবে বলে প্রত্যাশা করছে সরকার।

বিজ্ঞাপন

তিনটি ধাপে নির্মিতব্য এ সেতুতে থাকবে দুই হাজার ১০০ মিটার ক্যাবল-স্টেইড অংশ। নদীর নাব্য বজায় রাখতে মাঝখানে ৭০০ মিটার এবং দুপাশে যথাক্রমে ৪০০ ও ৩০০ মিটার স্প্যান ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। নৌযান চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে পানির স্তর থেকে সেতুর উচ্চতা হবে ৩০ মিটার।

ফিজিবিলিটি স্টাডির বরাত দিয়ে সরকারের সেতু বিভাগ জানায়, সেতুটি পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে কম জমি অধিগ্রহণ ও কম ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আব্দুর রউফ জানিয়েছেন, সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের যোগাযোগ নেটওয়ার্কে টেকসই সংযোগ স্থাপন করা। শরীয়তপুর-চাঁদপুর সেতুটি বাস্তবায়িত হলে তা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। দক্ষিণ কোরিয়ার ইডিসিএফ এবং জাপানের সেভেন প্ল্যাটফর্মের অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

চাঁদপুর-শরীয়তপুর সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মধ্যে দূরত্ব কমবে প্রায় ৭০ কিলোমিটার। চারটি বিভাগের ৩২ জেলার মধ্যে তৈরি হবে সরাসরি সড়কসংযোগ, যা যোগাযোগে আনবে আমূল পরিবর্তন। এতে সরাসরি উপকৃত হবে প্রায় পাঁচ কোটি ৮৯ লাখ মানুষ। নৌ, সমুদ্র ও স্থলবন্দরের সঙ্গে পণ্য পরিবহনে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কমবে সময় ও পরিবহন ব্যয়। বন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে আসবে গতি।

সড়ক বিভাগ চাঁদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী আলিউল হোসেন বলেন, সেতুটি নির্মিত হলে দেশের বাণিজ্য ও শিল্পখাতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে বলে মনে করছে সরকার।

তিনি আরো বলেন, সেতুটি নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয় ২০২২ সালে। মাটি পরীক্ষা, নদীর নাব্য, ভাঙন, জীববৈচিত্র্যসহ সব দিক বিবেচনা করে জরিপের ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়। এর পরই সেতু নির্মাণের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়।

বর্তমানে চাঁদপুর-শরীয়তপুর নৌপথে প্রতিদিন শত শত যানবাহন ফেরিতে পারাপার হচ্ছে। এটি দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ পথ। কিন্তু পুরোনো চারটি ফেরির ওপর নির্ভর করায় প্রতিদিনই যানবাহনের দীর্ঘ অপেক্ষা ও ভোগান্তির শিকার হতে হয়। প্রতিটি ফেরি পারাপারে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় পারাপার আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। শীতের সময় ঘন কুয়াশায় একাধিকবার ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে। এ সময় রোগী ও পণ্য পরিবহনেও দেখা দেয় বিঘ্ন।

মোংলা বন্দর থেকে চট্টগ্রামগামী ট্রাকচালক ইদ্রিস মিয়া বলেন, এ সেতুর জন্য আমরা বছরের পর বছর অপেক্ষা করছি। ফেরিতে পার হতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে। প্রায় সময় চাঁদাবাজির মুখেও পড়তে হয়। অনেক সময় শিপমেন্টও বাতিল হয়ে যায়। সেতু হলে এসব দুর্ভোগ কেটে যাবে।

ব্যবসায়ী দেলোয়ার ব্যাপারী বলেন, সেতু নির্মিত হলে বন্দর টু বন্দর সরাসরি সংযোগ তৈরি হবে, ঢাকা ঘুরে যাওয়ার প্রয়োজন থাকবে না। দূরত্ব কমবে এবং সময় বাঁচবে। ফলে ব্যবসায় গতি আসবে। দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা সত্যিকারের উন্নয়নের সুফল পাবেন।

ব্যবসায়ীরা আরো বলেন, সেতুটি নির্মিত হলে পণ্য পরিবহন ও যাতায়াতে সময় ও খরচ দুটোই উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। এর মাধ্যমে দেশের বাণিজ্য ও পরিবহন খাতে আসবে নতুন গতি।

সমুদ্রবন্দর, স্থলবন্দর ও অভ্যন্তরীণ নৌপথের মধ্যে উন্নত যোগাযোগ স্থাপিত হলে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে যোগ হবে নতুন মাত্রা। প্রকল্পের পরিপূরক হিসেবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে সড়ক প্রশস্তকরণের প্রস্তুতি শুরু করেছে। বিদ্যমান সড়কগুলোকে চারলেন মহাসড়কে রূপান্তরের জন্য জমি অধিগ্রহণেরও কাজ চলছে, যাতে সেতুটি দেশের প্রধান যোগাযোগ করিডোরের সঙ্গে নির্বিঘ্নে যুক্ত হতে পারে।

নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর মতে, প্রকল্পটি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পাঞ্চলের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মধ্যে গতিশীলতা তৈরি হলে বাণিজ্য ও পরিবহন খাতে লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রস্তুতিমূলক কাজ এরই মধ্যে দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অর্থায়ন নিয়ে আলোচনাও শেষ পর্যায়ে এবং সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন হয়েছে। সেতুটি তৈরি হলে সেটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম রূপান্তরমূলক অবকাঠামো প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত হবে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত