চলমান পরিস্থিতি : চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনদের মত

ঐক্যবদ্ধ না থাকলে বিপন্ন হবে সার্বভৌমত্ব

  • পরিস্থিতি উত্তরণে প্রয়োজন সব পক্ষের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন
  • ঐক্য দরকার ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সবার
  • সমন্বয় থাকতে হবে উপদেষ্টা আর কর্মকর্তাদের কথায়

চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৫, ২১: ১০

চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এখানে হীনমন্যতা দেখালে বিপন্ন হবে সার্বভৌমত্ব। পাশাপাশি সরকারকে হতে হবে আরো বেশি দায়িত্বশীল। সমন্বয় থাকতে হবে উপদেষ্টা আর কর্মকর্তাদের কথায়।

সরকারের দায়িত্বশীল অনেকের কথায় প্রকাশ পাচ্ছে অহমিকা, যা জাতীয় ঐক্যের জন্য অন্তরায়। এ বিষয়গুলো শক্তহাতে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সংকট ঘনীভূত হবে। ১৬ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। এতে সবার অবদান ছিল। তাই সবাইকে মূল্যায়ন করতে হবে। সংস্কার আর নির্বাচন দুটি দায়িত্বই এ সরকারের আছে।

বিজ্ঞাপন

সবাই সরকারকে সহযোগিতাও করছে। কিন্তু শেষ সময়ে এসে একটি কমিউনিকেশন গ্যাপ তৈরি হয়েছে। আর এতেই পতিত ফ্যাসিবাদ আর ভারতীয় অপশক্তি উৎসাহ পাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দল ও সরকার সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে বলে মনে করছেন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজন ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা।

চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার জানান, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষের মধ্যেই বড় কোনো বিরোধ নেই। সরকারও চাচ্ছে নির্বাচন দিয়ে দিতে; প্রধান রাজনৈতিক দলসহ অন্য দলগুলোও চাচ্ছে নির্বাচন। দূরত্ব শুধু সময় নিয়ে।

আলোচনার মাধ্যমে ছোট্ট এই দূরত্ব কমিয়ে ফেলা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু দিনদিন ছোট্ট এই ইস্যুটি বড় হয়ে যাচ্ছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব সব পক্ষকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

কর্তৃত্ববাদী শাসন অবসানের পর দেশ সংস্কার, সংবিধান মেরামত, দেশকে গুছিয়ে নিয়ে সাংবিধানিক ধারায় পরিচালনা করার যে অপূর্ব সুযোগ শিক্ষার্থী সমাজ আমাদের উপহার দিয়েছে, এ সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে না পারলে দুর্ভাগ্য হবে সবার।

এ সুযোগ ঐক্যের মাধ্যমে কাজে লাগাতে পারলে ফলাফলটা হবে দীর্ঘমেয়াদি। নইলে অনৈক্যের মধ্য দিয়ে দেশ অগ্রসর হলে ক্ষমতায় যারাই থাক বা আসুক কেউ লাভবান হতে পারবে না। আমরা চাই টেকসই স্থিতিশীলতা।

সরকারে যিনি থাকবেন, তাকে যদি সব সময় বিরোধী দল ঠেকাতে হবে, বিক্ষোভ ঠেকাতে হবে, দাবি মানতে হবে এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়, তাহলে দেশের সেবা করবেন কী করে। একটা সুযোগ এসেছে এই সুযোগ হাতছাড়া করলে বিপর্যয় নামবে।

রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বার্থ দেখবে, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সবার আগে দেশ। বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে এমন পরিস্থিতিতে সবাই মিলে আলোচনা করে সমাধানে যায়। আমাদেরও সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।

সরকার যে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা সরকারের একার দায়িত্ব নয়। ছাড় দেওয়ার মানসিকতা সবার মধ্যে থাকা উচিত, ছাত্র-জনতা তো জীবন বিসর্জন দিয়ে পরিবর্তন এনেছে। এখন এসে এতটুকু ছাড় না দিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দেবে এটা বিশ্বাসযোগ্যে নয়।

অধ্যাপক মুহম্মদ সিকান্দার খান, সাবেক উপাচার্য, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি

প্রচলিত রাজনৈতিক ধারা পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়েই এ অভ্যুত্থান হয়েছে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ওই ধারা থেকে আদৌ বের হতে পেরেছে কি না সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। এ কারণেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে সংস্কারের উদ্যোগগুলো নেওয়া হচ্ছে, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তা অপরিচিত মনে হচ্ছে।

এতে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল তৈরি হয়েছে। এ জায়গায় সবাইকে হতে হবে আরো বেশি দায়িত্বশীল। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস এতদিন দরিদ্র সহজ-সরল মানুষকে নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু এখন এসে তাকে রাজনীতির জটিল-কঠিন মানুষকে নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। বিষয়টি সবাইকে অনুধাবন করতে হবে।

ড. ইউনূস যতদিন আছেন, ততদিন ভালো কিছুর আশা আছে। উনি বিরক্ত হয়ে চলে গেলে পরিস্থিতি জটিল হবে। কারণ এই মুহূর্তে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ওনার চেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে নেই। কাউকে না কাউকে দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টা করা হবে, কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হবে না। কেউ কাউকে মানবে না, একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হবে।

রাজনৈতিক দলগুলো অস্থির হয়ে উঠেছে। কারণ তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নেই। কেউ কারোর কথা শুনছে না। এই অবস্থায় তাদের জনপ্রিয়তা দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। এ কারণেই দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছে। কিন্তু এটা তো তাদের নিজেদের সমস্যা। এই রাজনৈতিক দলগুলো যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন এমনটা নয়।

কিন্তু তারা ভাবছেন সময় যত যাচ্ছে, তাদের জনপ্রিয়তা কমছে, তাই অস্থির হয়ে উঠেছেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে এই আচরণ অন্যায় নয়, কিন্তু নিজের স্বার্থ দেখতে গিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে শুধু একটি দলই নয়, গোটা দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অধ্যাপক নসরুল কদির, উপাচার্য, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়

অধ্যাপক নসরুল কদির মনে করেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন নেই। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতার ঘাটতি স্পষ্ট। আর এ কারণেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যেভাবে ডিল করা উচিত তা করতে পারছেন না তারা।

এর বাইরে যুক্ত হয়েছে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এ সরকার ক্ষমতায় আসার প্রথম দিন থেকেই ভারত তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অসহযোগিতা করছে। নেতিবাচক প্রচারণা, পানি ছেড়ে দিয়ে বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া, বন্দর বন্ধ করে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার মতো অবস্থা একের পর এক তৈরি করে চলেছে ভারত।

এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হলে সবাইকে নিয়ে ঐক্য ধরে রাখতে হবে। আর এই উদ্যোগটা সরকারকেই নিতে হবে। কারণ তারা ক্ষমতায় আছেন। কিন্তু এখানে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার কথার সঙ্গে অন্য উপদেষ্টার কথার মিল থাকছে না। উপদেষ্টাদের কথার সঙ্গে মিলছে না কর্মকর্তাদের আচরণে।

পুরোনো ও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে নতুন দলের প্রতি সরকারের আগ্রহও প্রকাশ্যে এসেছে। এসব নিয়ে অনৈক্য তৈরি হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই অবস্থার উন্নতি করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমানোর পাশাপাশি পররাষ্ট্রনীতিতে আরো দক্ষ মানুষকে কাজে লাগাতে হবে।

অ্যাডভোকেট বদরুল আনোয়ার, সদস্য, বার কাউন্সিল

অ্যাডভোকেট বদরুল আনোয়ার মনে করেন, জাতির যে ক্রান্তিকালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেটা ছিল সাহসী পদক্ষেপ। সংস্কার ও নির্বাচন করার ম্যান্ডেট নিয়ে দেশের সবাই মিলে তাকে দায়িত্ব দিয়েছিল।

কিন্তু ৯ মাসের মাথায় দায়িত্ব অসম্পূর্ণ রেখে পদত্যাগ করার যে ইস্যু সামনে এসেছে এখানে, তার অসহনশীলতা প্রকাশ পেয়েছে। এই অবস্থার জন্য তার সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা, রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছে।

সবার মাথায় রাখা উচিত পতিত শক্তি এখনো সক্রিয়। প্রতিবেশী দেশের বিভিন্ন সংস্থাগুলোও তৎপর। এ অবস্থায় যে কোনো ধরনের অস্থিরতা তাদের প্রণোদনা জোগাবে। সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব মোটা দাগে কী কী সংস্কার তারা করতে চান, সে বিষয়টি খোলাসা করা আর জাতীয় নির্বাচনের একটি রূপরেখা ঘোষণা করা। এটি হলেই অর্ধেক সংকট রাতারাতি সমাধান হয়ে যাবে। এ বিভক্তির ধারা অব্যাহত থাকলে পতিত ফ্যাসিস্টরা ফের সুযোগ নিতে পারে, যা গোটা দেশের ওপর সংকট ডেকে আনবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত