দুই শতাব্দীর জ্ঞানের মশাল কুমিল্লা জিলা স্কুল

এম হাসান, কুমিল্লা
প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ৪৩
আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ১৬

কুমিল্লা জিলা স্কুল। এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো বিচ্ছুরণের মহান ব্রতে প্রায় দুই শতাব্দী ধরে জ্ঞানের মশাল জ্বেলে রেখেছে বিদ্যাপীঠটি । এখান থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় হাতেখড়ি নিয়ে মানবতার কল্যাণে দেশে-বিদেশে নিবেদিত আছেন বহু অন্তপ্রাণ ব্যক্তিত্ব।

দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ক্রীড়া, বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবা, ধর্ম ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠিত। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই স্কুলের ছাত্ররা অংশ নেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, নব্বইয়ের আন্দোলনসহ ২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের দুঃসাহসী অংশগ্রহণ ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

বিজ্ঞাপন

বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা

বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে শচীন দেব বর্মন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক, সুরকার ও গায়ক। যিনি মূলত ‘এস ডি বর্মন’ নামে সুপরিচিত। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন আইনজীবী, ভাষাসৈনিক ও রাজনীতিবিদ। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ, শিল্পী আপেল মাহমুদ এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন।

স্কুলের ১৯৬৩ ব্যাচের ছাত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার প্রথম নকশাকার শিব নারায়ণ দাসকে ৬২-এর ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় পাকিস্তান সরকার স্কুল থেকে বহিষ্কার করেছিল। আবু জাহিদ ও আবদুল্লা-হিল-বাকী একাত্তরে দুজনই ছিলেন কুমিল্লা জিলা স্কুলের ছাত্র। জাহিদ পড়তেন নবম শ্রেণিতে আর বাকী দশম শ্রেণিতে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার চারগাছ বাজারে যুদ্ধে আবু জাহিদ শহীদ হন। এই স্কুল থেকে ১২২ ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এর মধ্যে শহীদ হন ১০ জন। এমন করে যুগে যুগে নানা সংকটে এ স্কুলের শিক্ষার্থীদের নাম গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে।

১৯৮৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আয়কর আইনজীবী মাসুক আলতাফ চৌধুরী বলেন, ১৮৮ বছরের পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কুমিল্লা জিলা স্কুল। শিক্ষার প্রসারে স্কুলটির ভূমিকা অনেক দীর্ঘ। এখনো শিক্ষা ও সুনামে মানের শীর্ষে রয়েছে কুমিল্লা বোর্ডে। কুমিল্লা বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষায় ছয় জেলার মধ্যে সব সময়ই ফলাফলে শীর্ষে থাকে এই প্রতিষ্ঠান। এ স্কুল থেকে দেশবরেণ্য বহু কৃতী ছাত্র দেশ-বিদেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে স্বনামে অবদান রেখে আসছেন। দেশের সব সেক্টরে তাদের পদচারণ রয়েছে। সম্প্রতি প্রাক্তন ছাত্রদের সংগঠন অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন পুনর্গঠন করা হয়েছে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৃত্তি চালু করা হয়েছে। আগামীতে বৃহত্তম পুনর্মিলনী করারও সিদ্ধান্ত রয়েছে বলে জানান তিনি।

প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

১৮৩৭ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ত্রিপুরার মহারাজ ধর্মমানিক্যের খনন করা কুমিল্লা শহরের ধর্মসাগরের পূর্ব পাড়ে ছোট্ট বাংলো ঘরে শুরু হয় পাঠদান । ৩৭ জন ছাত্র, ৪ জন শিক্ষক নিয়ে এর যাত্রা। সে সময় পাঁচজন ইউরোপিয়ান, একজন হিন্দু ও তিনজন মুসলিম শিক্ষানুরাগী ব্যক্তির একটি কমিটি এই স্কুল পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। ১৮৩৯ সালের ৬ মে তৎকালীন কুমিল্লা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অফিসের প্রধান করণিক হেনরি জর্জ লেচিস্টারকে এ স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৮৭০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন।

১৮৬২ সালে ঝড়ে বাংলো ঘরটি বিধ্বস্ত হলে স্থানীয়দের আর্থিক সহায়তায় স্কুলের বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়। বিগত ১৮৮ বছরে ৫৪ জন শিক্ষক এই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন ।

পরবর্তীতে ব্রিটিশ-ভারত সরকার ইংরেজি সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে স্কুলটিকে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের রূপ দেয়। এর নামকরণ করে ‘ত্রিপুরা জিলা স্কুল’ । ১৮৫০-পরবর্তী সময়ে স্কুলের ভবন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুরু হয়। শিক্ষাদান পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটানো হয়। ১৯৩৭ সালে কুমিল্লা জিলা স্কুল তার প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদ্‌যাপন করে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বিদ্যালয়টির শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটানো হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর থেকে স্কুলটি শিক্ষা ও অন্যান্য দিক দিয়ে উন্নয়ন লাভ করতে থাকে।

এটি জেলার প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ের সন্নিকটে অবস্থিত। স্কুলটি প্রভাতী ও দিবাÑএ দুই শিফটে বিভক্ত। ৫ম থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চায় এখানে বড় একটি গ্রন্থাগার আছে। যেখানে রয়েছে লাখো বই-পুস্তক। আইসিটি জ্ঞান অর্জনের জন্য রয়েছে কম্পিউটার ল্যাব, বিজ্ঞানের ব্যবহারিক জ্ঞানের জন্য সায়েন্স ল্যাব। আছে একটি ক্যান্টিনও।

স্কুলের স্বর্ণযুগের স্থপতি নূর আহম্মদ খানের নাম এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। প্রধান শিক্ষক হিসেবে তার চৌকস মেধা ও শ্রমে স্কুলের শৃঙ্খলা আর শিক্ষার মানকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে, সারা বাংলায় ‘কুমিল্লা জিলা স্কুল’ ১৯৬৯-৭০ সালে ‘শ্রেষ্ঠ স্কুল’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। সে সঙ্গে সত্যনিষ্ঠ ও কঠোর সংগ্রামী এই কিংবদন্তি তার কর্মকুশলতার পুরস্কার হিসেবে ১৯৭০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিক স্কুলের শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক সম্মানে ভূষিত হয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদক (স্বর্ণপদক) লাভ করে তদানীন্তন পাকিস্তানে আলোড়ন তোলেন।

সাফল্য

এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের দিক দিয়ে এই স্কুলটি বেশ কয়েক বছর ধরে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে প্রথম স্থান ও সমগ্র বাংলাদেশে সেরা দশের মধ্যে অবস্থান করছে। স্কুলটিতে বর্তমানে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। বর্তমানে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আব্দুল হাফিজ। ২০০৯ সালে স্কুলটি কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের শ্রেষ্ঠ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্বীকৃতি লাভ করে।

কুমিল্লা জিলা স্কুলের ২০০৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী সাংবাদিক তানভীর দীপু আমার দেশকে জানান, কুমিল্লা জিলা স্কুল আমাদের গর্বের জায়গা। পড়াশোনার পাশাপাশি মানবিক আচার-আচরণ ও সামাজিক শিক্ষার শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে দেওয়ার বাতিঘর। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ক্রীড়া, বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবা, ধর্ম ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই এ স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠিত। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ স্কুলের ছাত্ররা অংশ নেন। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে, নব্বইয়ের আন্দোলনসহ দেশের স্বার্থে সব বিপ্লব এবং ২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও এ স্কুলের ছাত্রদের সাহসী অংশগ্রহণ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দীর্ঘ ১৮৮ বছরের ইতিহাসে সেরাদের সেরা হওয়ার কৃতিত্ব এ বছরও এসএসসির ফলাফলে দেখিয়ে দিয়েছে স্কুলটি।

প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আব্দুল হাফিজ আমার দেশকে বলেন, এ স্কুলটি একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে সেরাদের একটি। গত সপ্তাহে আমরা ১৮৮ বছরপূর্তি পালন করেছি । প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এটি তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে । গোটা বাংলাদেশেই একটি ব্যতিক্রমী স্কুল হিসেবেই কুমিল্লা জিলা স্কুলকে মানুষ চেনে ।

তিনি জানান, বিগত এক যুগ ধরে বোর্ডে প্রথম স্থান দখল করে রেখেছে কুমিল্লা জিলা স্কুল। ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ৩৬৫ জন পরীক্ষা দিয়ে ৩৪৪ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। বাকি ২১ জন জিপিএ-৫-এর কাছাকাছি পেয়েছে এবং শতভাগ পাস করেছে। স্কুলে বর্তমানে ৫৩ জন শিক্ষক রয়েছেন । অবশ্য আমাদের পর্যাপ্ত শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে ।

প্রধান শিক্ষক হাফিজ বলেন, স্কুলের বর্তমান অবকাঠামোগত পরিবেশ আরো বেশি পরিচ্ছন্ন হওয়া প্রয়োজন। দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্মাণাধীন মসজিদটির কাজ শেষ করা উচিত। এছাড়া আবাসিক হল ও অডিটরিয়ামের যে বেহাল দশা, তা সংস্কার করে আধুনিকায়ন করা জরুরি। সে সঙ্গে স্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থাসহ মাঠ সংস্কার করতে হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত