কনটেইনার জট কমছে চট্টগ্রাম বন্দরে

সোহাগ কুমার বিশ্বাস, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৪ মার্চ ২০২৫, ১৩: ১০

রমজান সামনে রেখে একদল ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম বন্দরে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছিল। আমদানি করা পণ্য মাদার ভেসেলে ও লাইটার জাহাজে রেখে বাজার কারসাজির অপচেষ্টা করে তারা। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের চারগুণ জরিমানা আরোপের সিদ্ধান্তে দ্রুত খালাস বাড়ছে। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার কনটেইনার বন্দর ছাড়ছে। এটা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক সংকেত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে স্বভাবিক সময়ে দৈনিক গড়ে সাড়ে ৫ থেকে ৭ হাজার কনটেইনার ডেলিভারি হয়। এর থেকে কম বা বেশি হলে বাজারে কারসাজির শঙ্কা তৈরি হয়। কখনো বেশি পণ্য এনে ছোট ব্যবসায়ীদের লোকসানে ফেলে বাজার ছাড়তে বাধ্য করে করপোরেট গ্রুপ। আবার কখনো পণ্য খালাসের গতি কমিয়ে কৃত্তিম সংকট তৈরি করে বাজার অস্থির করার ষড়যন্ত্র করে সিন্ডিকেট। দুটি ঘটনাই জাতীয় অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

বিজ্ঞাপন

সূত্র জানায়, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকেই বাজারে অস্থিরতা তৈরির অপচেষ্টা শুরু হয়। রেকর্ড পরিমাণ পণ্য আমদানি করলেও মাদার ভেসেল থেকে পণ্য নামিয়ে লাইটার জাহাজে লোড রাখাসহ বন্দর থেকেও পণ্য ডেলিভারি কমিয়ে দেয় আমদানিকারকরা। ফলে ইয়ার্ডগুলোতে কনটেইনারের পরিমাণ বাড়তে থাকে। মার্চের ১০ তারিখে কনটেইনারের পরিমাণ ৪৫ হাজার ছাড়ায়।

উপায়ন্ত না পেয়ে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ে পণ্য খালাস না করলে ৪ গুণ হারে জরিমানা আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে পণ্য খালাসে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। এই সিদ্ধান্তের পর বন্দর থেকে বর্তমানে দৈনিক ৫ হাজারের কাছাকাছি কনটেইনার খালাস হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, রমজানকে কেন্দ্র করে একটি পক্ষ মনোপলি ব্যবসার পাশাপাশি বাজারে অস্থিরতা তৈরির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করার অপচেষ্টা শুরু করে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রথমে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাস করে লাইটার জাহাজে দেশের বিভিন্ন ঘাটে ভাসমান গুদাম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। এতে ভোজ্য তেল ও চালসহ কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে যায় হঠাৎ। বিষয়টি বুঝতে পেরে নদী ও সাগরে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর, কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে সেই প্রক্রিয়া নস্যাৎ করে দেয় সরকার। কিন্তু অভিযুক্তরা এরপর বন্দর থেকে পণ্য খালাস কমিয়ে দেয়। বন্দর থেকে কনটেইনার খালাস দৈনিক সাড়ে ৫ হাজার থেকে কমতে কমতে আড়াই হাজারে নেমে আসে।

মার্চের শুরুতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য খালাস নিতে জোরাজুরি শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এক পর্যায়ে জট কমাতে ১০ মার্চ থেকে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগের হুঁশিয়ারি জানিয়ে ৯ মার্চ পর্যন্ত পণ্য খালাস করতে সব স্টেকহোল্ডারকে লিখিত চিঠি দেয় তারা। নির্ধারিত সময়ের পর ৪ গুণ হিসাবে প্রতি ২০ ফুট সাইজের কনটেইনারে প্রতিদিনের জন্য ৪৮ মার্কিন ডলার এবং ৪০ ফুট সাইজের কনটেইনারের জন্য ৯৬ মার্কিন ডলার জরিমানা আদায় শুরু করা হয়। এতে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে বন্দরে। মার্চের শুরুতে যেখানে দৈনিক আড়াই হাজারের বেশি কনটেইনার ডেলিভারি হতো না, এখন সেখানে ৫ হাজারের কাছাকাছি পণ্য ডেলিভারি হচ্ছে।

বন্দরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৮ মার্চ অর্থাৎ চারগুণ হারে জরিমানা আদায়ের সিদ্ধান্তের আগের দিন কনটেইনার ডেলিভারি হয় ৩ হাজার ২০০ টিইউএসের কিছু বেশি। ১০ দিন পর ১৮ মার্চ কনটেইনার ডেলিভারির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ৮৫৫ টিইইউএস।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জানান, উৎসব-পার্বণে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানোর প্রবণতা অনেক বছর ধরেই চলে আসছে। আর এই অনৈতিক প্রক্রিয়ায় বন্দরের মতো প্রতিষ্ঠানকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। জরিমানা ছাড়া বন্দরের যে মাশুল, তা বাইরের গুদামের চেয়ে কম ও নিরাপদ। ফলে বন্দরকে গুদাম হিসেবে ব্যবহারের অপচেষ্টা করে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। তবে এ বছর এই অপচেষ্টা শুরুতেই রুখে দেওয়া গেছে। মাশুল আদায় চারগুণ বাড়ানোয় কনটেইনার দ্রুত খালাস হচ্ছে। এতে প্রতিদিন অতিরিক্ত এক হাজার কনটেইনার বন্দর থেকে আউট হচ্ছে, যা বন্দরের স্বাভাবিক অপারেশন ও জাতীয় অর্থনীতির জন্যও একটি ইতিবাচক দিক।

তবে বন্দরের এই সিদ্ধান্তকে নেতিবাচকভাবে দেখছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, বন্দর থেকে কনটেইনার খালাস করতে কাস্টমস, ব্যাংক, সিঅ্যান্ডএফ, শিপিং এজেন্টসহ অন্তত ২০টি আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে কাজ করতে হয়। এ কারণে অনেক সময় ইচ্ছা থাকলেও ৪ দিনের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি সম্ভব হয় না। তাই জটের অবস্থা তৈরি হলে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ সাময়িক সময়ের জন্য যৌক্তিক হলেও সব সময়ের জন্য এটা লাভের চেয়ে বরং ক্ষতিই বেশি হবে।

বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে ৫৩ হাজার টিইইউএস কনটেইনারের ধারণক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে সেখানে কনটেইনার আছে ২৫ হাজার টিইইউএসের নিচে। অর্থাৎ বন্দরে জট তৈরির কোনো সম্ভাবনা এখন নেই। তাই স্বাভাবিক সময়ে অস্বাভাবিক মাশুলের চাপ অব্যাহত রাখায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত মাশুল পণ্যের অর্ডার কিংবা আমদানির সময় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ অবস্থায় মাশুল আরোপের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে বন্দর চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দিয়েছে বিজিএমইএ।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত