সামান্য কাজ করেই ৫৬ কোটি টাকা উত্তোলন ঠিকাদারের

আব্দুল হান্নান, নাসিরনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)শামসুল আরেফিন (সরাইল)
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২: ৪৬

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ‘নয় সেতু’ প্রকল্পের কাজে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নয়টি সেতু ২০২৪ সালের মধ্যে সমাপ্তির ঘোষণা থাকলেও দুটি ছাড়া বাকি সাতটির এখনো কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। নাসিরনগরকে অরুয়াইল এবং কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে এই প্রকল্পের বাকি সেতুগুলোর কাজ প্রায় বন্ধ রয়েছে। বছরের পর বছর ঝুলে থাকার কারণে জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে।

বিজ্ঞাপন

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, গ্রীষ্মকালে সেতুর কাজ চলে দিনের চেয়ে রাতেই বেশি। রাতে ঢালাইয়ের কাজ চলে নিম্নমানের পাথর দিয়ে, সিমেন্ট কম দিলে কেউ দেখে না। নির্মাণকাজে মরিচা পড়া রড ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া যত্রতত্র সিমেন্ট পড়ে থাকে ফলে এগুলোতে বাতাস লেগে জমাট বেঁধে যায়, আর সেই সিমেন্ট আবার ঢালাই কাজে ব্যবহার হয়। বারবার অভিযোগ দেওয়া হলেও মিলছে না প্রতিকার।

নাসিরনগর উপজেলার নাসিরপুর, ভলাকুট, খাগালিয়া ও চাতলপাড় এলাকায় চলমান সেতু নির্মাণে নিম্নমানের পাথর সিমেন্ট এবং রড দিয়ে কাজ করছে। বহুদিন আগে কাজ শুরু হলেও নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় জনগণের দুর্ভোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ঠিকাদারদের উদাসীনতা, এলজিইডির অসাধু লোকদের অসাধু ইচ্ছে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প ধীরগতিতে চলছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।

নাসিরনগর উপজেলার এলজিইডি উপজেলা প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম মৃধার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নয়টি সেতুর মোট ব্যয় ধরা হয় ১০৪ কোটি ৯১ লাখ ৮১ হাজার টাকা। এর মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাসান এন্টারপ্রাইজ প্রকল্পের ছয়টি সেতুর অনুমোদন পায়। জানা গেছে, হাসান এন্টারপ্রাইজ ইতোমধ্যে ৫৬ কোটি ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকা তুলে নিয়ে নিয়েছে। টাকা উত্তোলনের সমপরিমাণ কাজ এগোয়নি। অভিযোগ রয়েছে, কাজের অর্ধেকও শেষ না করেই ঠিকাদাররা বিল উঠিয়ে নিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলার একজন প্রকৌশলী বলেন—প্রতি ঢালাইয়ে যেখানে কমপক্ষে ১২০ বস্তা সিমেন্ট দেওয়ার নিয়ম, সেখানে ঠিকাদারের নির্দেশে মাত্র ৭০ বস্তা ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে মান রক্ষা না করেই নিজেদের পকেটে টাকা ঢোকাতে চাচ্ছেন ঠিকাদারেরা।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল করিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কাজ শেষ না করেই বিল তুলে নেওয়া হয়েছে। আমাদের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে যদি এভাবে দুর্নীতি হয়, তাহলে উন্নয়ন কীভাবে হবে? এভাবে চলতে থাকলে জনগণের ভোগান্তি কমবে না।

হাসান এন্টারপ্রাইজ দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ইব্রাহিম বলেন, ‘আমাদের সব কাজ নিয়ম মেনে চলছে। তবে আমি কোম্পানির অনুমতি ছাড়া কোনো বক্তব্য দেওয়ার এখতিয়ার রাখি না।’

নয় সেতু প্রকল্পে এলজিইডির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরামর্শক মো. আব্দুল মোতালেব বলেন, ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সেতুগুলোর কাজ পরিকল্পনা অনুযায়ী সুন্দরভাবে চলছে, তবে বর্ষার কারণে কিছুটা অসঙ্গতি থাকলেও পর্যায়ক্রমে প্রকল্পের কাজ ঠিক হয়ে যাবে।

অনিয়মের বিষয়ে ইব্রাহি বলেন, প্রতিদিনের কাজের বিস্তারিত প্রতিবেদন জেলা অফিসে পাঠানো হয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য জেলা অফিস থেকেই জানতে পারবেন।

হাসান এন্টারপ্রাইজের সাইট ম্যানেজার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের কোম্পানির অধীনে নয়টি সেতুর কাজ চলমান। এর মধ্যে নাসিরপুর, ভলাকুট, খাখালিয়া, দুর্গাপুর, চাতলপাড় চকবাজার, ইছাপুর, গুজিয়া খাইল ও কান্দারখাল সেতুর কাজ রয়েছে। দুটি ছাড়া বাকি সাতটি সেতুর কাজ ৫০ শতাংশ হয়েছে।

হাসান এন্টারপ্রাইজের ঠিকাদার খায়রুল হাসান বলেন, প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে আমাদের কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। প্রথমত, সেতু নির্মাণের জন্য যেটি নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির ওপর পড়েছে। ফলে এলাকার কিছু মানুষ আমাদের কাজে বাধা দিয়েছেন। জমি-সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করতে কিছুটা সময় লেগেছে। পরে নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরেজমিনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি জমির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের আশ্বস্ত করেন এবং আমাদের দিক থেকেও কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। তাই কিছুদিন প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে যায়।

এক প্রশ্নের জবাবে খায়রুল হাসান বলেন, আমাকে টেন্ডার দেওয়া হয়েছে আমার যোগ্যতা ও সঠিক কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে। প্রথম পর্যায়ে মোস্তফা এন্টারপ্রাইজকে একটি কাজ দেওয়া হয়, আমাকে ছয়টি এবং মোমেন এন্টারপ্রাইজকে একটি কাজ দেওয়া হয়। পরে যখন আবার টেন্ডার আহ্বান করা হয়, তখন বাকি সেতুগুলোর কাজ আমি পাই। ২০২১ সালে প্রকল্পটির কাজের জন্য এলজিইডি তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডার দেয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী এনামুল হক বলেন, বর্ষার কারণে নির্মাণসামগ্রী আনা-নেওয়ায় কিছু সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা আশা করছি, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

এক ব্যক্তি কীভাবে নয়টি সেতুর টেন্ডার পেতে পারেন? এই প্রশ্নের উত্তরে এনামুল হক বলেন, এটির উত্তর আমার কাছে নেই। আমার আগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন। নির্মাণকাজের বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, এখানে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। এলজিইডির পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি সব সময় কাজ পর্যবেক্ষণ করছেন। আমি শতভাগ স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। এলাকার কিছু মানুষের যেসব অভিযোগ বা মন্তব্য এসেছে, সেগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত