মিরসরাইবাসীর গলার কাঁটা জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল

নুরুল আলম, মিরসরাই (চট্টগ্রাম)
প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৫, ১১: ০৭

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল এলাকাবাসীর জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক পথগুলো বন্ধ হওয়ায় জলাবদ্ধতা, কারখানায় অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ধ্বংস ও চাষাবাদের জমি কমে যাওয়ার ফলে এলাকায় খাদ্য সংকট সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া গরু, মহিষ, বেড়ার খামার ও মহিষের দধি শিল্প, সামুদ্রিক মাছ এবং দেশের অন্যতম ইলিশ প্রজনন অঞ্চল ধ্বংসের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। স্থানীয়দের অভিযোগ, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন উপজেলার বাসিন্দাদের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে এখন অভিশাপ হয়ে উঠেছে।

বিজ্ঞাপন

শুরুতে স্থানীয়দের জন্য শিল্প-কারখানায় ২০ শতাংশ কোটা থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনসহ দলীয় নেতাকর্মী ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেই প্রতিশ্রুতি দিলেও গত ৯ বছরে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। হাতেগোনা কিছু লোককে ছোটখাটো পদে নিয়োগ ছাড়া এর কোনো সুফল পাচ্ছে না এলাকাবাসী।

স্থানীয়দের মতে, মিরসরাই, সোনাগাজী ও সীতাকুণ্ডের মানুষের জন্য অক্সিজেন চেম্বার হিসেবে অপরিহার্য ছিল উপকূলীয় ২২ হাজার একর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের এক কোটি ৬০ লাখ গাছ। প্রাকৃতিক জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলের বাসিন্দাদের রক্ষায় ঢাল হিসেবে রক্ষা করত। এত বিশাল বন বিলুপ্ত হওয়ায় হারিয়ে যায় প্রায় ৮০ শতাংশ সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য। নতুন বনায়ন গড়ে না উঠলে প্রাকৃতিক ইকো সিস্টেম ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা পরিবেশবিদদের।

অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিষ্ঠার পর সাগরের উপকূল ভরাট হয়ে সমতল থেকে এখন ৭-৮ ফুট উঁচু। ফলে পরিকল্পিত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে ক্ষেতের ফসল, প্রকল্পের মাছ, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

উপকূলীয় বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, একসময় মিরসরাইয়ের সাহেরখালী, ইছাখালী ও মঘাদিয়া ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে প্রায় ১০-১২ হাজার চিত্রা হরিণের বসবাস ছিল। কিন্তু ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মাত্র চারটি মৃত এবং চারটি আহত হরিণ উদ্ধার হয়েছে। একই সময়ে মঘাদিয়া ঘোনা এলাকায় বেড়িবাঁধের ওপর দুটি মৃত হরিণ উদ্ধার হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আগে যেসব এলাকায় দিনে-রাতে হরিণের অবাধ বিচরণ ছিল, এখন সেখানে শিল্পায়নের দাপটে দিন-রাত কর্মযজ্ঞ জ্বলছে সড়ক বাতি । বন-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ও সামুদ্রিক উদ্ভিদ ধ্বংস করে মানুষ বাঁচতে চায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এলাকার পরিবেশবিদ স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অপকার নির্বাহী পরিচালক মো. আলমগীর বলেন, জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল মিরসরাইকে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছে। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে ডেভেলপ না করলে বাড়তি লাখ লাখ মানুষের ভার বহনের ফলে মিরসরাই নগরায়ণের সৌন্দর্য হারাবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে ভোগান্তির শিকার হবে।

মিরসরাই পরিকল্পিত নগরায়ণের সুপারিশকারী সংগঠন নয়া দালানের চেয়ারম্যান মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সময় ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ গাছ কাটা হয়েছে। সে ক্ষতি পূরণে বনায়ন গড়ে তোলেনি বেজা।

তিনি আরো বলেন, আমরা এই উপজেলার সামগ্রিক পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে সরকারের সঙ্গে কাজ করেছি। আমাদের পরামর্শ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে গবেষণা প্রতিবেদন আকারে জমা দেওয়া হয়েছে। সরকার মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করেছে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে প্রশাসন এখনো বাস্তবায়ন করতে দেখছি না। ফলে মানুষ যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণ করে মিরসরাইকে একটি বস্তিতে পরিণত করছে। প্রশাসন উদ্যোগী না হলে অচিরেই মিরসরাই বসবাসের যোগ্যতা হারাবে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে উদ্বোধন হওয়া ‘জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’-এর জন্য মিরসরাই উপকূলীয় অঞ্চলের ২২ হাজার ৩৩৫ একর বনভূমি নির্ধারণ করা হয়। এই অঞ্চলটি চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজী উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত। প্রকল্পটির মোট আয়তন ৩৩ হাজার ৮০৫ একর। যার ১৪ হাজার একরে শিল্প-কারখানা এবং বাকিটিতে থাকার কথা খোলা জায়গা, বনায়ন, আবাসন, বন্দর, স্বাস্থ্য ও বিনোদন অবকাঠামো। শিল্পায়নের চাপে ২২ হাজার একর বন ধ্বংসের ফলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে সামুদ্রিক উপকূলীয় বনাঞ্চলের শত শত জীববৈচিত্র্য ও উদ্ভিদ।

মিরসরাই উপকূলীয় রেঞ্চ কর্মকর্তা আব্দুল গফুর মোল্লা বলেন, ২০২৪ সালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় চার হাজার ১০৪ একর উপকূলীয় বনাঞ্চল ফেরত দেওয়ার জন্য বেজা বরাবর চিঠি পাঠিয়েছে। এই জায়গায় রয়েছে কেওড়া, গেওড়া ও বাইনসহ গুরুত্বপূর্ণ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণীর আবাস।

তিনি আরো জানান, বন পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে উপকূলীয় বন বিভাগ ‘সুফল প্রকল্প’ এর আওতায় বিশাল ম্যানগ্রোভ বাগান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে বামনসুন্দর ও মঘাদিয়া বিটে মোট প্রায় ১০০ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বাগান গড়ে তুলে।

এ ছাড়া পুরো সুফল প্রকল্পে প্রায় ৪১ লাখ চারা রোপণ করা হয় । তিনি বলেন, শিল্পায়নের কারণে বন হারিয়ে গেলেও আমরা চারা রোপণের মাধ্যমে নতুন করে বন গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি হরিণের আবাসস্থল পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট রয়েছি।

চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক শেখ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ইকো সিস্টেমের অংশ হিসেবে হরিণের সংখ্যা কমে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক যখন বন ধ্বংস হয়। খাদ্য ও আশ্রয় হারালে প্রাণী স্থানান্তরিত হয় বা হারিয়ে যায়। আমরা মাঠপর্যায় থেকে প্রতিবেদন পাঠিয়ে চার হাজার ১০০ একর বনভূমি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। বন রক্ষা করতে পারলে হরিণসহ অন্যান্য প্রাণী আবার ফিরে আসবে।

মিরসরাই উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর জানান, অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য মানুষের জমি অধিগ্রহণের জন্য আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপিসহ দলীয় নেতাকর্মীরা সভা সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে মানুষকে বুঝিয়েছে এখানে শিল্প-কারখানা চালু হলে স্থানীয় মিরসরাই বাসিন্দাদের জন্য চাকরিতে ২০ শতাংশ কোটা থাকবে। তারা নিজেদের সুবিধা আদায়ের জন্য জনগণের সঙ্গে মিথ্যাচার করেছিল। আজ পর্যন্ত কোনো শিল্প কারখানায় মিরসরাইয়ের নাগরিকদের অফিসার পদে চাকরিতে সুযোগ দেওয়া হয়নি।

এ ছাড়া শিল্প-কারখানায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে এ অঞ্চলে সুপেয় পানির দীর্ঘস্থায়ী সংকট সৃষ্টি করছে। আমরা পরিকল্পিত নগরায়ণ চাই। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সাগরের পানি প্রক্রিয়া করে ব্যবহার করার দাবি জানান তিনি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত