সাত মাস আগে বাবার মৃত্যু, শিশু ছামীমকেও বাঁচানো গেল না

মো. আল-আমিন, শরীয়তপুর
প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৫, ০৭: ২১
ছবি: সংগৃহীত

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের আবদুল্লাহ ছামীম পরিবারের সবার অত্যন্ত আদুরে ছিল। উপজেলার দিগার মহিষখালী (ডি এম খালী) ইউনিয়নের মাঝিকান্দি গ্রামের এই ছোট্ট বাসিন্দা পড়ত স্থানীয় একটি মাদরাসায়। তার বাবা সৌদি আরবে থাকলেও সারাক্ষণ তার কথাই বলত আর ভিডিওকলে কথা বলত। হঠাৎ করে তার বাবা মারা যান। এরপর আর পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছিল না সে। তাই রাজধানীর উত্তরায় তার বড় ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ছয় মাস ধরে ভাইয়ের সঙ্গে বসবাস করছিল এবং স্থানীয় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ছিল। গত সোমবার বিমান বিধ্বস্তের পর অগ্নিকাণ্ডে সেও দগ্ধ হয়ে মারা যায়।

জানা গেছে, দগ্ধ অবস্থায় ষষ্ঠ শ্রেণির ছামীমকে উদ্ধার করতে পেরেছিল তার পরিবার। একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে নেওয়া হচ্ছিল হাসপাতালে। পথেই ছটফট করতে করতে তার মৃত্যু হয়। পরে গতকাল মঙ্গলবার তার লাশ গ্রামের বাড়ি দাফন করা হয়।

বিজ্ঞাপন

শিশুটির মা জুলেখা বেগম অশ্রুভেজা কণ্ঠে বলেন, ছামীমকে কোলে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ব্যথার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা ছেলেটি শুধু বলছিল-‘মা, হাসপাতাল এত দূরে কেন মা? এত দূরে হলে তো মানুষ মরে যাবে মা, অ্যাম্বুলেন্সে এসি নাই কেন মা? কেমন বাংলাদেশ মা? আমাকে বিদেশে নিয়ে যাও মা।’

জুলেখা বেগম বলেন, আমার ছেলেটা বারবার বলছিল—‘মা, তুমি আমার সঙ্গে থাকবা তো হাসপাতালে?’ আমি বলেছিলাম হ্যাঁ, থাকব বাবা। কিন্তু আমি তো আর থাকতে পারলাম না। মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে শিশুটি আমাকে কত কথাই না বলল, আমি শুধু শুনলাম। ওর জন্য কিছুই করতে পারলাম না। কোলেই ছটফট করতে করতে ছেলেটি নিথর হয়ে গেল আর চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল ওর কণ্ঠ। আর কোনো কথাও বলল না, অভিযোগও দিল না। বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে গেল।

তিনি আরো বলেন, ‘সাত মাস আগে আমার স্বামী মারা গেল, এখন ছেলেটাও চলে গেল। আমার তো আর কিছুই রইল না। ছামীমের বাবা মারা যাওয়ার পর ছেলেটি পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। ওকে সান্ত্বনা দিতে না পেরে অবশেষে ঢাকায় পাঠিয়ে দেই। গ্রামে আমার সঙ্গে থাকত শুধু বড় মেয়ে। কিছুদিন পর বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েটি অন্যের বাড়ি চলে যাবে। বড় ছেলে ঢাকায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এই পৃথিবীতে আমি বড় একা হয়ে গেলাম।’

নিহতের বড় ভাই রাফসান বলেন, ‘মাত্র ১৩ বছরের এই কিশোর লেখাপড়ায় ছিল অত্যন্ত আগ্রহী, মেধাবী ও ভদ্র। ও খুব শান্ত ছিল। সারাক্ষণ পড়াশোনা আর মায়ের পাশে বসে থাকত। বাবা মারা যাওয়ার পর যেন আরো দায়িত্বশীল হয়ে উঠেছিল। আজ ও নেই, সেটা বিশ্বাসই করতে পারছি না।’

গতকাল সকালে নিজ গ্রামের বাড়ি মাঝিকান্দিতে ছামীমের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়। জানাজায় অংশ নেন গ্রামের শত শত মানুষ। কাঁদতে কাঁদতে সবাই বলছিলেন, ‘বাচ্চাটা আমাদের সবার পরিচিত ছিল, হাসিখুশি একটা ছেলে ছিল।’

গ্রামের মসজিদের ইমাম হাফেজ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ছেলেটি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত, মায়ের খুব আজ্ঞাবহ ছিল। এমন একটি নিষ্পাপ প্রাণ এভাবে চলে যাবে, মানতে কষ্ট হচ্ছে।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য কাওসার মৃধা বলেন, ‘এই দুর্ঘটনা শুধু একটি পরিবারের সর্বনাশ নয়, আমাদের সমাজকেই নাড়া দিয়েছে। আমাদের এখানে ভালো চিকিৎসা নেই, অ্যাম্বুলেন্সে যন্ত্রপাতি নেই—শিশুটির শেষ কথাগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে সেই বাস্তবতাই দেখিয়ে দিয়েছে।’

শিশুটির মামা সাইফুল ইসলাম কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমার ছোট ভাগনের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। তার বাবার মৃত্যুর পর আমরা সবাই ওকে আগলে রাখছিলাম কিন্তু আজ ও নিজেই আমাদের থেকে অনেক দূরে চলে গেল। রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন—এমন দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটল? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আকাশে কীভাবে প্রশিক্ষণ বিমান উড়তে পারে?’

ভেদরগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ভারপ্রাপ্ত ইউএনও মোহাম্মদ মোজাহেরুল হক বলেন, ‘মাইলেস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা নিহতের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমরা সব সময় শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে থাকব।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত