গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগের হিড়িক

মাহবুব হোসেন সারমাত, গোপালগঞ্জ
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ০০

স্বাধীনতার পর থেকে গোপালগঞ্জে রাজত্ব ছিল আওয়ামী লীগের। যুগ যুগ এখানকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রায় সব পদ এই আদর্শের লোকদের দখলে ছিল। জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সে ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে। আগের মতো ঘটা করে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেখা যাচ্ছে না।

এই পরিচয়ে কেউ আর প্রভাবও বিস্তার করতে পারছে না। এবার হিড়িক পড়েছে আওয়ামী পরিচয় মুছে ফেলার। কয়েকদিন পরপর পদত্যাগ করছেন দলবেঁধে। গত এক সপ্তাহেই পদ ছেড়েছেন অন্তত ১৫ জন। এর পেছনে অনুশোচনা বোধের চেয়ে মামলাবাণিজ্য ও চাঁদাবাজি বড় কারণ বলে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দিশাহারা হয়ে পড়েন দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। সেই থেকে এক বছরে প্রায় সব শাখার শীর্ষ নেতারা পালালেও গোপালগঞ্জের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। অধিকাংশ নেতাকর্মী এখনো সেখানে অবস্থান করছেন এবং মাঝে মধ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবস্থান জানান দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এর অংশ হিসেবে সর্বশেষ গত ১৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ ঘিরে তাণ্ডব চালায় সন্ত্রাসীরা।

এসব সহিংসতার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতাকে হত্যার ঘটনায় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নামে ২০টি মামলা হয়েছে। এতে শত শত নেতার নাম উল্লেখসহ ২২ হাজার আওয়ামী নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। তাদের যেখানেই পাওয়া যাচ্ছে, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এছাড়া মামলাগুলোকে কেন্দ্র করে ব্যাপক চাঁদাবাজি ও বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এসব কারণে দলটির নেতাকর্মীরা নিজেদের আওয়ামী রাজনৈতিক পরিচয় থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ আবার গা বাঁচাতে ভিড়ছেন বিএনপিতে।

গত শুক্রবার রাতে জেলার মুকসুদপুর পৌর আওয়ামী লীগের ওয়ার্ডপর্যায়ের পাঁচ নেতা পদত্যাগের ঘোষণা দেন। উপজেলা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তারা নিজ নিজ পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এ নিয়ে দলটির ১৮ নেতা পদত্যাগ করলেন। তাদের মধ্যে ১৫ জন গত এক সপ্তাহে দলীয় পরিচয় ত্যাগ করেন।

এর আগে গত ২১ আগস্ট একই উপজেলার ননীক্ষীর ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আট নেতা সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। একই দিন ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দেন টুঙ্গিপাড়া উপজেলার ডুমরিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আবদুর রহমান শিকদার। এর আগে মুকসুদপুর পৌরসভার এক আওয়ামী লীগ নেতা দল থেকে নাম কাটেন।

পদত্যাগ করা নেতাদের মধ্যে আছেনÑমুকসুদপুর পৌর আওয়ামী লীগের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও সাবেক পৌর কাউন্সিলর নিয়ামত খান, ২ নম্বর ওয়ার্ডের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জামাল হোসেন মুন্সী, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি পরিমল সাহা, সাধারণ সম্পাদক শান্ত সাহা ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শফিকুল ইসলাম, ননীক্ষীর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মনোজ মৌলিক, কাজী মিজানুর রহমান, সহপ্রচার সম্পাদক রাসেল শেখ, সদস্য স্বপন শেখ, একই ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নুর আলম মিয়া, ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুবল রায়, ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক আক্কাস চোকদার, ননীক্ষীর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জলিল কাজী প্রমুখ।

মুকসুদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক হায়দার হোসেন বলেন, সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দিয়ে দল থেকে পদত্যাগ করা যায় না। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পদত্যাগ করলে সেটি গ্রহণ করা হবে। তাদের অবশ্যই ঊর্ধ্বতন নেতার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে হবে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় দায়ের হওয়া ২০ মামলা নিয়ে বিএনপির এক নেতার ইশারায় চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলেই মুকসুদপুরে আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মী ও সমর্থকদের গ্রেপ্তার-হয়রানি করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ত্যাগ করার এটিই বড় কারণ। এছাড়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য তারা বিএনপিতে ঢোকার চেষ্টা করছেন। তবে এমন দুই-একশ নেতা চলে গেলে আওয়ামী লীগের কোনো ক্ষতি হবে না।

হয়রানির শিকার হওয়ার ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলাকে কেন্দ্র করে ১৫টি, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক শওকত আলী দিদার হত্যাকাণ্ডে তিনটি এবং সেনাবাহিনীর গাড়ি ভাঙচুর, হামলা ও অস্ত্র ছিনতাইয়ের ঘটনায় একটি এবং সড়ক অবরোধের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। মামলাগুলো সদর থানায় হলেও মুকসুদপুর থানার ওসি এবং বিএনপির স্থানীয় এক শীর্ষ নেতা পরস্পর যোগসাজশে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় করছেন। টাকা না দিলে গ্রেপ্তার করে সদর থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিএনপি নেতার চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিলে কোনো সমস্যা নেই। এ কারণে অনেকে দল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।

মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শরীফ রফিক উজ্জামান বলেন, গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান সৎ মানুষ। তবে মুকসুদপুরসহ বিভিন্ন থানায় পুলিশের বিরুদ্ধে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ আছে। এতে আমাদের কোনো নেতাকর্মী জড়িত নয়। কারো বিরুদ্ধে প্রমাণ পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মুকসুদপুর থানার ওসি মোস্তফা কামাল বলেন, মুকসুদপুরে অযথা কাউকে গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হচ্ছে না। শুধু অপরাধীদের ধরা হচ্ছে। একটি প্রতারকচক্র পুলিশের নাম ভাঙিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি বা গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করছে। বিকাশেও টাকা নিচ্ছে বলে শুনেছি। সে বিষয়ে আমরা সাধারণ মানুষকে সতর্ক করছি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত