গ্রাহকের ২০ কোটি টাকা মেরে ভারতে রঞ্জন মণ্ডল

এহতেশামুল হক শাওন, খুলনা
প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৫১
ছবি: সংগৃহীত

তিন হাজারের বেশি গ্রাহকের সঞ্চিত প্রায় ২০ কোটি টাকা পরিশোধ না করেই ভারতে পালিয়েছেন খুলনার ডুমুরিয়ার হাজিডাঙ্গা আদর্শ গ্রাম উন্নয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি রঞ্জন কুমার মণ্ডল। সম্পত্তি বিক্রির টাকা হাতে পেলে সদস্যদের পাওনা পরিশোধ করবেন বলে জানানোর পরদিন ভোর হওয়ার আগেই লাপাত্তা হন তিনি। এদিকে টাকা না পাওয়ার অনিশ্চয়তা আর হতাশায় অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন অনেকেই। ভুক্তভোগীরা ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, রঞ্জন মণ্ডল গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা মূল্যবান জায়গা লিখে নেওয়ার পর তাকে বাধ্য করা হয় সপরিবারে ভারতে পাড়ি জমাতে। যাওয়ার আগের দিন ডুমুরিয়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে পাঁচ দলিলে লিখে নেওয়া হয় এসব জমি।

বিজ্ঞাপন

দলিল হওয়া জমির মধ্যে ডুমুরিয়া উপজেলা সদরে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ খান বাবুর মোড়ে এক একর ১৫ শতক জমি নিয়েছেন বিএনপি নেতা মোল্লা মোশারফ হোসেন মফিজ। এই জমির মূল্য প্রায় চার কোটি টাকা। সদর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম খানের ছেলের নামেও দলিল হয়েছে। আড়াই মাস আগের এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা নানা জায়গায় ধরনা দিয়েও টাকা ফেরত না পেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন।

জানা গেছে, মোল্লা মোশারফ হোসেন মফিজ উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। বিএনপি নেতা হয়েও সাবেক মন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা নারায়ণ চন্দ্র চন্দের সঙ্গে সখ্যের অভিযোগ ছিল। চব্বিশের ৫ আগস্টের পর নারায়ণ চন্দ্র পালিয়ে গেলে তার ব্যবহৃত গাড়ি মফিজের গ্যারেজ থেকে উদ্ধার করা হয়। এছাড়া তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগে ২০২৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর জেলা আহ্বায়ক পদ থেকে অব্যাহতি দেয় বিএনপি। ১৮ দিনের মাথায় কেন্দ্র থেকে জেলা কমিটি বিলুপ্ত করলে তিনি সব দলীয় পদ হারান। বিএনপির কোনো পদে না থেকেও এলাকার সব সেক্টরে মোল্লা পরিবারের অব্যাহত দাপটে অন্যরা কোনঠাসা হয়ে রয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, সমিতিতে তিন হাজারের বেশি সদস্য বিভিন্ন মেয়াদে টাকা জমা রেখেছেন। অধিকাংশ সদস্যের বইয়ে স্কিমের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অনেকের কিছু মাস বাকি আছে। স্কিম শেষ হওয়া গ্রাহকরা পাওনা টাকা চাইতে গেলে সমিতি কর্তৃপক্ষ বিভিন্নভাবে সময়ক্ষেপণ করে।

গত ১৩ আগস্ট সমিতি অফিসে গিয়ে পাওনা টাকা চাইলে রঞ্জন মণ্ডল জমি বিক্রি করে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ করবেন বলে জানান। কিন্তু পরদিন প্রভাবশালী কিছু লোক একটি কালো গ্লাসের মাইক্রোবাসে করে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে রঞ্জন মণ্ডলকে নিয়ে যায়। এরপর হেলমেট পরিহিত অবস্থায় গাড়ি থেকে নামিয়ে তাকে সাব-রেজিস্ট্রারের সামনে নেওয়া হয়। পরে বিএনপি নেতা মোল্লা মোশারফ হোসেন মফিজ, শান্তনু রায়, সাইফুর রহমান খান, গোবিন্দ মণ্ডল ও অসীম মণ্ডল তার কাছ থেকে জমি লিখে নেন।

এ সংবাদ পেয়ে গ্রাহকরা রঞ্জনের বাড়িতে গেলে তিনি জানান, জমি লিখে দিলেও কেউ আমাকে এক টাকাও দেয়নি। ওরা আমাকে ১৫ আগস্ট সকালে টাকা দেবে। আপনারা সকালে আসুন, টাকা দিয়ে দেব। যথাসময় আমরা ওইদিন সমিতির কার্যালয় উপস্থিত হলে জানতে পারি রঞ্জন মণ্ডল রাতেই ভারতে পালিয়ে গেছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলা সদরের থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ফায়ার ব্রিগেড স্টেশনের মাঝামাঝি খুলনা-সাতক্ষীরা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে রঞ্জনের মালিকানাধীন এ অঞ্চলের একমাত্র আটতলা ভবনে হাজিডাঙ্গা আদর্শ গ্রাম উন্নয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতির নিজস্ব অফিস। এক সময় ডুমুরিয়া বাজারে তৃষ্ণা মিষ্টান্ন ভান্ডার পরিচালনা করতেন তিনি। ব্যবসায় বেশ পরিচিতি থাকলেও মিষ্টি বিক্রির আড়ালে ২০০৫ সালের দিকে সমিতি খুলে সুদের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠলে সমবায় অফিসের নিবন্ধন পান।

একদিকে নিবন্ধন পাওয়া, অন্যদিকে একের পর এক জমি কেনা ও সম্পত্তি বাড়তে থাকায় দিন দিন গ্রাহকও বাড়তে থাকে। সমিতির নামে কেনেন ১০টি যাত্রীবাহী বাস। এতে গ্রাহকের কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা জমা হয়। এসব টাকা তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীকে চড়া সুদে ঋণ দিতেন। তবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রায় সবাই ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দেন। এতে সঞ্চয়ী গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে চাপে পড়েন রঞ্জন।

জমা বই হাতে নিয়ে প্রায় দিনই সমিতি অফিসের সামনে হাজির হন তরুণ বিশ্বাস, শম্পা, বাসন্তী, হরিদাস ফৌজদার, দীপংকর কুমার, প্রেমদাস, পুষ্প রানি, শর্মিলা রায়সহ অনেকেই। সর্বনিম্ন এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১৬-১৭ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা রয়েছে তাদের। টানা না পাওয়ার অনিশ্চয়তা আর হতাশায় অনাহারে-অর্ধাহারে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেকেই।

ভুক্তভোগীরা জানান, জমি যারা লিখে নিয়েছে, তাদের কাছ থেকে ওই আটতলা বাড়ির ভাড়া ওঠে মাসে ৬০ হাজার টাকা। তা থেকে এবং আরো যেসব সম্পত্তি আছে, একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এগুলো বিক্রি করে আমাদের টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব। এ জন্য শুধু প্রশাসনকে একটু আন্তরিক আর উদ্যোগী হতে হবে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে যোগাযোগ করা হলে বিএনপি নেতা মোল্লা মোশারফ হোসেন মফিজ জমি কেনার কথা স্বীকার করে বলেন, জমির দাম ৮০-৯০ লাখ টাকা। আমার কাছ থেকে ৪০-৪৫ লাখ টাকা নিয়েছে রঞ্জন। বাকি টাকা আমি সমিতির পাওনাদারদের পরিশোধ করব বলে কথা হয়েছে।

গত আড়াই মাসে কতজনকে টাকা দিয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, এখনো কাউকে দিইনি, শিগগির দেওয়া শুরু করব। তার বিরুদ্ধে একটি পক্ষ অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করে মফিজ বলেন, দলের ভেতর থেকে শত্রুতা করে তার নামে বদনাম করা হচ্ছে।

ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আল আমিন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এটা খুব বড় এক ইস্যু। অনেক মানুষ এর সঙ্গে জড়িত। সমিতির নামে অনেক সম্পত্তি আছে। একটা কমিটি গঠন করে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত দেওয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তা করছি।

তিনি বলেন, প্রচলিত আইন অনুযায়ী জমি রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে তা আটকানো যায় না। তবে যারা কিনেছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে কিছু করা যায় কি না দেখা হবে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত