
জালাল খান ইউসুফী

মধ্যযুগের পুঁথি ছিল আধুনিক যুগের উপন্যাসের মতোই বিষয়-আশয়ে ঠাসা। পার্থক্য শুধু সুর-ছন্দ-অন্ত্যমিলের। উপন্যাস রচিত হয় কথার পর কথা সাজিয়ে; আর পুঁথি রচিত হতো সুর-ছন্দ-অন্ত্যমিলের সংমিশ্রণে, যা পড়লে মানুষ সহজেই আকৃষ্ট হতো, এখনো হয়। আকৃষ্ট হওয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সুর। মধ্যযুগের পুঁথিকে আমরা মধ্যযুগের উপন্যাস বলে অভিহিত করতে পারি।
১৮০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিকাশিত হতে শুরু করে সাহিত্যিক গদ্য। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষক লেখকেরা সুপরিকল্পিতভাবে রচনা করেন সংস্কৃত শব্দবহুল বাংলা গদ্যের বিশেষ ধারা—সংস্কৃতায়িত বাংলা। আগে যেভাবে সন্ধ্যার পর লণ্ঠন, ল্যাম্প বা কুপি জ্বালিয়ে একজন সুর করে পুঁথি পাঠ করতেন আর শ্রোতারা গোল হয়ে বসে সুর আর কাহিনির মাঝে ডুবে যেতেন, সেভাবেই গদ্যপাঠ শুরু হলো বাংলার ঘরে ঘরে। গদ্যের প্রভাবে হারিয়ে যেতে লাগল পুঁথিকাব্য। কিন্তু বাঙালি জাতির যেমন মাছ-ভাত ছাড়া চলে না, তেমনি মনোরঞ্জনের জন্যেও সুর তাদের প্রধান ভালো লাগা, যা তাদের মেধা ও মননে আজও একাকার হয়ে আছে। অর্ধ শতাব্দীর সমিল কবিতার সুরেলা ধারায় মুগ্ধ বাঙালি মন অসুরে কি তৃপ্ত হয়! পুঁথির আশেক শ্রোতারাই তখন সংস্কৃতায়িত বাংলা গদ্য-পদ্যকে শহরের কোলাহলে রেখে গ্রামের আঙিনায়, হাঁটে-বাজারে, মেলা-মাহফিলে সুরের মিশ্রণে ছোটগল্পের আদলে লিখতে শুরু করল ছোট ছোট পুঁথি। পড়তে শুরু করল পূর্বের সেই পুঁথির মতো করে লণ্ঠন জ্বালিয়ে, গ্রামের মানুষের ভিড়ে।
মধ্যযুগের দীর্ঘ দীর্ঘ পুঁথি প্রতিদিন শুনতে শুনতে ক্লান্ত হলেও, ভালো লাগলেও গল্পের সমাপ্তির জন্য অপেক্ষায় থাকতে হতো। সারা রাত ধরে শুনেও শেষ হতো না। অথচ ছোট আকারের পুঁথিটি অল্প সময়ে শেষ হয়ে যেত। আর সেই স্বল্পপরিসরের পুঁথিটি গ্রামবাংলার কৃষক-চাষি-মজুরের মনোরঞ্জনে অগ্রণী ভূমিকা রাখায় ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। তাই রচয়িতাদের কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে ছাপিয়ে হাটে-বাজারে এক আনা-দুই আনায় বিক্রি করতে শুরু করলেন। কখনো দেখা যেত হাটের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পুঁথির লেখক সুর করে পড়ছেন আর তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনছে হাটুরে লোকজন, একপর্যায়ে কাহিনির আকর্ষণীয় স্থানে এসে গাহক থামতেন। বাকি কাহিনি জানার জন্য এক পয়সা, দুই পয়সায় কিনে নিয়ে পড়ার আহ্বান জানালে ছোট আকারের সেই চারপাতার বইটি কেনার হিড়িক লেগে যেত। এভাবেই পুঁথি থেকে পথকাব্যের উদ্ভব ঘটে এবং সেই পথকাব্যটি গ্রামবাংলার মানুষের কাছে হয়ে ওঠে মনোরঞ্জনের জনপ্রিয় মাধ্যম।
গ্রামবাংলার মাটি ও মানুষের মনোরঞ্জনের এ মাধ্যমটিকে কেউ বলেন হাট-কবিতা, কেউ বলেন ভাট-কবিতা, পুঁথি-কবিতা, হাটুরে পুঁথি, সিকুলি, কবিতা, খবি ইত্যাদি। আবার কেউ কেউ একে পথ-কবিতা বলেও আখ্যায়িত করেছেন। আমি এর নামকরণ করেছি পথকাব্য। কারণ পুঁথি থেকে পথকাব্যের উদ্ভব। পথকাব্যের কবি ও মধ্যযুগের পুঁথিকারদের মেধা দক্ষতার বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, পুঁথিকাব্যের কবিরাই শীর্ষ মেধাবী। এ ধারার কবিরাই পনেরোটিরও বেশি সুরের উদ্ভব ঘটিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, তারা গাইতেন স্মৃতি থেকে। তিন-চার পাতা, আধা ফর্মা, এক ফর্মার পথকাব্য মুখস্থ গেয়ে শোনানো অবশ্যই মেধাবীদের কাজ। মধ্যযুগে যে পুঁথি রচিত হতো তা যদিও বহু ছন্দে রচনা হয়েছে, কিন্তু প্রধানত দুটি সুরেই লিখিত ও গ্রন্থিত হতে দেখা যায়। একটি পয়ার সুর, অন্যটি ত্রিপদী। পয়ার সুরটি সেই সময় থেকে আজও গ্রামবাংলার মানুষের কাছে এতটাই জনপ্রিয় যে, এখনো কেউ এ সুরে পুঁথি পড়লে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শোনেন। অথচ পুঁথিকাব্যের আরো কত সুর পড়ে আছে আমরা জানি না। পরিচিত পয়ার সুরের কয়েক লাইন—
প্রথমে প্রণাম করি এক করতার।
যেই প্রভু জীবদানে স্থাপিলা সংসার॥
করিলা সর্বাগ্রে আদি জ্যোতির প্রকাশ।
তার পরে প্রকট করিলা কবিলাষ॥
সৃজিলেক অনল পবন জল ক্ষিতি।
নানা রঙ্গ সৃজিলা করিয়া নানা ভিতি॥
(পদ্মাবতী, মহাকবি আলাওল)
ত্রিপদী সুরটিও অনেকের কাছে পরিচিত। তবে পয়ার সুরের মতো এত জনপ্রিয় নয়। গাজিকালু ও চম্পাবতীর পুঁথি থেকে ত্রিপদী সুরের কয়েক স্তবক—
বৈরাট নগরে ধাম শাহা সেকান্দর নাম
রূপে যিনি পূর্ণ শশধর ॥
নগরের শোভা তার অতিশয় চমৎকার
স্বর্গতুল্য দেখিতে সুন্দর ॥
ছিল শাহা হেন ধনী ধনেতে কারূন যিনি
দাতা ছিল হাতেম সমান ॥
শক্তি হেন ছিল তার রোস্তম হারিবে আর
হারিবেক শ্যাম নূরিমান ॥
অথচ পথকাব্যে দেখা যায় তার ব্যতিক্রম। বিভিন্ন অঞ্চলের কবিকারগণ বিভিন্ন সুরে রচনা করে বিভিন্ন সুরে গেয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য সুর হিসেবে এক একটি সুরকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। কবি ইউসুফ খানের জনপ্রিয় পথকাব্য আনারকলি থেকে—
রাত্র নিশার কালে (২) কদম ডালে কোকিল করে গান
কোকিল পাখির করুণ সুরে উড়িল পরান।
কতো ভাইটাল সুরে (২) সুন্দর করে শোনায় তাহার বুলি
আমের ডালায় বইসা আবার ডাকতে ছিল কুলি।
আমার ভাঙ্গা ঘরে...
এ সুরটি বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামেও জনপ্রিয়। সব কবিরাই এ সুরের নামকরণ করেছেন কবিতার সুর বলে। আর আমি বলি সহজ সুর। এ কারণে যে, এ সুরটি একবার শুনলেই যে কেউ সহজে রপ্ত করে ফেলতে পারেন। অন্য একটি সুর—
তেরশ পঁয়ষট্টি সালে এই ঘটনা বরিশালে
হইয়াছিল পাতারহাট থানায়
সেই দেশের এক বৃদ্ধ ছিল গরিব ছিল অতিশয়
পঞ্চাশের উপরে বয়স ও বৃদ্ধ কামলা খেটে খায়।
কবি সুলাইমান খোয়াজপুরীর গরিবের ছেলে শাহজাহান কবিতার উদ্ধৃতি। এটি ধুয়ার সুর নামে পরিচিত এবং দক্ষিণবঙ্গের অত্যন্ত জনপ্রিয় সুর। অন্য অঞ্চলের পাঠকদের কাছে এ সুর কঠিন। তেমনি রংপুর, জামালপুর, ঈশ্বরদী, পাবনায় জনপ্রিয় সুরটির নাম বন্ধু হে। কবি আমজাদ হোসেনের রিকশাওয়ালা জলিল মিয়া ও ফুলমালার প্রেমের কবিতার উদ্ধৃতি—
রংপুর জেলাতে হইল আশ্চর্য ঘটনা
গ্রামের নামটি লক্ষ্মণবাড়ি বদরগঞ্জ থানা
ফুলমালার কথা আমি করিলাম রচনা। বন্ধু হে
এভাবে একেক এলাকার একেকজন পুঁথিকবি একেকটি সুরে পথকাব্য রচনা করে গেছেন। হাটে-বাজারে ঘুরে-ফিরে গেয়েছেন আর তাঁর শ্রোতা পাঠকরা সেই সুর রপ্ত করেছে। এভাবে প্রায় ১৫টি সুর আমার গবেষণায় উঠে এসেছে, যা আমার গাওয়া এবং লেখায় সাধনা করছি। যদিও পুঁথি ও পথকাব্য মিলিয়ে সুরের সংখ্যা সত্তরোর্ধ্ব। আমার গবেষণার বিষয় এ ৭০টি সুর ও ছন্দ। ১৫টি সুর ও ছন্দ ব্যবহারে রচিত আমার ‘পুঁথিকাব্যে সাত বীরশ্রেষ্ঠ জীবনী’ গ্রন্থটি।
পথকাব্যের স্বর্ণযুগ ছিল বিংশ শতাব্দীর পাঁচ দশক পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি। তবে নব্বই দশক ছিল বিলুপ্তির। এ সময় হাটে, বাজারে, লঞ্চে, বাসে, রেলে এবং কী রিকশায় মাইক লাগিয়ে পথে পথেও বিক্রি হতে দেখা যায়। ওই সময় যুবক, বুড়ো, কিশোর, বালক—সবাই পথকাব্যের সঙ্গে পরিচিত ছিল। কিন্তু কালের করালগ্রাসে তা এখন বিলুপ্ত। বাংলা সাহিত্যের একসময়ের বহুল জনপ্রিয় পথকাব্যের সঙ্গে এ সময়ের প্রজন্ম একেবারেই অপরিচিত। অথচ এ পথকাব্য একসময় গ্রামবাংলার মাটি ও মানুষের মাঝে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ বিলুপ্ত পথকাব্যকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমির নজর দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আমার সংগ্রহে শতাধিক পুঁথিকবির তিন শতাধিক পথকাব্য জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। এ সংগ্রহ একদিন নষ্ট হয়ে গেলে বাংলা সাহিত্যের এ লোকজ ঐতিহ্য একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যদিও আমার কাছে থেকে দু-একজন গবেষক কিছু পথকাব্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন গবেষণাগ্রন্থে যুক্ত করেছেন।
বিলুপ্তপ্রায় বাংলা সাহিত্যের এ অনন্য ধারায় উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেন—এ কে গণী কলম্বী, আব্দুল মজিদ কলম্বী, মোকছেদ আলী, সুলাইমান খোয়াজপুরী, আব্দুল করিম খান, ইউসুফ খান, গাজী মিজানুর রহমান, সেকান্দার আলী খলিফা, মোহাম্মদ হারিছ উদ্দিন, মো. সিরাজ উদ্দীন, এমএ মতিন, মাস্টার শাহ আলম, জালাল খান ইউসুফী প্রমুখ। তাদের কেউ কেউ লঞ্চে, বাসে ও রেলে গেয়ে গেয়ে পথকাব্য বিক্রি করতেন, কেউ কেউ হাটে-বাজারে মজমা করে কবিতা পড়তেন। অনেকে লিখে ছাপাতেন, গাহকরা তাঁদের থেকে কিনে নিয়ে হাটে-বাজারে বিক্রি করতেন।
কবি এ কে গণি কলম্বী এবং কবি আব্দুল মজিদ কলম্বী—এ দুজন কবিকে আমরা পথকাব্যের কিংবদন্তি বলেও অভিহিত করতে পারি। এ দুজন কবি ছিলেন সহোদর। বড় জন ছিলেন এ কে গণি কলম্বী। তিনি লম্বায় ছিলেন ছয় ফুটের বেশি, ছোট ভাই আব্দুল মজিদ কলম্বী ছিলেন চার ফুটের বেশি। তাদের পূর্বপুরুষগণ কলম্বোর অধিবাসী ছিলেন। তারা তৎকালীন সিলেটের বড়লেখার জুড়িতে বসবাস করার সুবাদে এ দুই কিংবদন্তি কবির জন্ম হয়েছিল বড়লেখার জুড়িতে। তাদের পূর্বপুরুষদের কেউ সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না, তার কোনো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এ দুই সহোদর কবি কবিতা লিখে প্রিন্ট করে হাটে-বাজারে মজমা করে গেয়ে গেয়ে বিক্রি করতেন। এক ভাই পুঁথির একটি লাইন গেয়ে থেমে গেলে অপরজন পরবর্তী লাইনটিতে সুর দিতেন, তাতে মানুষ আকর্ষিত হতো বেশি। এর কারণ হিসেবে কাজ করত একজন লম্বা মানুষ আর অন্যজন বেঁটে মানুষ, দুজনের পুঁথি পাঠের ঢং মানুষ দাঁড়িয়ে শুনত। হাটে-বাজারে বটতলায় বাজারের এক কোণে খালি জায়গায় বসত তাদের পুঁথিপাঠ ও বিক্রির আসর। দুই ভাই শুধু বৃহত্তর সিলেট নয়, সারা বাংলা চষে বেড়াতেন, যেকোনো অঞ্চলে গিয়ে এক মাস-দু’মাস অবস্থান করতেন। পথকাব্যকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার পেছনে এ দুজনের ভূমিকা অগ্রগণ্য। চার পাতার পুঁথি বিক্রি শেষ হলে ওই এলাকাতেই প্রেস খুঁজে বের করে যে এলাকায় অস্থায়ীভাবে থাকতেন, সে স্থানের ঠিকানা দিয়ে কাব্য ছাপানো হতো। ফলে তাদের কাব্যের সূত্র ধরে লোকসাহিত্য গবেষক মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ পাঠান তাঁর একটি গবেষণা গ্রন্থে এ কে গণি কলম্বী নোয়াখালী চৌমুহনী অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন বলে ‘সম্ভবত’ শব্দ ব্যবহার করে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের কর্মের সময়কাল ছিল বিংশ শতাব্দীর ৫০, ৬০, ৭০, ৮০-র দশক, আর আর পুঁথিকাব্যের স্বর্ণযুগ ছিল বিংশ শতাব্দীর শেষ পাঁচটি দশক। এখন সেই পথকাব্য বিলুপ্তপ্রায়।

মধ্যযুগের পুঁথি ছিল আধুনিক যুগের উপন্যাসের মতোই বিষয়-আশয়ে ঠাসা। পার্থক্য শুধু সুর-ছন্দ-অন্ত্যমিলের। উপন্যাস রচিত হয় কথার পর কথা সাজিয়ে; আর পুঁথি রচিত হতো সুর-ছন্দ-অন্ত্যমিলের সংমিশ্রণে, যা পড়লে মানুষ সহজেই আকৃষ্ট হতো, এখনো হয়। আকৃষ্ট হওয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সুর। মধ্যযুগের পুঁথিকে আমরা মধ্যযুগের উপন্যাস বলে অভিহিত করতে পারি।
১৮০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিকাশিত হতে শুরু করে সাহিত্যিক গদ্য। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষক লেখকেরা সুপরিকল্পিতভাবে রচনা করেন সংস্কৃত শব্দবহুল বাংলা গদ্যের বিশেষ ধারা—সংস্কৃতায়িত বাংলা। আগে যেভাবে সন্ধ্যার পর লণ্ঠন, ল্যাম্প বা কুপি জ্বালিয়ে একজন সুর করে পুঁথি পাঠ করতেন আর শ্রোতারা গোল হয়ে বসে সুর আর কাহিনির মাঝে ডুবে যেতেন, সেভাবেই গদ্যপাঠ শুরু হলো বাংলার ঘরে ঘরে। গদ্যের প্রভাবে হারিয়ে যেতে লাগল পুঁথিকাব্য। কিন্তু বাঙালি জাতির যেমন মাছ-ভাত ছাড়া চলে না, তেমনি মনোরঞ্জনের জন্যেও সুর তাদের প্রধান ভালো লাগা, যা তাদের মেধা ও মননে আজও একাকার হয়ে আছে। অর্ধ শতাব্দীর সমিল কবিতার সুরেলা ধারায় মুগ্ধ বাঙালি মন অসুরে কি তৃপ্ত হয়! পুঁথির আশেক শ্রোতারাই তখন সংস্কৃতায়িত বাংলা গদ্য-পদ্যকে শহরের কোলাহলে রেখে গ্রামের আঙিনায়, হাঁটে-বাজারে, মেলা-মাহফিলে সুরের মিশ্রণে ছোটগল্পের আদলে লিখতে শুরু করল ছোট ছোট পুঁথি। পড়তে শুরু করল পূর্বের সেই পুঁথির মতো করে লণ্ঠন জ্বালিয়ে, গ্রামের মানুষের ভিড়ে।
মধ্যযুগের দীর্ঘ দীর্ঘ পুঁথি প্রতিদিন শুনতে শুনতে ক্লান্ত হলেও, ভালো লাগলেও গল্পের সমাপ্তির জন্য অপেক্ষায় থাকতে হতো। সারা রাত ধরে শুনেও শেষ হতো না। অথচ ছোট আকারের পুঁথিটি অল্প সময়ে শেষ হয়ে যেত। আর সেই স্বল্পপরিসরের পুঁথিটি গ্রামবাংলার কৃষক-চাষি-মজুরের মনোরঞ্জনে অগ্রণী ভূমিকা রাখায় ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। তাই রচয়িতাদের কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে ছাপিয়ে হাটে-বাজারে এক আনা-দুই আনায় বিক্রি করতে শুরু করলেন। কখনো দেখা যেত হাটের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পুঁথির লেখক সুর করে পড়ছেন আর তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনছে হাটুরে লোকজন, একপর্যায়ে কাহিনির আকর্ষণীয় স্থানে এসে গাহক থামতেন। বাকি কাহিনি জানার জন্য এক পয়সা, দুই পয়সায় কিনে নিয়ে পড়ার আহ্বান জানালে ছোট আকারের সেই চারপাতার বইটি কেনার হিড়িক লেগে যেত। এভাবেই পুঁথি থেকে পথকাব্যের উদ্ভব ঘটে এবং সেই পথকাব্যটি গ্রামবাংলার মানুষের কাছে হয়ে ওঠে মনোরঞ্জনের জনপ্রিয় মাধ্যম।
গ্রামবাংলার মাটি ও মানুষের মনোরঞ্জনের এ মাধ্যমটিকে কেউ বলেন হাট-কবিতা, কেউ বলেন ভাট-কবিতা, পুঁথি-কবিতা, হাটুরে পুঁথি, সিকুলি, কবিতা, খবি ইত্যাদি। আবার কেউ কেউ একে পথ-কবিতা বলেও আখ্যায়িত করেছেন। আমি এর নামকরণ করেছি পথকাব্য। কারণ পুঁথি থেকে পথকাব্যের উদ্ভব। পথকাব্যের কবি ও মধ্যযুগের পুঁথিকারদের মেধা দক্ষতার বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, পুঁথিকাব্যের কবিরাই শীর্ষ মেধাবী। এ ধারার কবিরাই পনেরোটিরও বেশি সুরের উদ্ভব ঘটিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, তারা গাইতেন স্মৃতি থেকে। তিন-চার পাতা, আধা ফর্মা, এক ফর্মার পথকাব্য মুখস্থ গেয়ে শোনানো অবশ্যই মেধাবীদের কাজ। মধ্যযুগে যে পুঁথি রচিত হতো তা যদিও বহু ছন্দে রচনা হয়েছে, কিন্তু প্রধানত দুটি সুরেই লিখিত ও গ্রন্থিত হতে দেখা যায়। একটি পয়ার সুর, অন্যটি ত্রিপদী। পয়ার সুরটি সেই সময় থেকে আজও গ্রামবাংলার মানুষের কাছে এতটাই জনপ্রিয় যে, এখনো কেউ এ সুরে পুঁথি পড়লে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শোনেন। অথচ পুঁথিকাব্যের আরো কত সুর পড়ে আছে আমরা জানি না। পরিচিত পয়ার সুরের কয়েক লাইন—
প্রথমে প্রণাম করি এক করতার।
যেই প্রভু জীবদানে স্থাপিলা সংসার॥
করিলা সর্বাগ্রে আদি জ্যোতির প্রকাশ।
তার পরে প্রকট করিলা কবিলাষ॥
সৃজিলেক অনল পবন জল ক্ষিতি।
নানা রঙ্গ সৃজিলা করিয়া নানা ভিতি॥
(পদ্মাবতী, মহাকবি আলাওল)
ত্রিপদী সুরটিও অনেকের কাছে পরিচিত। তবে পয়ার সুরের মতো এত জনপ্রিয় নয়। গাজিকালু ও চম্পাবতীর পুঁথি থেকে ত্রিপদী সুরের কয়েক স্তবক—
বৈরাট নগরে ধাম শাহা সেকান্দর নাম
রূপে যিনি পূর্ণ শশধর ॥
নগরের শোভা তার অতিশয় চমৎকার
স্বর্গতুল্য দেখিতে সুন্দর ॥
ছিল শাহা হেন ধনী ধনেতে কারূন যিনি
দাতা ছিল হাতেম সমান ॥
শক্তি হেন ছিল তার রোস্তম হারিবে আর
হারিবেক শ্যাম নূরিমান ॥
অথচ পথকাব্যে দেখা যায় তার ব্যতিক্রম। বিভিন্ন অঞ্চলের কবিকারগণ বিভিন্ন সুরে রচনা করে বিভিন্ন সুরে গেয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য সুর হিসেবে এক একটি সুরকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। কবি ইউসুফ খানের জনপ্রিয় পথকাব্য আনারকলি থেকে—
রাত্র নিশার কালে (২) কদম ডালে কোকিল করে গান
কোকিল পাখির করুণ সুরে উড়িল পরান।
কতো ভাইটাল সুরে (২) সুন্দর করে শোনায় তাহার বুলি
আমের ডালায় বইসা আবার ডাকতে ছিল কুলি।
আমার ভাঙ্গা ঘরে...
এ সুরটি বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামেও জনপ্রিয়। সব কবিরাই এ সুরের নামকরণ করেছেন কবিতার সুর বলে। আর আমি বলি সহজ সুর। এ কারণে যে, এ সুরটি একবার শুনলেই যে কেউ সহজে রপ্ত করে ফেলতে পারেন। অন্য একটি সুর—
তেরশ পঁয়ষট্টি সালে এই ঘটনা বরিশালে
হইয়াছিল পাতারহাট থানায়
সেই দেশের এক বৃদ্ধ ছিল গরিব ছিল অতিশয়
পঞ্চাশের উপরে বয়স ও বৃদ্ধ কামলা খেটে খায়।
কবি সুলাইমান খোয়াজপুরীর গরিবের ছেলে শাহজাহান কবিতার উদ্ধৃতি। এটি ধুয়ার সুর নামে পরিচিত এবং দক্ষিণবঙ্গের অত্যন্ত জনপ্রিয় সুর। অন্য অঞ্চলের পাঠকদের কাছে এ সুর কঠিন। তেমনি রংপুর, জামালপুর, ঈশ্বরদী, পাবনায় জনপ্রিয় সুরটির নাম বন্ধু হে। কবি আমজাদ হোসেনের রিকশাওয়ালা জলিল মিয়া ও ফুলমালার প্রেমের কবিতার উদ্ধৃতি—
রংপুর জেলাতে হইল আশ্চর্য ঘটনা
গ্রামের নামটি লক্ষ্মণবাড়ি বদরগঞ্জ থানা
ফুলমালার কথা আমি করিলাম রচনা। বন্ধু হে
এভাবে একেক এলাকার একেকজন পুঁথিকবি একেকটি সুরে পথকাব্য রচনা করে গেছেন। হাটে-বাজারে ঘুরে-ফিরে গেয়েছেন আর তাঁর শ্রোতা পাঠকরা সেই সুর রপ্ত করেছে। এভাবে প্রায় ১৫টি সুর আমার গবেষণায় উঠে এসেছে, যা আমার গাওয়া এবং লেখায় সাধনা করছি। যদিও পুঁথি ও পথকাব্য মিলিয়ে সুরের সংখ্যা সত্তরোর্ধ্ব। আমার গবেষণার বিষয় এ ৭০টি সুর ও ছন্দ। ১৫টি সুর ও ছন্দ ব্যবহারে রচিত আমার ‘পুঁথিকাব্যে সাত বীরশ্রেষ্ঠ জীবনী’ গ্রন্থটি।
পথকাব্যের স্বর্ণযুগ ছিল বিংশ শতাব্দীর পাঁচ দশক পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি। তবে নব্বই দশক ছিল বিলুপ্তির। এ সময় হাটে, বাজারে, লঞ্চে, বাসে, রেলে এবং কী রিকশায় মাইক লাগিয়ে পথে পথেও বিক্রি হতে দেখা যায়। ওই সময় যুবক, বুড়ো, কিশোর, বালক—সবাই পথকাব্যের সঙ্গে পরিচিত ছিল। কিন্তু কালের করালগ্রাসে তা এখন বিলুপ্ত। বাংলা সাহিত্যের একসময়ের বহুল জনপ্রিয় পথকাব্যের সঙ্গে এ সময়ের প্রজন্ম একেবারেই অপরিচিত। অথচ এ পথকাব্য একসময় গ্রামবাংলার মাটি ও মানুষের মাঝে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ বিলুপ্ত পথকাব্যকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমির নজর দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আমার সংগ্রহে শতাধিক পুঁথিকবির তিন শতাধিক পথকাব্য জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। এ সংগ্রহ একদিন নষ্ট হয়ে গেলে বাংলা সাহিত্যের এ লোকজ ঐতিহ্য একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যদিও আমার কাছে থেকে দু-একজন গবেষক কিছু পথকাব্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন গবেষণাগ্রন্থে যুক্ত করেছেন।
বিলুপ্তপ্রায় বাংলা সাহিত্যের এ অনন্য ধারায় উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেন—এ কে গণী কলম্বী, আব্দুল মজিদ কলম্বী, মোকছেদ আলী, সুলাইমান খোয়াজপুরী, আব্দুল করিম খান, ইউসুফ খান, গাজী মিজানুর রহমান, সেকান্দার আলী খলিফা, মোহাম্মদ হারিছ উদ্দিন, মো. সিরাজ উদ্দীন, এমএ মতিন, মাস্টার শাহ আলম, জালাল খান ইউসুফী প্রমুখ। তাদের কেউ কেউ লঞ্চে, বাসে ও রেলে গেয়ে গেয়ে পথকাব্য বিক্রি করতেন, কেউ কেউ হাটে-বাজারে মজমা করে কবিতা পড়তেন। অনেকে লিখে ছাপাতেন, গাহকরা তাঁদের থেকে কিনে নিয়ে হাটে-বাজারে বিক্রি করতেন।
কবি এ কে গণি কলম্বী এবং কবি আব্দুল মজিদ কলম্বী—এ দুজন কবিকে আমরা পথকাব্যের কিংবদন্তি বলেও অভিহিত করতে পারি। এ দুজন কবি ছিলেন সহোদর। বড় জন ছিলেন এ কে গণি কলম্বী। তিনি লম্বায় ছিলেন ছয় ফুটের বেশি, ছোট ভাই আব্দুল মজিদ কলম্বী ছিলেন চার ফুটের বেশি। তাদের পূর্বপুরুষগণ কলম্বোর অধিবাসী ছিলেন। তারা তৎকালীন সিলেটের বড়লেখার জুড়িতে বসবাস করার সুবাদে এ দুই কিংবদন্তি কবির জন্ম হয়েছিল বড়লেখার জুড়িতে। তাদের পূর্বপুরুষদের কেউ সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না, তার কোনো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এ দুই সহোদর কবি কবিতা লিখে প্রিন্ট করে হাটে-বাজারে মজমা করে গেয়ে গেয়ে বিক্রি করতেন। এক ভাই পুঁথির একটি লাইন গেয়ে থেমে গেলে অপরজন পরবর্তী লাইনটিতে সুর দিতেন, তাতে মানুষ আকর্ষিত হতো বেশি। এর কারণ হিসেবে কাজ করত একজন লম্বা মানুষ আর অন্যজন বেঁটে মানুষ, দুজনের পুঁথি পাঠের ঢং মানুষ দাঁড়িয়ে শুনত। হাটে-বাজারে বটতলায় বাজারের এক কোণে খালি জায়গায় বসত তাদের পুঁথিপাঠ ও বিক্রির আসর। দুই ভাই শুধু বৃহত্তর সিলেট নয়, সারা বাংলা চষে বেড়াতেন, যেকোনো অঞ্চলে গিয়ে এক মাস-দু’মাস অবস্থান করতেন। পথকাব্যকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার পেছনে এ দুজনের ভূমিকা অগ্রগণ্য। চার পাতার পুঁথি বিক্রি শেষ হলে ওই এলাকাতেই প্রেস খুঁজে বের করে যে এলাকায় অস্থায়ীভাবে থাকতেন, সে স্থানের ঠিকানা দিয়ে কাব্য ছাপানো হতো। ফলে তাদের কাব্যের সূত্র ধরে লোকসাহিত্য গবেষক মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ পাঠান তাঁর একটি গবেষণা গ্রন্থে এ কে গণি কলম্বী নোয়াখালী চৌমুহনী অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন বলে ‘সম্ভবত’ শব্দ ব্যবহার করে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের কর্মের সময়কাল ছিল বিংশ শতাব্দীর ৫০, ৬০, ৭০, ৮০-র দশক, আর আর পুঁথিকাব্যের স্বর্ণযুগ ছিল বিংশ শতাব্দীর শেষ পাঁচটি দশক। এখন সেই পথকাব্য বিলুপ্তপ্রায়।
বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য সম্মাননা হিসেবে পরিচিত শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ড। সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্থপতি শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে ২০০৬ সালে এ সম্মাননা চালু হয়।
৯ ঘণ্টা আগে
দিলরুবা তার মাকে নিতে আসে গ্রামে। গ্রামের মানুষ পাঁচ মাস পর হঠাৎ আবিষ্কার করে এক নতুন দিলরুবাকে। দিলরুবার চেহারায় এই পাঁচ মাসেই জৌলুস এসেছে। আভিজাত্যের ছাপ এসেছে। আভিজাত্য তার বয়স কমিয়ে দিয়েছে। অর্থ মানুষকে সত্যিই বদলে দেয়।
৯ ঘণ্টা আগে
অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের নানা দিক নিয়ে বিস্তর আলোচনা ও গবেষণা হয়েছে। তবে তিনি যে একজন লিটলম্যাগ সম্পাদক ও দৈনিক পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন, সে বিষয়টি তেমন একটা আলোচনায় আসেনি।
১০ ঘণ্টা আগে
এ দুনিয়ার সকল জীবেরই জীবন রক্ষার প্রয়োজনে কোনো না কোনো সংকেত ব্যবহার করতে হয়। একেবারে নিম্নশ্রেণির কীট-পতঙ্গের জীবনেও সুখ-দুঃখ ব্যথা-বেদনার প্রকাশরূপে নানাবিধ সংকেত প্রকাশ পায়। পাখিদের স্তরে যেসব প্রাণী রয়েছে, তাদের জীবনে বেশ পরিষ্কার কতকগুলো শিস উচ্চারিত হয়, যাতে তাদের মনের ভাব সম্পূর্ণভাবে প
৪ দিন আগে