
রোকন রেজা

তুরা সব বুরকা খোল।
খুবই নরম গলায় কাওসার দারোগা আদেশ করল।
এই কিছুক্ষণ আগে যশোর-কালীগঞ্জ রুটের ‘অনুপম’ বাস থেকে এই দুই মহিলাকে সে উদ্ধার করেছে। যদিও তার ক্ষমতা ছিল না এদের উদ্ধার করার, যদি না কালু এই খবরটা তাকে দিত। তাই কাওসার দারোগা মনে মনে এটাও ভাবল, কালুর সঙ্গে এদের বোধহয় বচকা হয়েছে।
কাওসার দারোগা যখন ওদের নামিয়ে এনে রাস্তার পাশের একটা দোকানের পেছনে চলে গেল বাসটা তখনো দাঁড়িয়েছিল। তারপর একটু পরেই দারোগা দূর থেকে সিগন্যাল দিতেই বাসটা ছেড়ে গেল।
দিলরুবা এবং শমনী, দুজনের কেউই তেমন ভয় পাচ্ছে না। দারোগাও জানে এরা ভয় পাবে না। এরা হচ্ছে সর্বহারার দল। নিঃস্ব। যাদের হারানোর কিছু নেই তাদের ভয় থাকে না।
দারোগার কথামতো দুজনেই বোরখা খুলেছে। দুটিই জীর্ণ, নোংরা, বহু ব্যবহৃত বোরখা এবং তারা যে শাড়ি পরে আছে সেগুলোও নোংরা। বোধহয় একটু গন্ধযুক্ত। কাওসার দারোগা ওদের খুব কাছে যাচ্ছে না।
ওদের দুজনের কোমরে সব মিলে সাতটা ইন্ডিয়ান শাড়ি। কাওসার দারোগা টেনে টেনে বের করে। অতঃপর ওদের পেটিকোটের বাঁধন হালকা হয়ে এলে ওরা আবার তা টাইট করে বেঁধে নেয়।
কাওসার দারোগা শাড়িগুলো একে একে মাটিতে ফেলে। একটু দূরে দাঁড়ানো কনস্টেবল রইদুলের দিকে তাকাতেই সে কাছে আসে এবং ঠিক তখনই অদ্ভুতভাবে পাল্টে যায় দিলরুবা।
এই রইদুল আর কেউ নয়, তাদের গ্রামের রইদুল, যে রইদুল প্রথম তাকে ভালোবাসা শিখিয়েছিল। এক চঞ্চলা কিশোরীকে হঠাৎ নারী করে তুলেছিল। কিন্তু সে এখানে কেন! তার তো রংপুর থাকার কথা। রইদুলকে এখানে দেখে ঝলমলিয়ে ওঠে দিলরুবা।
– তুমি একেনে রইদুল ভাই!
– গত মাসে বদলি হইচি।
– ভালো আচো তুমি?
– হয়, ভালোই আচি। একটু থেমে রইদুল বলে, তালি তুই এই কাম করচিস এ্যাকুন!
দিলরুবা ও শমনী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। শমনী মেয়েটা দিলরুবার চাইতে একটু ফরসা। ঠিক ফরসা নয়, শ্যামলা। চোখ দুটো মোটা মোটা। সুপারির মতো। সেই চোখজুড়ে এখন দিঘির কালো জল।
দিলরুবার শরীরের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে রইদুল প্রশ্ন করে, তোর না বিয়ে হইছিল?
দিলরুবা কথা বলে না।
– কী রে, কতা কস না ক্যা?
– হইছিল। টেকে নাই।
একটু থেমে দিলরুবা বলে, মদখোর, জুয়াড়ি। ম্যালা দোষ ছিল। আমিই তারে তালাক দিচি।
– তোর শরীল তো আগেরতি অনেক খারাপ হইচে।
– শরীলের আর দোষ কী! কত কাম করতি হয়।
– এই ব্যবসায় লাব-পাতি হয়?
– হয় কিচু। দুইজন মানুষ। চইলে যায়।
– শুনচিলাম তুই ঢাকা গেচিলি। গার্মেন্টসে চাকরি নিচিলি।
দিলরুবা আবারও নীরব হয়ে যায়। কী এক গভীর অভিমানের ছায়া তার সারা মুখে খেলা করে এবং খেলা শেষে চোখের তারায় এসে জমাট বাঁধে। তারপর একটু ফুঁপিয়ে ওঠে সে, ঐকেনেও টিকতি পারলাম না, রইদুল ভাই।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে দিলরুবা, বয়সটাই কাল হয়ে গ্যালো, রইদুল ভাই। শরীল বাঁচানোই দায় হয়ে গ্যালো।
দিলরুবার এই হঠাৎ কান্না রইদুলকে একটু থমকে দেয়। একটু অনুশোচনায় ফেলে দেয়।
– আমাগের ইট্টু উপকার করবা, রইদুল ভাই?
– কী?
– দারোগারে ইট্টু বুলবা আমাগের জন্যি।
– দারোগা শোনবে নানে। ওই এক হারামির জাইত। ট্যাকা দিলি ছাইড়ে দেবেনে।
তারপর হঠাৎ রইদুল প্রশ্ন করে, মাসে কয়দিন আসিস এই দিকি?
– সপ্তাই দুই দিন।
– উস্তাদ ট্যার পাইল ক্যামনে?
– কুন হারামি কয়ে দিয়েচে বুদাই।
দিলরুবা থেমে যায়। কান্নাভেজা আকুল আবেদন তার দুচোখে ভেসে ওঠে, তুমি ইট্টু দারোগারে আমাগের জন্যি...
– ইতি কুনু কাজ হবে নারে, রুবি। ইরা বড়ো খারাপ জাইত।
মুখটা ঘৃণায় বিকৃত করে রইদুল—আইজ ইনি আচেন তো কাইল আরাকজন। কয়দিন কারে সামলাবি। তার চাইতে অন্য কাম-কাজ দ্যাক।
– কী কাম?
– কত কাম! দুনিয়াতি কামের অভাব!
– কামের অভাব নাই ঠিকই, রইদুল ভাই। তয় ভালো মাইনষের বড়ো অভাব। সবাই শুদু ঠকাতি চায়। জিততি চায়।
দারোগা হঠাৎ চড়াও হয়। রইদুল দিলরুবার পক্ষ নিয়ে ওকালতি করে, ছার আমাগের গিরামের মাইয়ে ছার। গরিপ মানুষ ছার। অল্প কিচু নিয়ে ছাইড়ে দেন, ছার।
– কিন্তু তারা তো সিডাও বের করে না। উরা তো দেখি তুমার সঙ্গেই মইজে আছে। তুমার সঙ্গে কি আগেরতিই...
– না, ছার। আমাগের গিরামের। পরিচিত।
এইসব কথার পর দিলরুবা এবং শমনী তাদের নিজ নিজ ট্যার থেকে টেনে টেনে আশি টাকা বের করে। বের করে তারা রইদুলের দিকে এগিয়ে দেয়।
– এ ট্যাকায় ছার হাতই দেবে নানে। আর ইট্টু বাড়ায়ে দে।
আবারও তারা নিজ নিজ ট্যার থেকে দশ-দশÑবিশ টাকা বের করে। শেষমেষ টোটাল একশ টাকা তারা রইদুলের হাতে ধরিয়ে দেয়।
রইদুল একশ টাকা কাওসার দারোগার হাতে দিয়ে বলে, দেন ছার ছাইড়ে দেন। গরিপ মানুষ।
বড়ো তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কাওসার দারোগা একশটা টাকা জামার বুক পকেটে ঢুকিয়ে রইদুলের সঙ্গে কোনো কথাবার্তা না বলেই হাঁটতে থাকে।
– এ্যাক কাম করবি রুবি? আমারে কইচিলো। য্যাকুন রংপুর ছিলাম। এ্যাট্টা স্কুলি চাকরি। এই ধর পোলাপানগো গোসল করানো। জামা-কাপুড় পরানো, ভাত খাওয়ানো এইসব। ব্যাতন দেবে। থাকতি খাতি দেবে। খিষ্টানগের স্কুল। খুবই পরিষ্কার। ঝকঝকা। তুই হবি দেখাশুনার মাস্টার, পরিচারিকা। আমারে বলচিলো। এ্যাক ডাক্তার।
হাতের রাইফেলটা একটু নেড়েচেড়ে রইদুল বলে, তাছাড়া তোর তো পুলাপানউ নাই।
দিলরুবা ও শমনী দুজনই বিহ্বল হয়ে রইদুলের কথা শোনে। শমনী মুখ খোলে, তালি আমরা ইট্টু ভাবি, রইদুল ভাই।
– ভাবনার কিচু নাই। কতা তো সহজ। যে কাম তুরা করচিস, এইডা এর চাইতে সহজ।
– কিন্তু ওর যে মা আচে! শমনী বলে।
– ওর মা তো কাম করে। যেকেনে কাম করে সেকেনেই বুজায়ে-সুজায়ে রাকার ব্যাবস্থা কর। পরে না হয়...
রইদুলের কথা ওদের ভালো লাগে। দিলরুবা বলে, আমরা এ্যাকুন বাড়ি যায়, রইদুল ভাই। ইট্টু ভাবি। তুমার সঙ্গে দেকা তো হবেনেই।
পাঁচ মাস পর।
দিলরুবা তার মাকে নিতে আসে গ্রামে। গ্রামের মানুষ পাঁচ মাস পর হঠাৎ আবিষ্কার করে এক নতুন দিলরুবাকে। দিলরুবার চেহারায় এই পাঁচ মাসেই জৌলুস এসেছে। আভিজাত্যের ছাপ এসেছে। আভিজাত্য তার বয়স কমিয়ে দিয়েছে। অর্থ মানুষকে সত্যিই বদলে দেয়।
এদিকে পোস্টিং কাছে হওয়ায় প্রতি বৃহস্পতিবার রইদুল এখন বাড়ি আসে।
দিলরুবা অপেক্ষা করছিল এই বৃহস্পতিবার পর্যন্ত।
যথারীতি রইদুল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাড়ি আসে। তার ভাবি তাকে দিলরুবার বদলে যাওয়ার গল্প বলে। রইদুল তাই খেয়েদেয়ে একটা সস্তা সিগারেট ধরিয়ে বহুদিনের চেনা দিলরুবাদের পুরোনো ভাঙা টিনের ছাপরার দিকে হাঁটতে থাকে।
দিলরুবা যেন ওর অপেক্ষাতেই বসেছিল সামনের ছাল-ওঠা ঘেইয়ো সানের বেঞ্চিটাতে। দূর থেকে রইদুলের হাতের সিগারেটের আগুন দেখে দিলরুবা তাকে চিনতে ভুল করে না।
– রইদুল ভাই, বইসো।
– কাইলকে নাকি চইলে যাচ্চিস? রইদুল বসতে বসতে জিজ্ঞেস করে।
– ভাবলাম তুমার সঙ্গে দেকা করে যা।
– তালি ভালোই আচিস তুই। যেন একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস পড়ে রইদুলের।
– হ্যাঁ, রইদুল ভাই, ভালো আচি। খুব ভালো আচি। এ্যাকুন আর কুনু অভাব নেই আমাগের।
তখন চাঁদের আলো কমে যেতে থাকে। আমের পাতায় জড়ানো অন্ধকার আরো ঘন হয়ে আসে। এই অন্ধকার রাতে বেলি ফুলের কড়া গন্ধ ওদের চারপাশে ঘুরপাক খায়।
রইদুল ভাবতে থাকে। রইদুল ভাবে, ত্রিশের এক নারী শুধু টাকা পেলেই সুখী হয় কী করে? সব যন্ত্রণা নিবারণ হয় কী করে?
অস্পষ্ট অন্ধকারে দিলরুবা রইদুলের চোখের দিকে তাকায়; বলে, এইবার তুমি এ্যাট্টা বিয়ে করো, রইদুল ভাই।
রইদুল কোনো কথা বলে না। গভীর অন্ধকারে সে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
– কতা বলো না ক্যান, রইদুল ভাই?
– জীবনে সত্যিকারের ভালোবাসা একজনরেই বাসা যায়।
– তুমি কি তালি এ্যাকুনউ আমারে...
হঠাৎ কি যেন হয়ে যায় রইদুলের। সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার মতো দিলরুবার হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। সে বলে, রুবি, চল না আইজগে ইট্টু নদীর ধারে যায়।
বহুদিনের চেনা রইদুলের এই প্রার্থনা দিলরুবা এড়াতে পারে না। নদীর জল তাকেও সমান আকর্ষণ করে।
ওরা আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে নবগঙ্গার পাড়ে চলে আসে। চাঁদ যেন তখন আবার ঝলকে উঠেছে। নদীর পানিতে চাঁদের খেলা। আর দুটি মানুষের বুকের মধ্যে উথালপাতাল।
– রুবি, এ্যাট্টা কতা বুলি!
দিলরুবা তখন চুপিচুপি বয়ে যাওয়া নদীর মতন। রইদুল বলে, আমি তোরে বিয়ে করতি চাই, রুবি।
রুবি অর্থাৎ দিলরুবা কথা বলে না। নদীর কিনারে তখন ঝড়ো বাতাস। এদিক-ওদিক উল্টে দেয় দিলরুবার বুকের খয়েরি ওড়না। এই বাতাসে রইদুল দিলরুবার হাতদুটি আরো শক্ত করে ধরে—কী কতা কস না ক্যান?
আবছা আলোয় দিলরুবা আবারও রইদুলের চোখের দিকে তাকায়। রইদুলের চোখের তারায় সে তখন পুরোনো প্রেম খোঁজে আতিপাতি করে।
ঠিক সেই সময় হইচই রবে তেড়ে আসে একদল মানুষ। ওত পেতে থাকা কিছু মানুষ। তারপর ফকির মেম্বারের বাড়ি দুজনকে দুঘরে আটকে রাখা হয় সারারাত।
সকালে সালিশ বসে। সালিশে দুজনের বিয়ে সাব্যস্ত হয়।
বেঁকে বসে দিলরুবা। শেষমেষ সে আর না বলে পারে না যে, সে এখন আর মুসলমান নেই। কিন্তু তার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। বিয়ে এড়ানোর এইসব ছল গ্রামের রাজনীতি করা মানুষগুলো ঠিকই ধরে ফেলে।
দিলরুবা সালিশে কিছু সময় প্রার্থনা করে।
কিন্তু তা মঞ্জুর হয় না। বিয়ে হয়ে যায়।
এ ধরনের বিয়েতে আনন্দ হওয়ার কথা নয়, হয়ও না। কিন্তু সন্ধ্যার পর রইদুলের টিনের ঘরে দিলরুবার দ্বিতীয় বাসর হয় ঠিকই। রইদুল দিলরুবার কচুপাতার মতো ভেজা হাতটা হাতে নিয়ে বলে, আমারেই যদি ভালোবাসিস বিয়েতে আপত্তি ক্যানে?
বাইরে তখন জমাট অন্ধকার। ঘরের মধ্যে ডিমলাইটের ফিনফিনে আলো। দিলরুবার কী হয় কে জানে। হঠাৎ সে বুকের বসন আলগা করে ফেলে। অনেকটা চেঁচিয়েই সে বলে, দ্যাকো...এই দ্যাকো...আমি...আমি...
বাসর ঘরে দিলরুবার হঠাৎ এই পাগলামি রইদুল ঠিক বুঝতে পারে না।
রইদুল তাকায়। রইদুল দেখে। রইদুল তখন আবছা আলোয় কোনো সুরভিত পুষ্প দেখে না। স্বর্গের কোনো চন্দ্রমুখী ফুল দেখে না। রইদুল দেখে দিলরুবার বুকে চাকতির মতো ক্রুস। রইদুল আর তাকাতে পারে না। যেদিকেই সে তাকায় দেখতে পায় যিশুর ডান দিকে হেলানো মাথা। কণ্টকাকীর্ণ দুটি হাত। কবজি দিয়ে গলগলে তাজা রক্ত। কিন্তু সেই রক্ত দিলরুবার স্তন বেয়ে আর রইদুলের দুচোখ বেয়ে আবারও যে এভাবে হঠাৎ গলে পড়তে শুরু করবে, তারা বোধহয় কেউই সেটা ভাবেনি কখনো। অশ্রুর ধারা দুজনের মাঝে অকূল সাগর হয়ে দেখা দিল, যে সাগর তারা পেরুতে পারবে না।

তুরা সব বুরকা খোল।
খুবই নরম গলায় কাওসার দারোগা আদেশ করল।
এই কিছুক্ষণ আগে যশোর-কালীগঞ্জ রুটের ‘অনুপম’ বাস থেকে এই দুই মহিলাকে সে উদ্ধার করেছে। যদিও তার ক্ষমতা ছিল না এদের উদ্ধার করার, যদি না কালু এই খবরটা তাকে দিত। তাই কাওসার দারোগা মনে মনে এটাও ভাবল, কালুর সঙ্গে এদের বোধহয় বচকা হয়েছে।
কাওসার দারোগা যখন ওদের নামিয়ে এনে রাস্তার পাশের একটা দোকানের পেছনে চলে গেল বাসটা তখনো দাঁড়িয়েছিল। তারপর একটু পরেই দারোগা দূর থেকে সিগন্যাল দিতেই বাসটা ছেড়ে গেল।
দিলরুবা এবং শমনী, দুজনের কেউই তেমন ভয় পাচ্ছে না। দারোগাও জানে এরা ভয় পাবে না। এরা হচ্ছে সর্বহারার দল। নিঃস্ব। যাদের হারানোর কিছু নেই তাদের ভয় থাকে না।
দারোগার কথামতো দুজনেই বোরখা খুলেছে। দুটিই জীর্ণ, নোংরা, বহু ব্যবহৃত বোরখা এবং তারা যে শাড়ি পরে আছে সেগুলোও নোংরা। বোধহয় একটু গন্ধযুক্ত। কাওসার দারোগা ওদের খুব কাছে যাচ্ছে না।
ওদের দুজনের কোমরে সব মিলে সাতটা ইন্ডিয়ান শাড়ি। কাওসার দারোগা টেনে টেনে বের করে। অতঃপর ওদের পেটিকোটের বাঁধন হালকা হয়ে এলে ওরা আবার তা টাইট করে বেঁধে নেয়।
কাওসার দারোগা শাড়িগুলো একে একে মাটিতে ফেলে। একটু দূরে দাঁড়ানো কনস্টেবল রইদুলের দিকে তাকাতেই সে কাছে আসে এবং ঠিক তখনই অদ্ভুতভাবে পাল্টে যায় দিলরুবা।
এই রইদুল আর কেউ নয়, তাদের গ্রামের রইদুল, যে রইদুল প্রথম তাকে ভালোবাসা শিখিয়েছিল। এক চঞ্চলা কিশোরীকে হঠাৎ নারী করে তুলেছিল। কিন্তু সে এখানে কেন! তার তো রংপুর থাকার কথা। রইদুলকে এখানে দেখে ঝলমলিয়ে ওঠে দিলরুবা।
– তুমি একেনে রইদুল ভাই!
– গত মাসে বদলি হইচি।
– ভালো আচো তুমি?
– হয়, ভালোই আচি। একটু থেমে রইদুল বলে, তালি তুই এই কাম করচিস এ্যাকুন!
দিলরুবা ও শমনী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। শমনী মেয়েটা দিলরুবার চাইতে একটু ফরসা। ঠিক ফরসা নয়, শ্যামলা। চোখ দুটো মোটা মোটা। সুপারির মতো। সেই চোখজুড়ে এখন দিঘির কালো জল।
দিলরুবার শরীরের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে রইদুল প্রশ্ন করে, তোর না বিয়ে হইছিল?
দিলরুবা কথা বলে না।
– কী রে, কতা কস না ক্যা?
– হইছিল। টেকে নাই।
একটু থেমে দিলরুবা বলে, মদখোর, জুয়াড়ি। ম্যালা দোষ ছিল। আমিই তারে তালাক দিচি।
– তোর শরীল তো আগেরতি অনেক খারাপ হইচে।
– শরীলের আর দোষ কী! কত কাম করতি হয়।
– এই ব্যবসায় লাব-পাতি হয়?
– হয় কিচু। দুইজন মানুষ। চইলে যায়।
– শুনচিলাম তুই ঢাকা গেচিলি। গার্মেন্টসে চাকরি নিচিলি।
দিলরুবা আবারও নীরব হয়ে যায়। কী এক গভীর অভিমানের ছায়া তার সারা মুখে খেলা করে এবং খেলা শেষে চোখের তারায় এসে জমাট বাঁধে। তারপর একটু ফুঁপিয়ে ওঠে সে, ঐকেনেও টিকতি পারলাম না, রইদুল ভাই।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে দিলরুবা, বয়সটাই কাল হয়ে গ্যালো, রইদুল ভাই। শরীল বাঁচানোই দায় হয়ে গ্যালো।
দিলরুবার এই হঠাৎ কান্না রইদুলকে একটু থমকে দেয়। একটু অনুশোচনায় ফেলে দেয়।
– আমাগের ইট্টু উপকার করবা, রইদুল ভাই?
– কী?
– দারোগারে ইট্টু বুলবা আমাগের জন্যি।
– দারোগা শোনবে নানে। ওই এক হারামির জাইত। ট্যাকা দিলি ছাইড়ে দেবেনে।
তারপর হঠাৎ রইদুল প্রশ্ন করে, মাসে কয়দিন আসিস এই দিকি?
– সপ্তাই দুই দিন।
– উস্তাদ ট্যার পাইল ক্যামনে?
– কুন হারামি কয়ে দিয়েচে বুদাই।
দিলরুবা থেমে যায়। কান্নাভেজা আকুল আবেদন তার দুচোখে ভেসে ওঠে, তুমি ইট্টু দারোগারে আমাগের জন্যি...
– ইতি কুনু কাজ হবে নারে, রুবি। ইরা বড়ো খারাপ জাইত।
মুখটা ঘৃণায় বিকৃত করে রইদুল—আইজ ইনি আচেন তো কাইল আরাকজন। কয়দিন কারে সামলাবি। তার চাইতে অন্য কাম-কাজ দ্যাক।
– কী কাম?
– কত কাম! দুনিয়াতি কামের অভাব!
– কামের অভাব নাই ঠিকই, রইদুল ভাই। তয় ভালো মাইনষের বড়ো অভাব। সবাই শুদু ঠকাতি চায়। জিততি চায়।
দারোগা হঠাৎ চড়াও হয়। রইদুল দিলরুবার পক্ষ নিয়ে ওকালতি করে, ছার আমাগের গিরামের মাইয়ে ছার। গরিপ মানুষ ছার। অল্প কিচু নিয়ে ছাইড়ে দেন, ছার।
– কিন্তু তারা তো সিডাও বের করে না। উরা তো দেখি তুমার সঙ্গেই মইজে আছে। তুমার সঙ্গে কি আগেরতিই...
– না, ছার। আমাগের গিরামের। পরিচিত।
এইসব কথার পর দিলরুবা এবং শমনী তাদের নিজ নিজ ট্যার থেকে টেনে টেনে আশি টাকা বের করে। বের করে তারা রইদুলের দিকে এগিয়ে দেয়।
– এ ট্যাকায় ছার হাতই দেবে নানে। আর ইট্টু বাড়ায়ে দে।
আবারও তারা নিজ নিজ ট্যার থেকে দশ-দশÑবিশ টাকা বের করে। শেষমেষ টোটাল একশ টাকা তারা রইদুলের হাতে ধরিয়ে দেয়।
রইদুল একশ টাকা কাওসার দারোগার হাতে দিয়ে বলে, দেন ছার ছাইড়ে দেন। গরিপ মানুষ।
বড়ো তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কাওসার দারোগা একশটা টাকা জামার বুক পকেটে ঢুকিয়ে রইদুলের সঙ্গে কোনো কথাবার্তা না বলেই হাঁটতে থাকে।
– এ্যাক কাম করবি রুবি? আমারে কইচিলো। য্যাকুন রংপুর ছিলাম। এ্যাট্টা স্কুলি চাকরি। এই ধর পোলাপানগো গোসল করানো। জামা-কাপুড় পরানো, ভাত খাওয়ানো এইসব। ব্যাতন দেবে। থাকতি খাতি দেবে। খিষ্টানগের স্কুল। খুবই পরিষ্কার। ঝকঝকা। তুই হবি দেখাশুনার মাস্টার, পরিচারিকা। আমারে বলচিলো। এ্যাক ডাক্তার।
হাতের রাইফেলটা একটু নেড়েচেড়ে রইদুল বলে, তাছাড়া তোর তো পুলাপানউ নাই।
দিলরুবা ও শমনী দুজনই বিহ্বল হয়ে রইদুলের কথা শোনে। শমনী মুখ খোলে, তালি আমরা ইট্টু ভাবি, রইদুল ভাই।
– ভাবনার কিচু নাই। কতা তো সহজ। যে কাম তুরা করচিস, এইডা এর চাইতে সহজ।
– কিন্তু ওর যে মা আচে! শমনী বলে।
– ওর মা তো কাম করে। যেকেনে কাম করে সেকেনেই বুজায়ে-সুজায়ে রাকার ব্যাবস্থা কর। পরে না হয়...
রইদুলের কথা ওদের ভালো লাগে। দিলরুবা বলে, আমরা এ্যাকুন বাড়ি যায়, রইদুল ভাই। ইট্টু ভাবি। তুমার সঙ্গে দেকা তো হবেনেই।
পাঁচ মাস পর।
দিলরুবা তার মাকে নিতে আসে গ্রামে। গ্রামের মানুষ পাঁচ মাস পর হঠাৎ আবিষ্কার করে এক নতুন দিলরুবাকে। দিলরুবার চেহারায় এই পাঁচ মাসেই জৌলুস এসেছে। আভিজাত্যের ছাপ এসেছে। আভিজাত্য তার বয়স কমিয়ে দিয়েছে। অর্থ মানুষকে সত্যিই বদলে দেয়।
এদিকে পোস্টিং কাছে হওয়ায় প্রতি বৃহস্পতিবার রইদুল এখন বাড়ি আসে।
দিলরুবা অপেক্ষা করছিল এই বৃহস্পতিবার পর্যন্ত।
যথারীতি রইদুল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাড়ি আসে। তার ভাবি তাকে দিলরুবার বদলে যাওয়ার গল্প বলে। রইদুল তাই খেয়েদেয়ে একটা সস্তা সিগারেট ধরিয়ে বহুদিনের চেনা দিলরুবাদের পুরোনো ভাঙা টিনের ছাপরার দিকে হাঁটতে থাকে।
দিলরুবা যেন ওর অপেক্ষাতেই বসেছিল সামনের ছাল-ওঠা ঘেইয়ো সানের বেঞ্চিটাতে। দূর থেকে রইদুলের হাতের সিগারেটের আগুন দেখে দিলরুবা তাকে চিনতে ভুল করে না।
– রইদুল ভাই, বইসো।
– কাইলকে নাকি চইলে যাচ্চিস? রইদুল বসতে বসতে জিজ্ঞেস করে।
– ভাবলাম তুমার সঙ্গে দেকা করে যা।
– তালি ভালোই আচিস তুই। যেন একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস পড়ে রইদুলের।
– হ্যাঁ, রইদুল ভাই, ভালো আচি। খুব ভালো আচি। এ্যাকুন আর কুনু অভাব নেই আমাগের।
তখন চাঁদের আলো কমে যেতে থাকে। আমের পাতায় জড়ানো অন্ধকার আরো ঘন হয়ে আসে। এই অন্ধকার রাতে বেলি ফুলের কড়া গন্ধ ওদের চারপাশে ঘুরপাক খায়।
রইদুল ভাবতে থাকে। রইদুল ভাবে, ত্রিশের এক নারী শুধু টাকা পেলেই সুখী হয় কী করে? সব যন্ত্রণা নিবারণ হয় কী করে?
অস্পষ্ট অন্ধকারে দিলরুবা রইদুলের চোখের দিকে তাকায়; বলে, এইবার তুমি এ্যাট্টা বিয়ে করো, রইদুল ভাই।
রইদুল কোনো কথা বলে না। গভীর অন্ধকারে সে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
– কতা বলো না ক্যান, রইদুল ভাই?
– জীবনে সত্যিকারের ভালোবাসা একজনরেই বাসা যায়।
– তুমি কি তালি এ্যাকুনউ আমারে...
হঠাৎ কি যেন হয়ে যায় রইদুলের। সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার মতো দিলরুবার হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। সে বলে, রুবি, চল না আইজগে ইট্টু নদীর ধারে যায়।
বহুদিনের চেনা রইদুলের এই প্রার্থনা দিলরুবা এড়াতে পারে না। নদীর জল তাকেও সমান আকর্ষণ করে।
ওরা আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে নবগঙ্গার পাড়ে চলে আসে। চাঁদ যেন তখন আবার ঝলকে উঠেছে। নদীর পানিতে চাঁদের খেলা। আর দুটি মানুষের বুকের মধ্যে উথালপাতাল।
– রুবি, এ্যাট্টা কতা বুলি!
দিলরুবা তখন চুপিচুপি বয়ে যাওয়া নদীর মতন। রইদুল বলে, আমি তোরে বিয়ে করতি চাই, রুবি।
রুবি অর্থাৎ দিলরুবা কথা বলে না। নদীর কিনারে তখন ঝড়ো বাতাস। এদিক-ওদিক উল্টে দেয় দিলরুবার বুকের খয়েরি ওড়না। এই বাতাসে রইদুল দিলরুবার হাতদুটি আরো শক্ত করে ধরে—কী কতা কস না ক্যান?
আবছা আলোয় দিলরুবা আবারও রইদুলের চোখের দিকে তাকায়। রইদুলের চোখের তারায় সে তখন পুরোনো প্রেম খোঁজে আতিপাতি করে।
ঠিক সেই সময় হইচই রবে তেড়ে আসে একদল মানুষ। ওত পেতে থাকা কিছু মানুষ। তারপর ফকির মেম্বারের বাড়ি দুজনকে দুঘরে আটকে রাখা হয় সারারাত।
সকালে সালিশ বসে। সালিশে দুজনের বিয়ে সাব্যস্ত হয়।
বেঁকে বসে দিলরুবা। শেষমেষ সে আর না বলে পারে না যে, সে এখন আর মুসলমান নেই। কিন্তু তার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। বিয়ে এড়ানোর এইসব ছল গ্রামের রাজনীতি করা মানুষগুলো ঠিকই ধরে ফেলে।
দিলরুবা সালিশে কিছু সময় প্রার্থনা করে।
কিন্তু তা মঞ্জুর হয় না। বিয়ে হয়ে যায়।
এ ধরনের বিয়েতে আনন্দ হওয়ার কথা নয়, হয়ও না। কিন্তু সন্ধ্যার পর রইদুলের টিনের ঘরে দিলরুবার দ্বিতীয় বাসর হয় ঠিকই। রইদুল দিলরুবার কচুপাতার মতো ভেজা হাতটা হাতে নিয়ে বলে, আমারেই যদি ভালোবাসিস বিয়েতে আপত্তি ক্যানে?
বাইরে তখন জমাট অন্ধকার। ঘরের মধ্যে ডিমলাইটের ফিনফিনে আলো। দিলরুবার কী হয় কে জানে। হঠাৎ সে বুকের বসন আলগা করে ফেলে। অনেকটা চেঁচিয়েই সে বলে, দ্যাকো...এই দ্যাকো...আমি...আমি...
বাসর ঘরে দিলরুবার হঠাৎ এই পাগলামি রইদুল ঠিক বুঝতে পারে না।
রইদুল তাকায়। রইদুল দেখে। রইদুল তখন আবছা আলোয় কোনো সুরভিত পুষ্প দেখে না। স্বর্গের কোনো চন্দ্রমুখী ফুল দেখে না। রইদুল দেখে দিলরুবার বুকে চাকতির মতো ক্রুস। রইদুল আর তাকাতে পারে না। যেদিকেই সে তাকায় দেখতে পায় যিশুর ডান দিকে হেলানো মাথা। কণ্টকাকীর্ণ দুটি হাত। কবজি দিয়ে গলগলে তাজা রক্ত। কিন্তু সেই রক্ত দিলরুবার স্তন বেয়ে আর রইদুলের দুচোখ বেয়ে আবারও যে এভাবে হঠাৎ গলে পড়তে শুরু করবে, তারা বোধহয় কেউই সেটা ভাবেনি কখনো। অশ্রুর ধারা দুজনের মাঝে অকূল সাগর হয়ে দেখা দিল, যে সাগর তারা পেরুতে পারবে না।
বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য সম্মাননা হিসেবে পরিচিত শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ড। সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্থপতি শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে ২০০৬ সালে এ সম্মাননা চালু হয়।
৯ ঘণ্টা আগে
মধ্যযুগের পুঁথি ছিল আধুনিক যুগের উপন্যাসের মতোই বিষয়-আশয়ে ঠাসা। পার্থক্য শুধু সুর-ছন্দ-অন্ত্যমিলের। উপন্যাস রচিত হয় কথার পর কথা সাজিয়ে; আর পুঁথি রচিত হতো সুর-ছন্দ-অন্ত্যমিলের সংমিশ্রণে, যা পড়লে মানুষ সহজেই আকৃষ্ট হতো, এখনো হয়। আকৃষ্ট হওয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সুর।
১০ ঘণ্টা আগে
অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের নানা দিক নিয়ে বিস্তর আলোচনা ও গবেষণা হয়েছে। তবে তিনি যে একজন লিটলম্যাগ সম্পাদক ও দৈনিক পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন, সে বিষয়টি তেমন একটা আলোচনায় আসেনি।
১০ ঘণ্টা আগে
এ দুনিয়ার সকল জীবেরই জীবন রক্ষার প্রয়োজনে কোনো না কোনো সংকেত ব্যবহার করতে হয়। একেবারে নিম্নশ্রেণির কীট-পতঙ্গের জীবনেও সুখ-দুঃখ ব্যথা-বেদনার প্রকাশরূপে নানাবিধ সংকেত প্রকাশ পায়। পাখিদের স্তরে যেসব প্রাণী রয়েছে, তাদের জীবনে বেশ পরিষ্কার কতকগুলো শিস উচ্চারিত হয়, যাতে তাদের মনের ভাব সম্পূর্ণভাবে প
৪ দিন আগে