ভেনামিতে ভরসা চিংড়ি চাষিদের

এহতেশামুল হক শাওন, খুলনা
প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১: ১৫

উপকূলীয় জনপদ খুলনায় চিংড়ি চাষিদের মাঝে বাগদা ও গলদার পাশাপাশি ভেনামি চাষে আগ্রহ বাড়ছে। বিদেশের বাজারে রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশের বাজারের চাহিদা মেটাচ্ছে ভেনামি। অল্প জায়গায়, স্বল্প সময়ে, কম বিনিয়োগে, অধিক ফলন পাওয়ায় এবং মৃত্যুঝুঁকি কম থাকায় চাষিরা উৎসাহী হচ্ছেন।

মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্ববাজারে চিংড়ির ৮২ শতাংশ ভেনামির দখলে। বাকি ১৮ শতাংশে রয়েছে বাগদা ও গলদার আধিপত্য। অথচ বাংলাদেশে এতকাল এ জাতীয় চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে। ২০২১ সালে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে ভেনামির চাষ শুরু হয়। খুলনার পাইকগাছার লোনাপানি কেন্দ্রের কয়েকটি পুকুরে যশোরের একটি বেসকারি প্রতিষ্ঠান ভেনামি চাষ করে। পরপর দুই বছর মাত্র তিন মাসে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করায় ২০২৩ সাল থেকে সরকার বাণিজ্যিক চাষের অনুমোদন দেয়।

বিজ্ঞাপন

জেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানিয়েছে, এবার ১২ জন চাষি ২৫ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ি চাষ করছেন। সাধারণ ঘেরে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভেনামি চিংড়ি চাষ করা গেলে বাগদার চেয়ে অন্তত তিন থেকে চারগুণ উৎপাদন বেশি হবে। ভেনামি চাষে দেশের জিআই পণ্য বাগদা চাষে কোনো ক্ষতি করবে না বলে দাবি তাদের।

এদিকে ভেনামির পাশাপাশি আধা নিবিড় পদ্ধতির বাগদা চাষে এবং সনাতন পদ্ধতিতে মিষ্টি পানির গলদা চাষে এগিয়ে যাচ্ছেন অনেক চাষি। কিন্তু উৎপাদন বাড়লেও বিগত তিন অর্থবছরে খুলনা থেকে চিংড়ি রপ্তানি কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে খুলনাঞ্চল থেকে ২৪ হাজার ১০৪ মে. টন হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হলেও বিদায়ী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) রপ্তানি হয় ১৫ হাজার ৪৫১ মে. টন।

খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ফারহানা তাসলিমা জানান, বহিঃবিশ্বে ভেনামির চাহিদা থাকায় দেশে এর বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। হেক্টরপ্রতি ১০ টনেরও বেশি উৎপাদন হওয়ায় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। জেলার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া উপজেলার ১২জন চাষি অনুমোদন নিয়েছেন। আরও অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আবেদন করলে আমরা সরেজমিন তদন্ত করে চাষের অনুমতি দিচ্ছি।

বিদেশি জাতের বলে ভেনামি নিয়ে শুরুতে অনেকের মনে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ ছিল বলে জানান তিনি। তবে লোনাপানি কেন্দ্রের অভ্যন্তরের পুকুরে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায় চাষ হয়েছে। যেখানে উৎপাদন হয়েছে আশাব্যঞ্জক, কিন্তু প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু প্রমাণিত হয়নি। ফলে সরকার বাণিজ্যিক চাষের অনুমতি দিয়েছে।

জেলার কয়রা উপজেলার কুশোডাঙ্গা গ্রামের ঘের মালিক জেনারুল ইসলাম বলেন, প্রচলিত বাগদা চাষে হেক্টরপ্রতি ৪/৫শ’ কেজি আর আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ হলে ৪/৫ হাজার কেজি উৎপাদন হয়। অথচ ভেনামি প্রতি হেক্টরে ১০ হাজার কেজির উপরে ফলন হয়। সম্প্রতি তার এলাকার এক চাষি প্রতি কেজি মাছ ৭৬০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। তার উৎপাদন ব্যয় হয়েছিল কেজিতে সাড়ে চারশ’ টাকার মতো। বাগদা- গলদায় যখন তখন মড়ক লাগে। পোনা বাড়ে না, বিক্রি করতে গেলে বাজারে দাম পাওয়া যায় না। আগামীতে তিনিও সেমি ইনটেনসিভ বাগদা চাষের পরিবর্তে ভেনামি চাষ করবেন বলে চিন্তা করছেন।

খুলনার পাইকগাছায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের লোনাপানি কেন্দ্রের ছয়টি পুকুরে ২০২১ ও ২০২২ সালে পরীক্ষামূলক ভেনামি চাষ করে সফল হন শ্যামল দাস। তিনি বিগত দু’বছর ধরে বাণিজ্যিক চাষেও সফল হয়েছেন। এবার তিনি খুলনার বটিয়াঘাটার চকশৈলমারিতে ২০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে ৬টি পুকুরে ভেনামি চাষ করেন। তিনটি পুকুর থেকে এরই মধ্যে চিংড়ি আহরণ করে প্রতি হেক্টরে ১০ হাজার কেজি করে পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন।

দেশে ভেনামির পোনা উৎপাদনের অনুমোদন পেয়েছে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান। কক্সবাজারের নিরিবিলি হ্যাচারি এবং খুলনার দেশ বাংলা এসপিএফ হ্যাচারি। দেশ বাংলা হ্যাচারির ম্যানেজিং ডিরেক্টর এম এ হাসান পান্না জানান, তারা আমেরিকার ফ্লোরিডা থেকে ব্রুড বা মাদার সংগ্রহ করেন। এরপর তাদের হ্যাচারিতে এই মা মাছ থেকে পোনা উৎপাদন হয়। মৃত্যুঝুঁকি কম থাকায় এবং স্বল্প সময়ে প্রচলিত ধারার চেয়ে অন্তত চারগুণ বেশি উৎপাদন হওয়ায় চাষিদের আগ্রহ বাড়ছে।

বিষয়:

চিংড়ি চাষ
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত