আতঙ্কে দিন কেটেছে বিএনপি-জামায়াতকর্মীদের, অর্ধশত খুন

রামিজ আহসান, মেহেরপুর
প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ২১

চরমপন্থি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে এক সময় পরিচিত ছিল মেহেরপুর জেলা। বিশেষ করে ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গাংনী ছিল আতঙ্কের জনপদ। তবে এর প্রভাব ছিল পুরো জেলায়। চরমপন্থিদের অস্ত্রের ঝনঝনানি আর বোমাবাজিতে সব সময় মানুষ আতঙ্কে থাকত। অনেকেই নিজের বাড়িতে ঘুমাতে পারতেন না। ধীরে ধীরে শান্তি ফিরে আসে এই জনপদে।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসনামলে (২০০৯-২৪) ফের দিনদুপুরে খুন-খারাবির ঘটনা ফিরে আসে। ২০১৩-১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী যে আন্দোলন শুরু হয়, তা নজিরবিহীন। বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন দমাতে চলে ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়ন। বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা হয়। গুম আর হত্যার শিকার হন অনেকেই। ক্রসফায়ার দিয়ে হত্যা করা দুদলের নেতাকর্মীদের। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বোমা মেরে, কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে তাদের। বাদ যায়নি পরিবারের অন্য সদস্যরাও। জামায়াত নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুরের পর তাদের বিরুদ্ধেই আবার মামলা দেওয়া হয়েছে। এমন কোনো অপরাধ নেই, যা করেনি আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। আওয়ামী শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ।

জামায়াত-বিএনপিকে দমন-পীড়নের চিত্র

বিগত ২০১৩-১৪ সালে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারবিরোধী আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে মেহেরপুরে। এ সময় ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়ন চলে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের ওপর। মামলা-হামলা ও খুনের ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছে জামায়াত-বিএনপিকে।

জামায়াতের দাবি, কেন্দ্রীয় নেতাদের যুদ্ধাপরাধের মামলায় অন্যায়ভাবে ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন দাবিতে রাজপথে সোচ্চার ছিল জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াত-শিবিরকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পুলিশকে ব্যবহার করে। রাজনৈতিক প্রতিবাদে হামলা, মিছিলে গুলি ও ক্রসফায়ারের নামে নাটক সাজিয়ে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পথ বেছে নেয়। এ সময় জামায়াত-শিবিরের এক হাজার নেতাকর্মীর নামে ৮৬ মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। মহিলা ও ছাত্রীদের বিভিন্ন কোরআন ক্লাস থেকে ধরে নিয়ে প্রায় ১০০ জনের নামে ১৪টি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়।

২০১২ সালে আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের বিরুদ্ধে জামায়াত আন্দোলনে সোচ্চার হয়। সে সময় মিছিলে পুলিশ সরাসরি গুলি করে ১৫-২০ জনকে আহত করে। মিছিলে গুলিতে তিন জামায়াতকর্মী নিহত হন। থানায় ও ডিবি অফিসে জামায়াত নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে ব্যাপক নির্যাতন চালায় পুলিশ। জেলহাজত থেকে জামিন নিয়ে বের হলে ফের জেলগেট থেকে তাদের ধরে গ্রেপ্তার দেখানো হতো। আবার মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

পুলিশি হয়রানির কারণে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বাড়িছাড়া হতে হয়েছে। রাতের পর রাত মাঠে, বিভিন্ন খোলা জায়গায় রাত কাটাতে হয়েছে। জামায়াত নেতাকর্মীদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকের বাড়িঘরও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। চালানো হয়েছে লুটপাট।

বিএনপি নেতাকর্মীদের দাবি, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের আমলে বিএনপির ওপর সবচেয়ে বেশি নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয়। ২০১৩-১৪ সালে সরকারবিরোধী তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন মেহেরপুর-১ আসনের সাবেক এমপি মাসুদ অরুণ। সে কারণে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রশাসনের দমন-পীড়নের শিকার হন। তিনবার জেলা বিএনপি কার্যালয়ে হামলা করা হয়।

আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনীর আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের। সে সময় গণঅবরোধের সময় ১০২ নারীকে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর মধ্যে অনেকে গর্ভবতী এবং অনেকের ছোট শিশুও ছিল।

বিএনপির প্রায় চার হাজার নেতাকর্মীর নামে ১১২টি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। অনেক নেতাকর্মী একাধিকবার কারাবরণ করেছেন। জামিন নিয়ে বের হলেও জেলগেট থেকে ফের তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থকদের বাড়িঘরে লুটপাট চালানো হয়েছে। জমি-জায়গা দখল করা হয়েছে। মামলার ভয় দেখিয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। হামলা ও মিথ্যা মামলার ভয়ে অনেকে খোলা আকাশের নিচে, মাঠে-ঘাটে থেকেছেন দিনের পর দিন।

ক্রসফায়ার নাটকে কেঁদেছিল মেহেরপুরবাসী

জেলা জামায়াতের সাবেক আমির মরহুম মো. ছমির উদ্দীনের ৯ সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে তারিক মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি জেলা জামায়াতের মেহেরপুর শাখার সহকারী সেক্রেটারি ছিলেন। মানুষের ভালোবাসায় মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই তারিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। মেহেরপুর-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবেও নির্বাচন করার কথা ছিল তার। কিন্তু কে জানত তার ভাগ্যে করুণ পরিণতি লেখা রয়েছে! ২০১৩-১৪ সালে স্বৈরাচারী হাসিনার আমলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তৎকালীন আওয়ামী এমপি। তারিক রোষানলে পড়েন আওয়ামীপন্থি পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবিসহ প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তার। ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংকের মেহেরপুর শাখায় কাজ সেরে নিচে এলে তাকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। মেহেরপুর-১ আসনের সে সময়ের এমপি ফরহাদ হোসেন এবং সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রসুলের নির্দেশে তাকে আটক করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে রাখা হয়। অনেক চেষ্টা করেও তার সন্ধান পায়নি পরিবার। তাকে আটকের বিষয়টিও অস্বীকার করে পুলিশ। এরপর বামনপাড়া শ্মশানঘাটে রাতে তাকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়। পরে তড়িঘড়ি করে লাশ মর্গে নিয়ে সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। দ্রুত দাফন করার নির্দেশনাও দেয় পুলিশ। সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পুলিশের কাছে চাইতে গেলে পরিবারকে পুলিশ হুমকি দেয়। তারিক হত্যাকাণ্ডে হাজার হাজার নেতাকর্মী, সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকেই। স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো শহর।

হত্যাকাণ্ডের পর প্রশাসন আর আওয়ামী নেতাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারেননি। হুমকি দেওয়া হয়েছে পরিবার ও নেতাকর্মীদেরও। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর তারিক হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের জন্য মামলা করা হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে তারিকের ভাই তাওফিকুল ইসলাম ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর মেহেরপুর আমলি আদালতে মামলা করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয় সে সময়ের পুলিশ সুপার একেএম নাহিদুল ইসলামকে। তিনি দমন-পীড়নের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। বিতর্কিত এই পুলিশ কর্মকর্তাকে গত ২৮ জুলাই অবসরে পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নাহিদুল ইসলামকে জনস্বার্থে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। তারিক হত্যাকাণ্ডের মামলায় রাজধানীর ইস্কাটন থেকে ১২ সেপ্টেম্বর সাবেক এসপি নাহিদুলকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।

মামলায় মেহেরপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন দোদুল, তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান ও আব্দুল জলিল, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাঈদ মোমিন মজুমদার, গাংনী র‌্যাব-৬-এর ক্যাম্প কমান্ডার আশরাফ হোসেনসহ পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির কর্মকর্তাসহ অজ্ঞাত ২০-৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সে মামলায় সাবেক এমপি ফরহাদ হোসেন এখন কারাগারে।

জামায়াত নেতাকে ক্রসফায়ারে হত্যা

সদর উপজেলার হিজুলি গ্রামের জামায়াত নেতা ও ইউপি সদস্য আব্দুল জব্বারকে ২০১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর আটক করে পুলিশ। এরপর ওই রাতেই আব্দুল জব্বারকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। পরে বন্দুকযুদ্ধ হিসেবে চালিয়ে দেয় পুলিশ। পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে মামলা করে পরিবার। নিহত আব্দুল জব্বারের ছেলে আব্দুল মালিথা বাদী হয়ে মেহেরপুর আমলি আদালতে গত ১৭ সেপ্টেম্বর মামলা করেন। সে মামলায়ও প্রধান আসামি করা হয় তৎকালীন পুলিশ সুপার নাহিদুল ইসলামকে। এ মামলাতেও উঠে আসে পুলিশ প্রশাসন আর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার নাম।

মামলায় ২৬ জনকে আসামি করা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আসামি হলেন সাবেক পুলিশ সুপার নাহিদুল, তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাঈদ মোমিন মজুমদার, ওসি (তদন্ত) তরিকুল ইসলাম, এসআই শরজিদ কুমার ঘোষ, এসআই গাজী ইকবাল হোসেন, কনস্টেবল সাধন কুমার ও নারদ কুমার, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি গোলাম রসুল, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল ইসলাম। সে মামলায় অজ্ঞাত আরো ২০-৩০ জনকে আসামি করা হয়।

বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট

জামায়াতকে মেহেরপুরের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে নিশ্চিহ্ন করতে বাড়িঘরে টার্গেট হামলা এবং অগ্নিসংযোগ করে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীরা। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা জেলা জামায়াতের আমির আলহাজ মো. ছমির উদ্দিনকে (মৃত) মূল টার্গেট করে তারা। তাকে ঘায়েল করতে পারলে দুর্বল হয়ে যাবে জামায়াত—এমন পরিকল্পনায় ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষণার পর আনন্দ মিছিল বের করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি গোলাম রসুল, পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি ইয়ারুল ইসলাম এবং জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মিয়াজান আলী ও যুবলীগ সভাপতি সাজ্জাদুল আনামের নির্দেশনায় এ মিছিল হয়। ‘একটা-দুইটা জামাত ধর, সকাল-বিকাল নাস্তা কর’; ‘জামাতের আস্তানা, এই বাংলায় রাখব না’—এমন স্লোগান দেওয়া হয়। মিছিলটি শহরের হোটেল বাজার মোড় থেকে প্রধান সড়ক দিয়ে আসার পথে আলহাজ ছমির উদ্দিনের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ছমির উদ্দিনের ছেলে তারিকের ‘মেসার্স তাওহীদ অটো’ নামে মোটরসাইকেল পার্টস ও খুচরা যন্ত্রাংশের দোকানের তালা ভেঙে মালামাল এবং নগদ অর্থ লুটপাট করে নেওয়া হয়। হামলা করা হয় ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকা পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। এরপর ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা।

শিবিরের সাবেক নেতাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হয়। সে সময় ফেমাস ট্রেডার্সে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটে প্রায় ৪০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। পরে এ ঘটনায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতারা বাদী হয়ে উল্টো জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের নামে মামলা করে। সে মামলায় ১০৮ জন আসামি ছিলেন। ওই মিথ্যা মামলা থেকে এ বছর সব আসামি খালাস পান। সে ঘটনায় ২০১৩ সালের মার্চে একটি মামলা দায়ের করেন ফেমাস ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী। কিন্তু ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ক্ষমতার প্রভাবে আদালত মামলাটি আমলে নেয়নি বলে দাবি করেন ফেমাস ট্রেডার্সের মালিক। বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর মৃত ছমির উদ্দিনের ছেলে তাওফিকুল ইসলাম মেহেরপুর দ্রুত বিচার আদালতে একটি মামলা করেন, যা বর্তমানে বিচারাধীন।

জেলা জামায়াত সেক্রেটারি ইকবাল হোসাইন বলেন, পুলিশের প্রতিদিনের কাজই ছিল জামায়াত-বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ি অথবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে ধরে এনে মিথ্যা মামলা দেওয়া। পুলিশকে দলীয় পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছিল। জামায়াত-শিবির ট্যাগ লাগিয়ে অনেক নিরীহ মানুষকেও মিথ্যা মামলায় নির্যাতন করা হয়েছে। অনেককে গ্রেপ্তার ও মামলার ভয় দেখিয়ে আওয়ামী লীগ এবং পুলিশ একসঙ্গে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিত। বিগত ১৫ বছর ধরে চলা অমানুষিক ও লোমহর্ষক নির্যাতনের ঘটনা বলে শেষ করা যাবে না।

তিনি বলেন, পটপরিবর্তনের পর এসব নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড ও হয়রানির বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা ও দলকানা পুলিশ কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।

জেলা জামায়াতের আমির মওলানা তাজউদ্দিন খান বলেন, বিগত সরকারের সময় মেহেরপুরে রাজনৈতিক অবস্থা খুবই উত্তপ্ত ছিল। ২০১৩ সালের মে-জুনের দিকে রাজনগরে ফজর নামাজ পড়ে একটি প্রোগ্রাম করছিলাম। সেখানে পুলিশ রেইড দিয়ে জামায়াত নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। আগস্টের মাঝামাঝি আবদুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে রাজনগর, বাড়াদি ও গাড়াডোব গ্রামে জামায়াতের কর্মসূচিতে পুলিশ তাণ্ডব চালায়। পুলিশের গুলিতে রঘুনাথপুর গ্রামের সোলাইমান হোসেন নিহত হন। পুলিশের মামলায় ১৮ সেপ্টেম্বর আমি গ্রেপ্তার হই। পরদিন সরকারবিরোধী প্রতিবাদ মিছিলে গৌরীনগরে রাস্তার ওপর পুলিশের গুলিতে দেলোয়ার হোসেন নামে দারিয়াপুর গ্রামের একজন নিহত হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটের আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যৌথবাহিনীর অভিযানে রাজনগর এলাকা থেকে সাধারণ পুরুষ ও মহিলাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রামবাসীকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করা হয়।

তিনি বলেন, ১৩ ডিসেম্বরের শেষদিকে রাজনগর গ্রামের আব্দুল জব্বার মেম্বারকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। ১৯ জানুয়ারি তারিক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার এবং রাতে ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়ে হত্যা করে পুলিশ। ৮৬টি মামলায় প্রায় এক হাজারজনকে কারাগারে পাঠিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হয়। এরকম অসংখ্য নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন হাজার হাজার নেতাকর্মী।

বিএনপির ওপর নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের চিত্র

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের প্রায় অর্ধশত নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের বোমা মেরে, কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং আন্দোলন দমনে অনেককে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে সদর উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি শমসের মালিথাকে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা তার নিজ বাড়িতে ধারালো অস্ত্র ও বোমা ফাটিয়ে হত্যা করে। মুজিবনগর উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ডা. হামিদুর রহমান হেলালকে মাগরিবের আজানের কিছু পূর্বে নিজ বাড়িতে হত্যা করা হয়। তার মেয়েকেও ছুরিকাঘাত করে, বোমা মেরে ও গুলি করে হত্যা করা হয়।

এছাড়া সদর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম, মুজিবনগর উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি আফসার উদ্দিন মেম্বার, বাগোয়ান ইউনিয়নের যুবদল নেতা শরিফুল ইসলামকে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নিজ বাড়িতে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে। শরিফুলের মৃত্যুর খবরে তার পিতা স্ট্রোক করে মারা যান।

রাজনগর ইউনিয়ন বিএনপি নেতা রমজান আলীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। গাংনী থানা যুবদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক শাহিন আলমকে যৌথবাহিনী বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা এলাকায় ক্রসফায়ারে হত্যা করে। বামুন্দি ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য আজিজুল হককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে তথাকথিত ক্রসফায়ারে হত্যা করে যৌথবাহিনী। রায়পুর ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য বাদশাকে বাড়ি থেকে পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়।

সদর উপজেলার বুড়িপোতায় বিএনপিকর্মী নুহু, পিরোজপুর গ্রামের বিএনপি নেতা কানন ও জনাব আলী, সোনাপুর গ্রামের যুবদল নেতা সাদ্দাম হোসেন, রাধাকান্তপুর গ্রামের ওমর ফারুক, কাঁঠালপোতা গ্রামের মো. শাহাবুদ্দিন, বাগোয়ান গ্রামের লিয়াকত আলীকে হত্যা করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। বামুন্দী ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি আব্দুল আলিমকে নিজ বাড়িতে বোমা মেরে হত্যা করা হয়।

গাংনী উপজেলা যুবদল নেতা লাভলু হোসেনকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়। গাংনী উপজেলা যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কাজল মাহমুদকে বাজারে বসে চা খাওয়া অবস্থায় বোমা মেরে হত্যা করা হয়। ধানখোলা ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মিলন বিশ্বাসকে ধানখোলা বাজারে প্রকাশ্যে জবাই করে হত্যা করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। গাংনী উপজেলা ছাত্রদল নেতা হাসানুজ্জামান ও শিমুলতলা গ্রামের যুবদল নেতা আশরাফুল ইসলামকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। যুবদল নেতা বানারুল ইসলামকে বোমা মেরে হত্যা করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। গাংনী পৌর বিএনপি নেতা লাবলাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

কাজিপুর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক লোকমান হোসেন, ধানখোলা ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোখলেছুর রহমান মিলন, গাংনী যুবদল নেতা আবু খায়ের, গাংনীর বিএনপিকর্মী রমেশ ও সোহাগ, গাংনীর যুবদল নেতা মো. কায়েসকে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীরা হত্যা করে।

মেহেরপুর-২ (গাংনী) আসনের সাবেক এমপি আমজাদ হোসেন বলেন, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী নির্যাতন, হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। বহু নেতাকর্মীকে গুলি ও কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। ক্রসফায়ার দিয়ে হত্যা কার হয়েছে অনেককে। মিথ্যা মামলায় নেতাকর্মীদের ঘরছাড়া হতে হয়েছে। আওয়ামী শাসনের ১৫ বছরে এভাবেই দিনের পর দিন চলে অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়ন।

মেহেরপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাসুদ অরুণ বলেন, স্বৈরাচার হাসিনা সরকার পতনের পর আমরা বেশকিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনায় আইনের আশ্রয় নিয়েছি। আমরা ন্যায়বিচার পাব বলে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে দলীয় কর্মসূচিসহ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে লড়াই, সেখানে বিএনপির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। দীর্ঘ ১৭ বছর ফ্যাসিস্ট সরকারের দমন-পীড়ন, জেল-জুলুম ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি ছাত্র-জনতা, শ্রমজীবী মানুষের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী হাসিনা বিদায়ের পর আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে মানুষ তার দীর্ঘদিনের ভোটের অধিকার ফিরে পাবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত