শতবর্ষী আলোকবর্তিকা

কবি ফররুখসহ বহু খ্যাতিমানের স্রষ্টা নাকোল রাইচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়

আইয়ুব হোসেন খান, শ্রীপুর (মাগুরা)
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২: ০০

মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মধ্যে প্রবাহিত হানু নদীর তীরে অবস্থিত নাকোল গ্রাম। মূলত এ অঞ্চলের মানুষ মনে করে, পাশাপাশি পাঁচটি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত এই এলাকাটি একটি পরিবার। সেখানেই নদীর পাড়ে অবস্থিত নাকোল রাইচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১২৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন কবি ফররুখ আহমদ, সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ মুনশী রইস উদ্দিনসহ অসংখ্য গুণী ব্যক্তি।

বিজ্ঞাপন

স্কুল প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, স্কুলটি প্রতিষ্ঠার আলাপ শুরু হয় ১৮৯৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে। পাঁচ গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ঘাসিয়াড়া গ্রামের রাই পরিবারের সদস্য হেমন্তকুমার রাইয়ের আহ্বানে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। যে কথা সে কাজ। এলাকার সবার সম্মতিক্রমে ও সহযোগিতায় ১৮৯৯ সালের ১ জানুয়ারি নাকোল বাজার-সংলগ্ন মাত্র ০.৩৩ শতাংশ জমির ওপর মাইনর স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু করে এ বিদ্যালয়টি।

এরপর আর্থিক সংকটে পড়ে এ প্রতিষ্ঠান। তখন এলাকার শিক্ষানুরাগীরা নাকোলের ধনাঢ্য ব্যক্তি রাইচরণ সাহার শরণাপন্ন হন। তিনি এলাকার শিক্ষা অনুরাগীদের আর্থিকসহ সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তখন স্কুলের নাম পরিবর্তন করে রাইচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয় করা হয়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক গেজেট ‘মিনিট’ বইয়ে এ রেকর্ড লিপিবদ্ধ রয়েছে। রেজিস্ট্রেশনের সাল হিসেবে এ বিদ্যালয়ের স্থাপিত সাল ধরা হয় ১৯১১। বিষয়টিতে সংশোধনী আনার জন্য ২০০৮ সালে এ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শফিকুল আজম তৎকালীন মাগুরার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আগের কাগজপত্রের ওপর ভিত্তি করে এফিডেভিটের মাধ্যমে বিদ্যালয়টির স্থাপিত সাল ১৯০১ সাল করেন। ফলে বর্তমানে স্কুলটির বয়স দাঁড়ায় ১২৫ বছর।

এ বিদ্যালয় থেকে প্রথম ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ নেন—শ্রীশ চন্দ্র, পূর্ণচন্দ্র সিংহ, তারাপদ স্যানাল, আবদুল জব্বার, আকমল হোসেন মিয়া, মুন্সী আকমল হোসেন, আবদুর রহমান, এবাদত হোসেন প্রমুখ। মজার ব্যাপার হলো, ওই সময় প্রথমবারের মতো যে কজন ছাত্র ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন সবাই পাস করেন প্রথম বিভাগে। পাসের হার ছিল শতভাগ।

সেই থেকে এখন পর্যন্ত বিদ্যালয়টি এই এলাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে এখন মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৮৬২ জন। যার মধ্যে ছাত্র ৫০৩ জন এবং ছাত্রী ৩৫৯ জন। এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও কর্মচারী রয়েছেন ২৫ জন। বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন অমল কৃষ্ণ মজুমদার।

এ প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন কবি ফররুখ আহমদ, সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ মুনশী রইস উদ্দিন, ডাক্তার দ্বিজেন্দ্রনাথ সাহার মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা। এ ছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানে যারা পড়াশোনা করেছেন, তাদের অনেকেই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এবং এখনো রয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন—ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মাসুদুর রহমান খান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ অহিদুল ইসলাম, ড. মালেকা পারভীন, ড. মতিয়ার রহমান, ড. জামান খান, ডা. তপন কুমার রায়, উপসচিব মোহাম্মদ খায়রুজ্জামান, উপসচিব মুন্সি জালাল উদ্দিন, ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম কমিশনার (কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ) রইচ উদ্দিন খান, অধ্যাপক কাজী এনামুল হক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আলী জিন্না, ব্যবসায়ী সুচিন্ত্য কুমার সাহা, ডা. নুরুজ্জোহা, পদ্মা টেক্সটাইল মিলসের সাবেক জিএম হাশেম আলম খান, অতিরিক্ত ডিআইজি নুরুজ্জামান পারভেজ, ডা. মিয়া আবু তালেব, ইঞ্জিনিয়ার ইমদাদুল ইসলাম প্রমুখ।

শতবর্ষী এই প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অহিদুল ইসলাম বলেন, এরকম একটি বিদ্যালয়ের ছাত্র হতে পেরে আমি গর্বিত। এ বিদ্যালয় ইতোমধ্যে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে দেশে খ্যাতি লাভ করেছে। এ বিদ্যালয় থেকে অসংখ্য গুণীজনের জন্ম হয়েছে। এখানে পড়া না হলে হয়তো আমি আজ এ পর্যায়ে আসতে পারতাম না। বিদ্যালয়ের আরো সমৃদ্ধি কামনা করছি।

বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী ড. মালেকা পারভীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি বলেন, বাবা-মায়ের পাশাপাশি এ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যথাযথ যত্নের কারণে আজ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হতে পেরেছি। আমি সারাজীবন তাদের মনে রাখব এবং এ বিদ্যালয়ের সমৃদ্ধি কামনা করে যাব।

আবার ফিরে যাই সে হানু নদীর কাছে। নদীটি এখন বলতে গেলে মৃতপ্রায়। কিন্তু তার পাড়ে ১২৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টি টিকে আছে এলাকার গর্ব হয়ে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত