মহিষের দুধের টকদইয়ের রাজ্য বকশীগঞ্জের নঈম মিয়ার হাট

রকিবুল হাসান, বকশীগঞ্জ
প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২৫, ১২: ০০

জামালপুরের সীমান্তবর্তী উপজেলা বকশীগঞ্জের সূর্যনগর নঈম মিয়ার হাট ‘মহিষের দুধের টকদইয়ের রাজ্য’ বলে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে। এই হাটের টকদই স্থানীয়ভাবে যেমন জনপ্রিয়, তেমনি আশপাশের জেলাগুলোর মানুষের কাছেও রসনার এক অনন্য খোরাক।

বিজ্ঞাপন

সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার বসে এই হাট। দুপুর থেকে শুরু হয় হাটে দই বিক্রি। সারি সারি দই বিক্রেতা কাঁধে দইভর্তি হাঁড়ি নিয়ে এসে বসেন বাজারের নির্দিষ্ট স্থানে। মাটির হাঁড়িতে জমা থাকে ঘন, টক আর একেবারে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি দই—যা মূলত মহিষের দুধ থেকে প্রস্তুত করা হয়। এ দই তৈরি হয় কোনোরকম কৃত্রিম রঙ বা রাসায়নিক ছাড়াই।

গৃহপালিত মহিষের দুধ দোহন করে একটু ঠাণ্ডা করে টাটকা দুধ দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে ফারমেন্ট করে তৈরি হয় এই টকদই। এতে প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া থাকার কারণে এটি হজমে সহায়ক, পাশাপাশি ক্যালসিয়াম, প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানে ভরপুর।

স্থানীয় দই বিক্রেতা ওয়াজকুরুনী বলেন, আমাদের দই একেবারে মহিষের টাটকা দুধ দিয়ে তৈরি হয়, এতে কোনো ভেজাল নেই। কোনো রঙ বা কেমিক্যাল ছাড়াই মহিষের খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরি করা। প্রথমে মাটির হাঁড়ি ভালোভাবে পরিষ্কার করে তাতে সামান্য পরিমাণ সরিষার তেল মেখে নিয়ে রোদ বা চুলার তাপে শুকিয়ে নিয়ে তাজা মহিষের দুধ ভালোভাবে ছাকনা দিয়ে ছেকে তারপর হাঁড়িতে রেখে দিতে হয়। ২০ থেকে ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষার পর স্বাদের দই তৈরি হয়।

একটি হাঁড়িতে দুই লিটার থেকে ১৫ লিটার পর্যন্ত দই বসানো যায়। দই বিক্রেতা মোতালেব হোসেন বলেন, প্রতি হাটে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ কেজি দই বিক্রি হয়। মহিষের দই এ এলাকার একটি মজাদার খাবার, যা একবার খেলে ক্রেতা বারবার ফিরে আসেন। এ দইয়ের চাহিদাও অনেক, দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এসে এই হাট থেকে দই কিনে নিয়ে যান।

এই দই বিক্রি করেই অনেক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছে। তবে এলাকায় মহিষের কোনো খামার নেই, নিজেদের গৃহপালিত মহিষের দুধ থেকেই দই তৈরি করে বিক্রি করে এলাকাবাসী। একটি মহিষ দৈনিক চার থেকে আট কেজি দুধ দিয়ে থাকে।

দই উৎপাদনে নারী উদ্যোক্তারাও এগিয়ে এসেছেন। ঈদ, পূজা কিংবা বিয়ে যে কোনো উৎসব উপলক্ষে এ দইয়ের চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়। প্রতি কেজি দই বিক্রি হয় ১২০ থেকে ২৫০ টাকা দরে। এ দইয়ের চাহিদা রমজান মাসে ও ঈদে কয়েকগুণ বেড়ে যায়; ফলে দামও অনেকটা বৃদ্ধি পায়।

এ দই কেবল একটি খাবারই নয়, এটি বকশীগঞ্জবাসীর সংস্কৃতিরও অংশ। অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে খাবারের পর এক কাপ ঠাণ্ডা টকদই যেন পরিপূর্ণতা এনে দেয়। বকশীগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জসহ আশপাশের উপজেলা ও গ্রাম থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ নঈম মিয়ার হাটে এসে দই কিনে নিয়ে যান। কেউ কেউ আবার ঢাকায় আত্মীয়দের জন্য পাঠান এই সুস্বাদু দই।

স্থানীয়দের দাবি, এই দইশিল্পকে কেন্দ্র করে লোকজনকে মহিষ পালনে উদ্বুদ্ধ করে একটি গ্রামীণ দইবাজার গড়ে তুললে এলাকার অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হবে। দই উৎপাদনকারীদের প্রশিক্ষণ, সংরক্ষণের আধুনিক ব্যবস্থা ও সরকারি সহায়তা পেলে এটি হতে পারে একটি জাতীয় ব্র্যান্ড।

বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, মহিষের টকদই একটি স্বাস্থ্যকর খাবার; এর উপকারিতা অনেক। মহিষের দুধের দই উচ্চ প্রোটিন ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ, এতে গরুর দুধের তুলনায় বেশি প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম থাকে; ফলে এই দইয়েও এসব উপাদান বেশি থাকে।

এটি হাড় ও দাঁতের গঠন মজবুত করে। এ দই হজমে অনেক সহায়ক। মহিষের টকদইয়ে থাকা প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া হজমশক্তি বাড়ায় এবং পেটের নানা সমস্যা যেমন গ্যাস, অ্যাসিডিটি ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। দইয়ে থাকা ল্যাক্টোব্যাসিলাস-জাতীয় উপকারী ব্যাকটেরিয়া শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। যদিও মহিষের দইয়ে চর্বির পরিমাণ বেশি, তবুও এটি খেলে দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা অনুভব হয়, ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়।

এছাড়াও ত্বক ও চুলের জন্য উপকারী, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। তিনি আরো বলেন, মহিষের টকদইয়ের ক্ষতিকর দিক নেই বললেই চলে; তবে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে খাওয়াই উত্তম।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত