চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

আলি হায়দার, ভোলাহাট (চাঁপাইনবাবগঞ্জ)
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৫, ১১: ১৮

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্তঘেঁষা মহানন্দা নদীর তীরবর্তী ভোলাহাট উপজেলায় অবস্থিত ‘ভোলাহাট রামেশ্বর পাইলট মডেল ইনস্টিটিউশন’ জেলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১১৫ বছর আগে ১৯১১ সালে এলাকার মানুষের শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়। ব্যবসায়ী রামেশ্বর দাস প্রতিষ্ঠা করেন এটি।

বিজ্ঞাপন

এটা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটা ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শিক্ষার আলোঘর। বিদ্যালয়টি এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে এই অঞ্চলের মানুষকে আলোকিত করে আসছে। এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বহু কৃতী শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন উচ্চপদে কর্মরত রয়েছেন। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে রামেশ্বরের শিক্ষার্থীরা সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। অথচ শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও বিদ্যালয়টি আজও জাতীয়করণ হয়নি। বিদ্যালয়টিকে সরকারিকরণ কেবল শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নয়, উপজেলাবাসীরও প্রাণের দাবি।

এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাবেক ছাত্র বিশিষ্ট মঞ্চ ও টিভি নাট্যকার এবং অভিনেতা অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমেদ বলেছিলেন, ঐতিহ্যমণ্ডিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সরকারি না করা ঘোরতম অন্যায়। এর প্রতিকার হওয়া দরকার।

ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত বাংলার মালদহ জেলার ভোলাহাটের গোপীনাথপুর গ্রামে বাস করতেন রামেশ্বর দাস। তিনি বাঙালি ছিলেন না, ব্যবসার জন্য মেবার অথবা গুজরাট অঞ্চল থেকে এসেছিলেন। রামেশ্বর দাস ও তার সহধর্মিণী ব্রাহ্মময়ী দাসের কোনো সন্তান ছিল না। তারা তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে নিজেদের সম্পদ দিয়ে একটি গম্ভীরা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। পরবর্তী সময়ে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের পরামর্শে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সম্মত হন। তিন একরের বেশি জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠানটি ছয় কক্ষবিশিষ্ট ভবন নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে প্রায় ১৬ বিঘা জমিতে ভবনের সংখ্যা ১০টি এবং কক্ষ ৩৩টি।

ভোলাহাট রামেশ্বর পাইলট মডেল ইনস্টিটিউশনের স্থাপত্য ঐতিহ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ১৯১১ সালে নির্মিত ছয় কক্ষবিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন ভবন। তৎকালীন স্থাপত্য প্রযুক্তি ও নির্মাণ কৌশল দিয়ে গড়ে তোলা ভবনটি আজও অমলিন। এটি বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহার হয়।

প্রতিষ্ঠার পর এর নাম ছিল ‘ভোলাহাট রামেশ্বর হায়ার ইংলিশ স্কুল’। অল্প কয়েক বছরে বিদ্যালয়টি শিক্ষা ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করায় স্কুল কর্তৃপক্ষ একে বহুমুখী শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, স্কুল শব্দটি পরিবর্তন করে এর স্থলে ইনস্টিটিউশন শব্দটি যুক্ত করেন। ফলে স্কুলের নাম হয়ে যায়— ‘ভোলাহাট রামেশ্বর ইনস্টিটিউশন’। ১৯৭৫ সালে নাম করা হয় ‘ভোলাহাট রামেশ্বর পাইলট ইনস্টিটিউশন’। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিক মডেল স্কুল প্রকল্পের আওতায় আনা হলে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ হয় ‘ভোলাহাট রামেশ্বর পাইলট মডেল ইনস্টিটিউশন’।

বিদ্যালয়ে দুটি হোস্টেল ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন। একটি ছিল হিন্দু ছাত্রদের জন্য ‘হিন্দু হোস্টেল’। বর্তমানে হোস্টেলটির স্থানে নির্মিত হয়েছে একটি আধুনিক একাডেমিক দ্বিতল ভবন। দ্বিতীয়টি ছিল মুসলিম ছাত্রদের জন্য ‘মহামেডান হোস্টেল’। বর্তমানে হোস্টেলটির স্থানে ইনস্টিটিউশনের বাসভবন নির্মিত হয়েছে।

AmarDesh_bholahat-2

এটি বহু গুণীজনের স্রষ্টা। এ প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন অসংখ্য মেধাবী ছাত্রছাত্রী। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গর্ব বিশিষ্ট মঞ্চ ও টিভি নাট্যকার ও অভিনেতা অধ্যাপক মরহুম মমতাজউদদীন আহমেদ, শিল্পপতি মিজানুর রহমান, বাংলাদেশ বিমানের চিফ ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার মোজাফ্‌ফর হোসেনসহ অনেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম অর্জন করেছেন। এছাড়াও শিক্ষা, প্রকৌশল, স্বাস্থ্য, প্রশাসন, আইন পেশা ও সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখেছেন বহু সাবেক শিক্ষার্থী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদদীন আহমদ ১৯৫২-১৯৫৩ সালে এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। বর্তমানে মোট ২৩ জন শিক্ষকের মধ্যে ৯ জনই এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে স্কুলটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৬০০ জন।

১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন ভোকেশনাল শিক্ষাক্রম চালু হয়। এতে তিনটি ট্রেড রয়েছে— বিল্ডিং মেইনটেন্যান্স, জেনারেল মেকানিক্স ও জেনারেল ইলেক্ট্রনিক্স। এ শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিনটি আধুনিক সুসজ্জিত ওয়ার্কশপ ছাড়াও এখানে রয়েছে দুটি আধুনিক বিজ্ঞানাগার, কম্পিউটার ল্যাবে ৪৮টি কম্পিউটার। রয়েছে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার।

দর্শনার্থীরা স্কুলের শতবর্ষী আম বাগানের ছায়াতল ও মনোরম পরিবেশে পিকনিকে এসে ইতিহাস এবং প্রকৃতির সংমিশ্রণে মুগ্ধ হন। সাড়ে ১১ বিঘার বিশাল খেলার মাঠে উপজেলা প্রশাসনের জাতীয় কর্মসূচি, গোল্ডকাপ খেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। স্কুল ক্যাম্পাসেই অবস্থিত ভোলাহাট উপজেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।

প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কোরবান আলী বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটিকে জাতীয়করণের জন্য আমরা নিয়মনীতি অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর হওয়ার সময় অনৈতিকভাবে আমাদের প্রতিষ্ঠানের ফাইল সরিয়ে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের ফাইল সংযোজন করা হয়। ফলে প্রাচীনতম এ স্কুলটি বাদ পড়ে উপজেলার অন্য একটি জুনিয়র স্কুল জাতীয়করণের তালিকায় চলে আসে।’ তিনি ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান, ইতিহাস ও অবদান বিবেচনায় দ্রুত জাতীয়করণের আওতায় আনার দাবি করেন।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত