চিকিৎসক-জনবল সংকটে ‘বিকলাঙ্গ’ কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল

আব্দুল্লাহ আল মুজাহিদ, জেলা প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৫, ১৮: ৪৪
আপডেট : ২৩ আগস্ট ২০২৫, ১৯: ৪৬

চিকিৎসক, কর্মচারী এবং আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা। ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে ১৭৭ জন চিকিৎসকের চাহিদা থাকলেও মাত্র ১৮ জন চিকিৎসক দিয়ে চলছে এর কার্যক্রম। ফলে প্রায়ই রোগী ও তাদের স্বজনদের অসন্তোষের মুখে পড়তে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, চিকিৎসক, জনবল এবং প্রয়োজনীয় ওষুধের সংকটের কথা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

হাসপাতালের প্রশাসনিক তথ্যানুসারে, ১৯৬৮ সালে ৫০ শয্যার হাসপাতালটি পরবর্তীকালে ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়। ২০১৭ সালে এটিকে ২৫০ শয্যার হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয়। বর্তমানে ১০০ শয্যার জন্য ৪৩টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে তত্ত্বাবধায়কসহ মাত্র ১৯ জন চিকিৎসক রয়েছেন। অন্যান্য জনবলেরও তীব্র সংকট বিদ্যমান।

স্বাস্থ্যসেবায় সংকট

হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে চিকিৎসক ও জনবলের তীব্র সংকটের প্রমাণ পাওয়া যায়। রোগীদের অভিযোগ, দিনে মাত্র একবার চিকিৎসকের দেখা মেলে। দুপুরের পর ভর্তি হলে শুধুমাত্র জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের সেবা পাওয়া যায়। পরের দিন সকালের আগে আর কোনো চিকিৎসক আসেন না। স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট পেতেও রোগীদের ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়াও, পর্যাপ্ত ওষুধ বা স্যালাইন না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে। ওয়ার্ডগুলোতে শয্যা সংকট, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং শৌচাগারের বেহাল দশা নিয়ে রোগীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী মমিনুর রহমান বলেন, “বৃহস্পতিবার বিকেলে পেট ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছি। ভর্তির সময় শুধু জরুরি বিভাগের ডাক্তার দেখেছেন। এরপর আর কোনো ডাক্তারের দেখা পাইনি।” হাসপাতালের অপরিচ্ছন্নতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “টয়লেটে যাওয়া যায় না। সিঁড়ি থেকে শুরু করে রুমের ভেতরও ময়লা।”

একই ওয়ার্ডের আরেক রোগী মেহের আলী বলেন, “বৃহস্পতিবার রাতে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু পরের দিন দুপুর পর্যন্ত কোনো ডাক্তার পাইনি। শুধু নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিচ্ছি যে হাসপাতালে ভর্তি আছি।”

ওয়ার্ডের বেশ কিছু কক্ষে দেখা যায়, রোগীদের বেডের পাশে লকার নেই। অনেকেই ওষুধ, পোশাক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বেডের ওপর রেখে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিছু কক্ষে বেডও নেই, রোগীরা মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

চিকিৎসক ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে একই অভিযোগ করেছেন হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের রোগী ও তাদের স্বজনরা।

জনবল সংকট

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের চাহিদা কাঠামো অনুসারে ২৫০ শয্যার হাসপাতালে ১৭৭ জন চিকিৎসক প্রয়োজন। কিন্তু দীর্ঘ ৯ বছরেও এই জনবলের অনুমোদন মেলেনি। মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি এবং কার্ডিওলজি বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে কোনো সিনিয়র কনসালটেন্ট নেই। এনেসথেসিস্ট ও অর্থো-সার্জারি ছাড়া সিনিয়র কনসালটেন্টের ৮টি পদ শূন্য। জুনিয়র কনসালটেন্টের ১২টি পদের মধ্যে ৬টিই শূন্য।

চিকিৎসক ছাড়াও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর তীব্র সংকট রয়েছে। ১০০ শয্যার জন্য অনুমোদিত তৃতীয় শ্রেণির ৫১টি পদের বিপরীতে আছে মাত্র ১৭ জন, আর চতুর্থ শ্রেণির ২৯টি পদের বিপরীতে মাত্র ১১ জন কর্মরত। এতে শত শত রোগীকে সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

সদ্য যোগদানকারী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. নুর নেওয়াজ আহমেদ জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, “শুধু কুড়িগ্রাম নয়, সারাদেশেই চিকিৎসক সংকট রয়েছে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চাহিদা পাঠিয়েছি। খুব শিগগিরই কিছু চিকিৎসক পেতে পারি। আর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদগুলোতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

ওষুধ সংকট এবং দুপুরের পর চিকিৎসক না থাকা প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক বলেন, “বিষয়টি নিয়ে আমি মিটিং করে ব্যবস্থা নেব। রাতের বেলা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা রাউন্ড দেবেন। ওষুধ সংকটের বিষয়েও চাহিদা পাঠানো হয়েছে। আশা করছি সেগুলো খুব তাড়াতাড়ি পাব।”

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত