অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়া নীলফামারী জেলা পরিষদ

আব্দুর রাজ্জাক, নীলফামারী
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৫, ০৬: ৪১

বছরের পর বছর একই কর্মস্থলে থেকে গুটিকয়েক কর্মচারীর ধারাবাহিক পদোন্নতি আর নিজ পরিবারের সদস্যদের নিয়োগদানসহ নানা কারণে ‘পারিবারিক কার্যালয়’ নামে পরিচিতি পেয়েছে নীলফামারী জেলা পরিষদ।

অভিযোগ রয়েছে, জনবল নিয়োগ পরীক্ষায় উপস্থিত না থেকেও নিম্নমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক পদের চূড়ান্ত ফলাফলপত্রে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছেন এক প্রার্থী।

বিজ্ঞাপন

নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভুক্তভোগী চাকরিপ্রত্যাশীরা বলছেন, গুটিকয়েক কর্মচারী অনিয়মের আখড়া বানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নীলফামারী জেলা পরিষদকে।

জাহিদ হোসেন নামে এক চাকরিপ্রত্যাশী অভিযোগ করে বলেন, জেলা পরিষদের নিম্নমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক পদে আমি যথানিয়মেই আবেদন করি। কিন্তু কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আর পরিবারতন্ত্রের প্রতিযোগিতার কবলে পড়ে চাকরি তো দূরের কথা, পরীক্ষায় অংশগ্রহণেরও সুযোগ পাইনি।

তিনি বলেন, প্রবেশপত্র অনুযায়ী ২০১৯ সালের ৬ জুলাই পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও অনিবার্য কারণ দেখিয়ে তা বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে জানতে পারি কোনোরকম পরীক্ষা ছাড়াই ওই তারিখেই পরীক্ষা দেখিয়ে নিয়মের তোয়াক্কা না করে ৩২ বছর বয়সি এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছে নিয়োগ ও পদোন্নতি-সংক্রান্ত বাছাই কমিটি।

শুধু জাহিদ হোসেনই নন, একই অভিযোগ করেন ওই পদে চাকরিপ্রত্যাশী হুমায়রা ফারজানাসহ বিভিন্ন পদে আবেদনকারী অনেকেই। ভুক্তভোগীদের দেওয়া নানা অনিয়মের অভিযোগের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে জেলা পরিষদে জনবল নিয়োগে অনিয়মসহ নানা অসংগতির চিত্র।

জেলা পরিষদের নিয়োগ ও পদোন্নতি-সংক্রান্ত বাছাই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৎকালীন জেলা প্রধান নির্বাহীর (ভারপ্রাপ্ত) দায়িত্বে থাকা ড. সাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক নথি থেকে জানা যায়, অনিবার্য কারণবশত জেলা পরিষদের সার্ভেয়ারের একটি শূন্যপদে বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে ২০১৯ সালের ৬ জুলাই এর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ৯ জুলাই সকাল ১১টায় অনুষ্ঠিত হবে।

কিন্তু পদোন্নতি-সংক্রান্ত বাছাই কমিটির সদস্য সচিব তৎকালীন জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম স্বাক্ষরিত অপর এক নথি বলছে, শুধু সার্ভেয়ার পদেই নয়, সাঁটলিপিকার পদে একটি, নিম্নমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক পদে একটি এবং ইলেকট্রিশিয়ানের একটি পদে ৬ জুলাইয়ের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা বাতিল করে তা ৯ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে মর্মে নোটিস জারি করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ সালের ৬ জুলাইয়ের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে মর্মে দেখানো হয়। এমনকি অনিয়মের মাধ্যমে পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দেয় তারা।

জনবল নিয়োগে সরকারি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায় নিয়োগকৃত কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেন তৎকালীন জেলা পরিষদের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপপরিচালক আব্দুল মোতালেব সরকার।

এ ব্যাপারে জেলা পরিষদের তৎকালীন নিয়োগ ও পদোন্নতি-সংক্রান্ত বাছাই কমিটির সদস্য সচিব এবং জেলা পরিষদের সাবেক সহকারী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান ভিন্ন কথা। ২০১৯ সালের ৬ জুলাই জেলা পরিষদে নিম্নমান সহকারীসহ বিভিন্ন পদে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা হয়েছে মর্মে দাবি করেন তিনি।

অপরদিকে ২০১৯ সালের ৬ জুলাই জনবল নিয়োগের কোনো লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষা হয়নি, কার্যালয়টির তৎকালীন কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরিত একাধিক নথি রবিউল ইসলামের কাছে উপস্থাপন করলে অবশেষে ‘পরীক্ষা হয়নি’ মর্মেও স্বীকার করেন তিনি।

আবার ৯ জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফলপত্রে ৬ জুলাই স্বাক্ষর করলেন কীভাবেÑসাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ৬ জুলাই বিকালে পরীক্ষা হয়েছে মর্মে দাবি করেন সহকারী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম।

২০১৯ সালের ৬ জুলাই জনবল নিয়োগের পরীক্ষার তারিখ পিছিয়ে ৯ জুলাই দেখিয়ে কার্যালয়টির নিম্নমান সহকারীসহ বেশকটি পদে জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ জনবল নিয়োগ দিলেও সাবেক কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম স্বাক্ষরিত নিম্নমান সহকারীর চূড়ান্ত ফলাফলপত্রের নথি অনুযায়ী পরীক্ষার তারিখ দেখানো হয়েছে ২০১৯ সালের ৬ জুলাই। এমনকি স্বাক্ষরিত ওই চূড়ান্ত ফলাফলপত্রে দেখানো নিম্নমান সহকারী পদে পরীক্ষা না দিয়েও দ্বিতীয় হয়েছেন এক প্রার্থী।

এদিকে, ১৯৯২ সালে নীলফামারী জেলা পরিষদে দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে (মাস্টার রোল) ডুপ্লিকেটিং মেশিন অপারেটর হিসেবে আব্দুল হাই যোগদান করলেও তিনি বাগিয়েছেন ধারাবাহিক পদোন্নতি। বর্তমানে কার্যালয়টির প্রধান সহকারী তিনি। এ ধারাবাহিকতায় জেলা পরিষদে আব্দুল হাইয়ের শ্যালক শাহজাহান আলী অফিস সহায়ক, আরেক শ্যালক জাহাঙ্গীর আলম ফটোকপি অপারেটর পদ বাগিয়েছেন। উচ্চমান সহকারীর পদ বাগিয়েছেন আব্দুল হাইয়ের ছেলে ওমর ফারুক।

শুধু তা-ই নয়, কার্যালয়টির পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে জনবল নিয়োগে কর্মচারীদের পরিবারকেন্দ্রিক ও আত্মীয়করণের এই চিত্র দেশের অন্য সব জেলা পরিষদে বিরল বলেও মনে করছেন ভুক্তভোগীসহ স্থানীয়রা।

গণশুনানিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও এখনো দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ফলে স্থানীয়রা বলছেন, দুর্নীতির গডফাদার আব্দুল হাইয়ের খুঁটির জোর কোথায়?

এ ব্যাপারে নীলফামারী জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দীপঙ্কর রায় সাংবাদিকদের জানান, পূর্বে অনিয়ম হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে একই কর্মস্থলে থাকা সাবেক সহকারী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম কার্যালয়টির একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হয়েও তার দুরকম কথাবার্তা আর ভিন্ন ভিন্ন তারিখে স্বাক্ষরিত নিয়োগ-সংক্রান্ত নথি তদন্ত করে পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত