রংপুরের তারাগঞ্জের কুর্শা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম রহিমাপুর মোল্লাপাড়া। যেখানে চারদিকে সবুজ ক্ষেত-খামার, কাঁচা-পাকা রাস্তা আর দরিদ্র মানুষের নিত্যদিনের সংগ্রাম। এমনি গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে স্বপ্নের আলো জ্বালিয়ে রেখেছে লাকি আপার ফ্রি পাঠশালা। এই বিদ্যানিকেতনের পেছনের মানুষটি হলেন- মোবাশ্বেরা খাতুন লাকি। যাকে সবাই লাকি আপা নামে জানে। নিজের স্বপ্ন ভেঙে গেলেও অন্যদের স্বপ্ন দেখানোর দায় তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
ছোটবেলায় লাকি আপার স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হওয়ার। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল প্রবল। কিন্তু পরিবারের আর্থিক দুর্দশা ও অসুস্থ বাবা-মায়ের দেখাশোনা সেই স্বপ্নকে করেছিল বাধাগ্রস্ত ।
বাবা মোবারক প্রামাণিকের অসুস্থতায় টানা পাঁচবার অপারেশন, মা ছারপিয়া বেগমের ব্রেন স্ট্রোকে মৃত্যুর ধাক্কা। সে সঙ্গে পাঁচ বোনের সংসারের দায়িত্ব সব মিলিয়ে কষ্টের পাহাড় সামলাতে হয়েছে তাকে।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১০ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির অধীনে শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি নেন। পড়ান স্থানীয় কবিরাজপাড়া ব্র্যাক স্কুলে। সে সময় বেতন পেতেন মাত্র আটশ টাকা। সে টাকায় নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারেও সহায়তা করতেন। তার শিক্ষা প্রদানের কৌশলে সে সময় তিনি হয়ে ওঠেন তারাগঞ্জ ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচির শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা। ব্র্যাকের হয়ে অংশ নেন ফরিদপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায় শিক্ষাবিষয়ক নানা প্রশিক্ষণে।
১৯৯৯ সালে স্থানীয় বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। পরে সৈয়দপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হলেও পারিবারিক কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। পরে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০০১ সালে এইচএসসি পাস করেন।
ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি একসময় বন্ধ হয়ে গেলেও শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছাটা ছিল অটুট। নিজের স্বপ্ন পূরণ না হলেও অন্যদের স্বপ্ন দেখানোর সুযোগ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তাই নিজ বাড়ির একটি ঘরে মাত্র ৮-১০ জন শিশুকে নিয়ে পড়ানো শুরু করেন। ৮-৯ বছর ধরে ধীরে ধীরে সেই ছোট্ট ঘরের পাঠশালা পুরো গ্রামের আশার আলো হয়ে উঠেছে।
এখানে পড়াশোনার জন্য কোনো ফি বা খরচ লাগে না। বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘরে মাটির মেঝেতে চট বিছিয়ে শিশুদের বসানো হয়। নেই কাঠের বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল। তবু অভিভাবকদের চোখে এটি ভবিষ্যতের আলোর দিশারী।
লাকি আপা শুধু বইয়ের পড়াই শেখান না। শেখান শৃঙ্খলা, সততা, মানবিকতা ও দেশপ্রেম। শিশুদের প্রতিদিন পাঠদানের পাশাপাশি জীবনবোধের গল্প শোনান। তাই শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি শিক্ষক নয়, হয়ে ওঠেন মা বা বড় বোনের মতো আপনজন।
বর্তমানে তার পাঠশালায় সকাল-বিকাল দুবেলা মোট ২৫-৩০ জন শিশু নিয়মিত পড়াশোনা করে। ইতোপূবে তার কাছে শিক্ষায় হাতেখড়ি নিয়ে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে কেউ জেলা স্কুল শিক্ষক, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, আবার কেউবা সরকারি চাকরিজীবী।
নিজের স্বপ্ন ভেঙে গেলেও গ্রামের অগণিত শিশুর স্বপ্ন দেখানোর শক্তিই তাকে অবিচল রেখেছে। রহিমাপুরের সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেন, লাকি আপার মতো একজন মানুষ থাকলে অন্ধকার ভেদ করেই আলো আসবেই।
গ্রামের দিনমজুর আনা হোসেন বলেন, আমার ছেলে কখনো স্কুলে যেত না। এখন লাকি আপার কাছে পড়ে নাম-ধাম লিখতে পারে। আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন সে চাকরি করবে।
উত্তর রহিমাপুর নয়াহাট সরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, লাকি আমারই ছাত্রী ছিল। ছোট থেকেই অত্যন্ত মেধাবী। তার পাঠদানের কৌশল ভিন্ন, খুব সহজেই যে কোনো বিষয় শেখাতে পারে। এটি তার বিশেষ গুণ।
মোবাশ্বেরা খাতুন লাকির স্বপ্ন কেউ সহায়তা বা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে ভবিষ্যতে বড় পরিসরে একটি স্কুল খুলবেন। তিনি আমার দেশকে বলেন, একজন মানুষ চাইলে পুরো সমাজকেই বদলে দিতে পারে। এজন্য প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা । নিজের স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে না পারলেও তিনি অন্যদের স্বপ্ন দেখার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই ।

