দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও দ্যুতি ছড়াচ্ছে শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়

কামরুল হাসান, হবিগঞ্জ
প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৫, ১১: ৩৩

বাঁশ ও কঞ্চি দিয়ে তৈরি বেড়ার ঘরে পাঠদান শুরু করা বিদ্যালয়টি সময়ের পরিক্রমায় এখন শতাব্দী পেরোনো জ্ঞানের বাতিঘর। দীর্ঘ সময় ধরে নীরবে-নিভৃতে শিক্ষার দ্যুতি ছড়াচ্ছে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়। এই বিদ্যাপীঠে শিক্ষায় হাতেখড়ি নিয়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন গুণী ব্যক্তিত্বরা।

চিকিৎসা, বিজ্ঞান, শিক্ষা, আইন ও সাংবাদিকতার মতো সৃজনশীল মহান পেশায় ব্রতী আছেন তারা। এসব বিদ্যানের ধারণ করে একদিকে শিক্ষালয়টি যেমন স্বনামধন্য হয়েছে, তেমনি জীবনের প্রথম পাঠ নিয়ে যারা কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত তারাও হয়েছেন ধন্য ও গর্বিত। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে অবকাঠামো সংকট, শিক্ষক স্বল্পতাসহ নানা সমস্যা বিদ্যমান। এ থেকে উত্তরণ হলে শতবর্ষী বিদ্যালয়টি ফিরে পাবে আপন মহিমা।

বিজ্ঞাপন

কজন শিক্ষক আর হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে যাত্রা হলেও বর্তমানে স্বমহিমায় বিকশিত হয়ে বিদ্যালয়টি একটি আদর্শ পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে। আলোকিত মানুষ গড়তে ১০৭ বছর ধরে জ্ঞানের আলো বিলিয়ে যাচ্ছে।

১৯১৮ সালে এলাকার প্রতাপশালী জমিদার নবীন বাবুর দান করা জমিতে গড়ে উঠেছিল শায়েস্তাগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় নামে। শতবর্ষের অর্জন বিদ্যালয়টিকে যেমন দিয়েছে গরিমা, তেমনি এলাকার মানুষের মনের মণিকোঠায় জ্বালিয়েছে মানবিক মহিমার হিরণ্মময় দ্যুতি।

বিদ্যাপীঠে হাতেখড়ি নিয়ে যারা আজ স্মরণীয়

এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে বিশ্বময় নানা পেশায়, নানা কর্মকাণ্ডে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে গৌরবময় স্থান অলঙ্কৃত করে আছেন এই বিদ্যালয়ের কীর্তিমান শিক্ষার্থী। যুক্তরাষ্ট্রের টুলান বিশ্ববিদ্যালয়ে (Tulane University) ফিজিওলজি বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড. এস এ মজিদ। যিনি ২০১৭ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল মনোনীতদের নামের তালিকায় ছিলেন।

দেশের দুজন প্রধান বিচারপতি ছিলেন এ বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন ও সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেন। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লস্করপুর গ্রামে তাদের বাড়ি।

এছাড়াও যাদের নিয়ে এ বিদ্যালয় গর্ববোধ করে তাদের মধ্যে রয়েছেন— যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির এক সময়ের গবেষক ড. শোয়েব চৌধুরী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মন্টগোমারি ইউনিভার্সিটির এডজাংকট প্রফেসর। এই বিদ্যালয়ের আরেক প্রাক্তন ছাত্র ব্যারিস্টার তারেক চৌধুরী ব্রিটেনে ব্যারিস্টার ও সলিসিটর হিসেবে ক্রস কোয়ালিফাইড। বর্তমানে তিনি ব্রিটেনের কিংডম সলিসিটরস-এর প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক আবদুন নূর চৌধুরী ও আকিলা খানম চৌধুরীর ছেলে।

এস এম মিজানুর রহমান। তিনি ১৯৬৭ সালে শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেধা তালিকায় স্থানসহ প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। পড়ালেখা শেষ করে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৭৯ সালে তিনি সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে সরকারি চাকরিতে পেশাগত কর্মজীবন শুরু করেন। ধারাবাহিকতায় সুনামের সঙ্গে র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আরেকজন হলেন— অশোক মাধব রায়। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন।

এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যাংকের এমডি ও ব্যবসায়ীসহ নানা পেশায় সুনাম কুড়িয়েছেন এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

সাংবাদিকতার মতো মহান পেশায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন দৈনিক আমার দেশ-এর নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ। যার ক্ষুরধার ও বস্তুনিষ্ঠ লেখনি দেশের সমাজ-রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। একই গণমাধ্যমে কর্মরত আছেন পত্রিকাটির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জাহেদ চৌধুরী ও চিফ রিপোর্টার বাছির জামাল। যাদের কলম সব সময় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলে। তারা তিনজনই এই বিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারুনুর রশিদ তালুকদার জানান, সার্বিক পরিবেশ সুন্দর রাখতে এবং শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য কাজ করছেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। তাদের সহযোগিতা ও পরামর্শ সব সময় থাকে এই বিদ্যালয়ের জন্য।

তিনি বলেন, এই প্রাচীনতম বিদ্যালয়ে যেসব শ্রদ্ধেয় মানুষ শিক্ষকতায় আত্মনিবেদন করেছিলেন তারা ছিলেন প্রকৃত বিচারে জাগতিক লোভমুক্ত, সদাচারী আর মানুষ গড়ার প্রত্যয়ী প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষক। এমন অনেক শিক্ষকের মধ্যে প্রসঙ্গক্রমে প্রয়াত প্রধান শিক্ষক আব্দুন নুর চৌধুরী স্যারের নাম উল্লেখ করছি, যিনি ছিলেন একজন আধুনিক বিজ্ঞানমনষ্ক শিক্ষক। তার সময়ের তুলনায় তিনি ছিলেন অনেক প্রাগ্রসর। তিনি এক সময় বেসরকারি শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সারা দেশে এই স্কুলকে নেতৃত্বের আসনে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেছেন। এছাড়াও এ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন মহেশ চন্দ্র চক্রবর্তী, তিনি ১৯৫১ সাল পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।

প্রাক্তন শিক্ষার্থী ব্যাংকার আনোয়ার ফারুক তালুকদার শামীম বলেন, এই স্কুলের ইতিহাস বললে যে নামটি ছাড়া স্কুল অসম্পন্ন, তিনি হলেন প্রধান শিক্ষক আব্দুন নুর চৌধুরী। তিনি একাধারে আমাদের শিক্ষক ও পিতার দায়িত্ব পালন করেছেন। শিক্ষাদানে আলোকবর্তিকা হিসেবে আগমন ঘটেছিল ক্ষণজন্মা এই শিক্ষাবিদের।

বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আ স ম আফজল আলী বলেন, এই বিদ্যালয়ের অনেক স্মৃতি আজও খুব মিস করি। সবচেয়ে বেশি মিস করি প্রধান শিক্ষক আব্দুন নুর স্যারের কথা।

প্রাক্তন শিক্ষার্থী বিশিষ্ট সাংবাদিক জাহেদ চৌধুরী বলেন, স্মৃতি সততই সুখের। বিশেষ করে সেই স্মৃতি যদি হয় শৈশবের, তাহলে তো কথাই নেই। ছেলেবেলার কথা ভোলার মতো নয়। মানস গঠনের সময় হচ্ছে শৈশব। যে স্কুলে বিদ্যা আরম্ভ, তাকে মনের মণিকোঠায় লালন করতেই হয়। চোখ বুঝলে হাজারো স্মৃতি এই স্কুলকে নিয়ে। উল্লেখযোগ্য জায়গাজুড়ে আছে ছোটবেলার এই স্কুল। সেই বিদ্যালয় যদি হয় শতবর্ষী, তাহলে বুকটা গর্বে ভরে যায়।

বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. মহিবুর রহমান জানান, ২০১৮ সালে বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন কমিটি ‘শতবর্ষ ভবন’ নামে একটি নতুন ভবন করার উদ্যোগ নিয়ে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। মাত্র একটি ছয়তলা ভবন রয়েছে, এছাড়া পুরাতন টিনসেডের ঘরগুলো জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই নতুন ভবন খুবই প্রয়োজন।

তিনি আরো জানান, ছয় শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্য ১৮ জন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে আছে ১৪ জন। চারজন শিক্ষকের পদ শূন্য।

বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কনিক চন্দ্র শর্মা বলেন— দায়িত্ব পেয়েছি মাত্র পাঁচ মাস হলো। বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই হতাশাজনক দেখে এর সুনাম ফিরিয়ে আনার জন্য শিক্ষকদের নিয়ে এ পর্যন্ত একাধিক সভা করেছি। প্রতি ক্লাসে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক ক্লাস পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আশা করি পরীক্ষার ফলাফল ভালো করতে পারলেই শতবর্ষের বিদ্যালয়টির সুনাম ফিরিয়ে আনতে পারব।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত