স্বর্ণের বাজারে ব্যাপক অস্থিরতা, ভরসা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৩: ৪৯

স্বর্ণের বাজারে ব্যাপক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ও নিরাপদ বিনিয়োগের চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি মার্কিন মুদ্রাস্ফীতি, অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির পর মুনাফা তুলে নেয়াসহ বিনিয়োগকারীদের সতর্ক অবস্থানের কারণে স্বর্ণের বাজারে এমন অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত শুক্রবার প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিএলএস) তথ্যে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাসে ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) বেড়েছে ০.৩ শতাংশ। ফলে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি ২.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩ শতাংশে পৌঁছেছে।

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাষ্ট্রে বছরের সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করছে; বেড়েছে খাবার ও তেলের দামও। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই হার এখনো নিয়ন্ত্রণসীমার বাইরে নয়।

প্রধানত জ্বালানি তেলের দামই এই বৃদ্ধির মূল কারণ। সেপ্টেম্বরে গ্যাসোলিনের দাম বেড়েছে ৪.১ শতাংশ এবং নিয়মিত আনলেডেড জ্বালানির দাম বেড়েছে ৪.২ শতাংশ; দুটিই ২০২৩ সালের আগস্টের পর সর্বোচ্চ মাসিক বৃদ্ধি।

খাদ্যপণ্যের দাম আগের মাসের তুলনায় কিছুটা ধীরগতিতে বেড়েছে, আর আবাসন খাতে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতাও কমেছে।

অর্থনীতিবিদদের ধারণা ছিল, সেপ্টেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি ০.৪ শতাংশ এবং বার্ষিক হার ৩.১ শতাংশে পৌঁছাবে। তবে বাস্তবে কিছুটা কম হয়েছে। খাদ্য ও জ্বালানি বাদে মূল মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে ০.২ শতাংশ, যা বার্ষিক ভিত্তিতে ৩ শতাংশ।

নেভি ফেডারেল ক্রেডিট ইউনিয়নের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিদার লং বলেন, ‘৩ শতাংশে ফিরে আসা এক ধরনের মানসিক সীমারেখা। এটি দেখায়, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি।’

মুডিস অ্যানালিটিকস জানায়, মুদ্রাস্ফীতির কারণে গড় মার্কিন পরিবারকে আগের বছরের তুলনায় মাসে ২০৮ ডলার এবং ২০২১ সালের শুরুতে তুলনায় ১ হাজার ৪৩ ডলার বেশি খরচ করতে হচ্ছে একই পণ্য ও সেবার জন্য।

এদিকে তুলনামূলক নরম মুদ্রাস্ফীতির এই তথ্য ফেডারেল রিজার্ভকে সুদের হার কমানোর পথে উৎসাহ দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তবে ফিডবন্ডসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টোফার রুপকি সতর্ক করে বলেছেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্কনীতির পূর্ণ প্রভাব এখনো পড়েনি। শ্রমবাজারের মন্থরতা অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করতে পারে।’

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, উচ্চ শুল্কের কারণে পোশাক, গৃহসজ্জা, জুতা ও গৃহস্থালী পণ্যের দাম বেড়েছে। গাড়ি বাদে মূল পণ্যের দাম বছরে ১.৩ শতাংশ বেড়েছে, যা ২০২৩ সালের আগস্টের পর সর্বোচ্চ।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ১ অক্টোবরের অচলাবস্থার (শাটডাউন) পর এটি প্রথম বড় অর্থনৈতিক প্রতিবেদন। বিলম্বিত এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে ২০২৬ সালের সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা সমন্বয়ের সময়সীমা পূরণের জন্য।

বাজার ইতোমধ্যে ২৫ বেসিস পয়েন্ট সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা মূল্যায়নে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং ডিসেম্বরেও আরো একটি হার কমানোর প্রত্যাশা রয়েছে। কম সুদের হার সাধারণত স্বর্ণের মতো অ-সুদভিত্তিক সম্পদের জন্য ইতিবাচক।

এদিকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের বাজারেও সোনার দরে বড় দরপতন হয়। মাত্র একদিনের ব্যবধানে সবচেয়ে ভালোমানের (২২ ক্যারেট) সোনার দাম ভরিতে সাড়ে ১০ হাজার টাকা কমিয়েছে দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। আর তাতে এক ধাক্কায় প্রতি ভরি সোনার দাম ১ লাখ ৯৩ হাজার ৮০৯ টাকায় নামে। এর আগে দেশে কখনই একবারে সোনার দাম এতটা কমেনি। টানা কমছে মূল্যবান এই ধাতুর দর; দেশের বাজারে টানা তিনদিন (রোববার, সোম ও মঙ্গলবার) কমেছে। এই তিনদিনে ভরিতে ১৫ হাজার ১৮৬ টাকা কমেছে; ছয় দিনের ব্যবধানে কমেছে ২৩ হাজার ৫৭২ টাকা। কিছুদিন আগে লাফিয়ে লাফিয়ে যে গতিতে বেড়েছিল, এখন সেই একই গতিতে নামছে সোনার দর।

তবে গতকাল বুধবার রাতে দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়িয়ে দেয় বাজুস। সবচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) সোনার দাম বাড়ানো হয় ৮ হাজার ৯০০ টাকা। এতে এক ভরি সোনার দাম ২ লাখ ২ হাজার ৭০৯ টাকা হয়।

রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০ অক্টোবর দেশের বাজারে ২২ ক্যারেট মানের সোনার ভরি ২ লাখ ১৭ হাজার ৩৮২ টাকায় উঠেছিল। এর আগে কখনই সোনার দর অত উচ্চতায় উঠেনি।

দুইদিন পর ২২ অক্টোবর এক ধাক্কায় এই মানের সোনার দর ভরিতে ৮ হাজার ৩৮৬ টাকা কমায় বাজুস; ভরি নামে ২ লাখ ৮ হাজার ৯৯৫ টাকায়। ২৩ অক্টোবর থেকে এই দরে বিক্রি হয় সোনা।

গত ২৬ অক্টোবর এই সোনার দাম ভরিতে আরো এক হাজার ৩৮ টাকা কমানো হয়; ভরি নামে ২ লাখ ৭ হাজার ৯৫৮ টাকায়। ২৭ অক্টোবর এই দরে বিক্রি হয়। ওইদিন রাতে আরো ৩ হাজার ৬৭৪ টাকা কমানো হয়; ভরি নামে ২ লাখ ৪ হাজার ২৮৩ টাকায়। ২৮ অক্টোবর সারা দেশে এই দরে বিক্রি হয়।

২৪ ঘণ্টা না যেতেই আরেক দফা কমানো হয়। এ দফায় কমানো হয় ভরিতে ১০ হাজার ৪৭৪ টাকা। আর এতেই ভরি ২ লাখ টাকার নিচে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৮০৯ টাকায় নামে। অন্যান্য মানের সোনার দরও প্রায় একই হারে কমিয়েছে বাজুস। বুধবার থেকে নতুন দর কার্যকর। এ নিয়ে ছয়দিনের ব্যবধানে চার দফায় ২২ ক্যারেট সোনার দাম ভরিতে ২৩ হাজার ৫৭২ টাকা কমে।

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় দেশের বাজারেও সোনার দাম বাড়ানো হচ্ছিল। আগস্টের মাঝমাঝি সময় থেকে বিশ্ববাজারে সোনার দাম বাড়া শুরু হয়। এর সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারেও দাম বাড়িয়ে চলে বাজুস। এই আড়াই মাসে দু-এক বার ছাড়া প্রতিবারই দাম বাড়ানো হয়।

বাজুসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে অস্থির ছিল দেশের সোনার বাজার। পুরো মাসে মোট ১২ বার দাম সমন্বয় করা হয়। এর মধ্যে ১০ বারই বাড়ানো হয়, কমে মাত্র দুইবার। সেপ্টেম্বর মাসে ২২ ক্যারেট মানের প্রতিভরি সোনার দাম বাড়ে ২১ হাজার ৬৬ টাকা। চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট ৭০ বার সোনার দাম সমন্বয় করেছে বাজুস। এর মধ্যে ৪৮ বার বেড়েছে আর কমেছে ২২ বার। গত বছর পুরো সময়ে দাম সমন্বয় হয়েছিল ৬২ বার।

বাজুসের নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, নতুন মূল্য অনুযায়ী ২১ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম বেড়ে এক লাখ ৯৩ হাজার ৫০৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৮ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম এক লাখ ৬৫ হাজার ৮৬২ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির এক ভরি সোনার দাম এক লাখ ৩৭ হাজার ৮৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে অপরিবর্তিত আছে রুপার দাম। ২২ ক্যারেটের রুপার ভরি চার হাজার ২৪৬ টাকা, ২১ ক্যারেটের রুপার দাম ভরি চার হাজার ৪৭ টাকা এবং ১৮ ক্যারেটের রুপার দাম ভরি তিন হাজার ৪৭৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর সনাতন পদ্ধতির এক ভরি রুপার দাম দুই হাজার ৬০১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এদিকে বিশ্ববাজারেও সোনার দরে পতন হয়েছে; রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে গত ২০ অক্টোবর অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে প্রতি আউন্সের (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) দাম ৪ হাজার ৩৫০ ডলারে উঠেছিল। সপ্তাহ ধরে তা কমতে কমতে ৪ হাজার ডলারের নিচে নেমে এসেছে। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ৪১ ডলার ৪৩ সেন্ট কমে ৩ হাজার ৯৬৩ ডলার ৯৫ সেন্টে নেমেছে। শতাংশ হিসাবে কমেছে ১.০৩ শতাংশ। গত সোমবার বাজুস যখন দেশর বাজারে সোনার দাম কমানোর ঘোষণা দেয়, তখন বিশ্বাবাজারে প্রতি আউন্স সোনার দর ছিল ৩ হাজার ৯৮৬ ডলার ৯০ সেন্ট।

এই বছর স্বর্ণের দাম প্রায় ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, সুদের হার কমানোর প্রত্যাশা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর অব্যাহত স্বর্ণ ক্রয় এই উত্থানের মূল কারণ।

জেনার মেটালসের সিনিয়র স্ট্র্যাটেজিস্ট পিটার গ্রান্ট বলেন, যে মৌলিক কারণগুলো স্বর্ণের দাম বাড়িয়েছে, সেগুলো এখনও বিদ্যমান। দামের সাম্প্রতিক পতনের পর কিছু বিনিয়োগকারী সুযোগ নিচ্ছেন, পাশাপাশি নতুন ভূরাজনৈতিক উদ্বেগও এ অস্থিরতাকে উস্কে দিয়েছে।’

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত