ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি আয় কমে যাওয়া, বিনিয়োগে স্থবিরতা, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের বাড়তি চাপ, শেয়ারবাজারে মন্দা, কর্মসংস্থানের সংকোচন, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপÑসব মিলিয়ে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি গুরুতর চাপে রয়েছে। অর্থনীতির এসব নেতিবাচক খবরের মধ্যেও স্বস্তির জায়গা তৈরি করেছে রেমিট্যান্স। প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখছেন, সচল রাখছেন।
মূলত রেমিট্যান্সের ওপর ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে দেশের বর্তমান অর্থনীতি। রেমিট্যান্সের প্রবাহ না বাড়লে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়ত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২৯ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার, আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ২৪ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে এ সময়ে রেমিট্যান্স বেশি এসেছে ৫ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার, শতকরা হিসাবে বৃদ্ধির হার ১৮ শতাংশ।
গত বছরের জুলাই বিপ্লবে পতিত প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত প্রবাসী আয় বেড়েছে ৪৬ শতাংশেরও বেশি। এ সময়ে প্রবাসী আয় হয়েছে ৪১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। আগের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্সের বড় ধরনের প্রবৃদ্ধির কারণে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের স্বস্তি বিরাজ করছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমার দেশকে বলেন, রেমিট্যান্সের ওপর ভর করেই বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য বিরাজ করছে। এটা যদি না থাকত তাহলে এখন আমরা যে কমফোর্ট জোনে আছি, সেটি থাকত না। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়হারেও স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। ধীরে ধীরে রিজার্ভের পরিমাণও বাড়ছে।
কৃষি খাতকে দেশের অর্থনীতির আরেকটি প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে উল্লেখ করে জাহিদ হোসেন বলেন, নানা প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও দেশের কৃষকরা ফসল ফলাচ্ছেন। আল্লাহর বিশেষ রহমতে ফলনও ভালো হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ঘটনা। বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে এক ধরনের উৎকণ্ঠা থাকলেও সেটি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তবে গ্যাস সংকট বিনিয়োগ ও রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ সমস্যা মোকাবিলায় স্বল্পমেয়াদি চাহিদা ব্যবস্থাপনার পরামর্শ দেন তিনি। গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা আমাদের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পাল্টা শুল্কে বাংলাদেশের যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল, আমরা সেটিকে কাজে লাগাতে পারছি না বলেও মন্তব্য করেন ড. জাহিদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও মাইক্রোফাইন্যান্স রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ আমার দেশকে বলেন, অর্থনীতির যেসব সূচক রয়েছে সেগুলো সব সময় সমানভাবে কাজ করে না। একটি বা দুটি সূচক যখন খারাপ থাকে, তখন অন্য সূচকগুলো সেগুলোকে স্থিতিশীল হতে সহায়তা করে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স বড় ধরনের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। রেমিট্যান্সের কারণে দেশের রিজার্ভ বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ের ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। রেমিট্যান্সের কারণে ভোক্তার ভোগেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলের সঙ্গে কার্ব মাকেটে ডলারের রেটে বড় ধরনের পার্থক্য নেই। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার পাঠানোর প্রবণতা তৈরি হয়েছে। আগের তুলনায় অনেক কঠোরভাবে নজরদারির কারণে ডলার পাচার রোধ হয়েছে। হুন্ডির পরিমাণও আগের চেয়ে কমছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতিতে একটি সংকট তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে অবাধ লুটপাট, দুর্নীতি, অর্থপাচার, লুটেরা গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক দখল, শেয়ারবাজারে কারসাজি, বেহিসাবি বিদেশি ঋণের ভারে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়েছিল। নাজুক হয়ে পড়েছিল দেশের আর্থিক ভিত।
সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, ফ্যাসিস্ট হাসিনার সহযোগী ব্যবসায়ী ও আমলাদের অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে, কেউ কেউ পলাতক কিংবা আত্মগোপনে রয়েছে। দুর্নীতির কারণে কেউ কেউ কারান্তরীণ রয়েছে। ফলে ১৫ বছরে লুটপাটের মাধ্যমে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, সেখানেও একটি রূপান্তর ঘটছে। এ কারণে ব্যবসায় কিংবা পুঁজির প্রবাহেও পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যেও ধীরগতি তৈরি হয়েছে। নতুন বিনিয়োগও স্থবির হয়ে পড়ছে। বিগত আমলে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে নেওয়া হরিলুটের অনেক প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। গত অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৬৮ শতাংশ, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে এমন একটি দুর্যোগময় সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহের বড় ধরনের উল্লম্ফনের কারণে বড় ধরনের আর্থিক বিপর্যয় সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১০৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল। সে ঋণ পরিশোধের বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে বিগত অর্থবছরে অন্তর্বর্তী সরকার রেকর্ড চার বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে। সে ঋণ পরিশোধ করেও রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, শেখ হাসিনার সরকারের শেষ সময়ে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২২ বিলিয়ন ডলার। এখন তা বেড়ে প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্য ছিল ঋণাত্মক ৬৬০ কোটি ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে লেনদেনের ভারসাম্যে ১৪ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। কিন্তু আগের অর্থবছরের তুলনায় আমদানি বেড়েছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময়হার বাজারব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেয়। এ কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার মানে বড় ধরনের পতন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। কিন্তু রেমিট্যান্সের বড় ধরনের প্রবাহের কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল রয়েছে। বরং ডলারের মান ধরে রাখতে বাজার থেকে প্রচুর ডলার কিনে নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে ডলারের বিনিময়হার ১২২ দশমিক ২৭ টাকা। দেশের রপ্তানি আয় কমলেও প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের ওপর ভর করেই মুদ্রা বিনিময়হারে স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতি বিশ্লেষক এম মাসরুর রিয়াজ আমার দেশকে বলেন, গত ১৫ মাসে প্রবাসে শ্রমিক রপ্তানি খুব বেশি হয়েছে আর এ কারণে রেমিট্যান্সও বেড়েছে; বিষয়টি এমন নয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর ব্যাংক লুট ও অর্থপাচার বন্ধ হওয়ার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, টাকা পাচার কমে গেলে হুন্ডির পরিমাণও কমে যায়। এ কারণে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়ছে। আমাদের রিজার্ভ ২০-২২ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। এখন তা ৩০ বিলিয়ন ডলারের উপরে উঠে এসেছে। রিজার্ভ বাড়ার বিষয়টি আমাদের জন্য ‘জীবনরক্ষাকারী ওষুধের’ মতো কাজ করছে বলে মন্তব্য করেন এই বিশ্লেষক।
মাসরুর রিয়াজ আরো বলেন, রিজার্ভ বাড়ার কারণে আমদানির ক্ষেত্রে যে বিধিনিষেধ ছিল, সেটা তুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির যে সংকট, সেটা কিছুটা হলেও সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। গ্যাসের যে সংকট, আমদানি করে সে সংকট কিছুটা হলেও লাঘব করা সম্ভব হচ্ছে। ইমপোর্টও বাড়ছে। আর তা না হলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়হার বাড়ত এবং মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যেত। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশেরও কিছুটা বেশি হলেও তখন তা ১২-১৩ শতাংশে উঠে যেত। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে বাজার সম্প্রসারণ এবং আরো বেশি দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাসে ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও পাঁচ মাস শেষে (জুলাই-নভেম্বর) মোট প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশে। গত চার মাসে টানা কমছে রপ্তানি আয়। এর মধ্যে গত নভেম্বরে রপ্তানি আয় ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৪ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার।
এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৫ শতাংশ। এছাড়া দেশে বিনিয়োগে বড় ধরনের খরা বিরাজ করছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের অক্টোবরের হিসাব অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ, যা গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

