ঈদযাত্রার শেষ মুহূর্তেও নেই ভোগান্তি

মাহফুজ সাদি
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৫, ১১: ৪০
ছবি: সংগৃহীত

এবারের ঈদযাত্রায় শেষ মুহূর্তেও সড়ক, রেল ও নৌপথে স্বস্তি মিলছে বলে জানিয়েছেন যাত্রীরা। গতকাল শনিবার পর্যন্ত বাস, ট্রেন ও লঞ্চ যেমন যথাসময়ে ছেড়েছে, তেমনই অতিরিক্ত যাত্রীবহনও চোখে পড়েনি। অনিয়মের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে মামলা, জরিমানা করেছে। গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলোতে ঈদযাত্রায় দীর্ঘ যানজটের চিরচেনা চিত্রও দেখা যায়নি। তবে দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোথাও কোথাও যানজট দেখা গেছে।

যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাসের বাড়তি ভাড়া নিয়ে তারা সমস্যায় পড়েছেন। রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনালে নির্ধারিত হারের চেয়ে ১০০ থেকে ৪০০ টাকা বেশি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে যারা আগাম টিকিট সংগ্রহ করেননি, তারা বেশি ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

সায়েদাবাদ থেকে ননএসি বাসের টিকিট সংগ্রহ করা আশিক হোসেন জানান, সাধারণ সময়ের তুলনায় ২০০ টাকা বেশি দিয়ে ৮০০ টাকায় টিকিট কিনতে হয়েছে। মোসাদ্দেক বিল্লাহ নামে একজন জানান, কাউন্টার থেকে এক হাজার টাকা চাওয়া হলেও দরকষাকষির পর ৯০০ টাকায় টিকিট পেয়েছেন। গাবতলী থেকে এসি বাসের টিকিট নেওয়া হোসাইন আহমদ বলেন, কাউন্টারে এক হাজার ৪০০ টাকা চাওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত এক হাজার টাকায় টিকিট পেয়েছেন, যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় ৩০০ টাকা বেশি।

বাস কাউন্টারের মালিক ও কর্মীরা অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। পূর্বাশা কাউন্টারের ফারুখ হোসেন জানান, সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে, তবে এবারের নির্ধারিত ভাড়া অন্যবারের তুলনায় বেশি হওয়ায় যাত্রীরা অতিরিক্ত ভাড়া মনে করছেন। সাকুরা পরিবহনের আল-আমিন দাবি করেন, যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে না এবং সংকটও নেই। শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারকর্মী সোহেল জানান, ননএসি বাসের ভাড়া এক হাজার ৩০০ টাকা এবং এসি বাসের ভাড়া ১৪০০-১৮০০ টাকার মধ্যে রাখা হয়েছে, যা অনলাইনে আগাম বিক্রি হওয়ায় অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার সুযোগ কম।

ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা

ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, যাত্রীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রতিদিন বাস টার্মিনাল ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিআরটিএ। গতকাল সায়দাবাদ বাস টার্মিনালে বিভিন্ন পরিবহনের টিকিট কাউন্টার পরিদর্শন এবং যানবাহন পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষকে সচেতন করার পাশাপাশি যাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হয়। এ সময় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অপরাধে লাল-সবুজ, গোল্ডেন লাইন, সাকুরা ও হিমাচল পরিবহনের বিরুদ্ধে চারটি মামলা দায়ের এবং ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, গাড়ির নম্বর, জরুরি যোগাযোগের নম্বর ও ভাড়ার তালিকা প্রদর্শন বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী ও পার্শ্ববর্তী এলাকা ঘুরে কোনো যানজট পরিলক্ষিত হয়নি এবং যাত্রীরা স্বস্তি নিয়েই তাদের গন্তব্যে যেতে পারছে।

ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক-নিরাপদ করতে তৎপরতা

এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক ও নিরাপদ করতে সরকারের তৎপরতা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব এহছানুল হক। গণপরিবহনে যাত্রীদের ভোগান্তি রোধে গতকাল সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শনে গিয়ে তিনি বলেন, এবারের ঈদযাত্রায় চাঁদাবাজি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, মলম পার্টির উপদ্রব থাকবে না। মানুষ শান্তি ও নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরবে এবং একইভাবে ঢাকায় আসার সময় যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা কাজ করব।

বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিআরটিএ কর্তৃক প্রতিটি বাস টার্মিনালে বুথ স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও পুলিশ ও র‌্যাবের টিম সার্বক্ষণিকভাবে তৎপর রয়েছে। বাড়তি ভাড়া আদায়সহ যাত্রীদের সকল সমস্যার সমাধানে অভিযোগ পাওয়া মাত্রই অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ সময় বিআরটিএ চেয়ারম্যান ইয়াসীন, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বাসমালিক সমিতির নেতা, শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

বিআরটিএর কন্ট্রোল রুম

ঈদযাত্রায় যানবাহন চলাচল নিরবচ্ছিন্ন রাখতে নিয়ন্ত্রণকক্ষ (কন্ট্রোল রুম) চালু করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এ সংক্রান্ত একটি অফিস আদেশে বলা হয়েছে, শুক্রবার থেকে আগামী শনিবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা থাকবে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দায়িত্ব পাওয়াদের যানজট সৃষ্টি, বাড়তি ভাড়া আদায়, অননুমোদিত বা রুট পারমিটবিহীন অথবা গতিসীমা লঙ্ঘনকৃত যানবাহন চলাচল ইত্যাদি সংক্রান্ত সার্বিক কার্যক্রম তদারকি, সমন্বয় এবং সমাধানে উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষে যোগাযোগের জন্য টেলিফোনে ১৬১০৭ এবং মোবাইলে ০১৫৫০-০৫১৬০৬, ০১৫৫০-০৫৬৫৭৭ ও ০১৫৫২-১৪৬২২২ নাম্বারে কল করতে বলা হয়েছে।

মহাসড়কগুলোয় যানজট না থাকায় স্বস্তি

কুমিল্লা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, প্রতি বছর ঈদের সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হলেও এবার পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। হাইওয়ে পুলিশ, সেনাবাহিনী, জেলা প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকদের কঠোর অবস্থানের কারণে কুমিল্লার আলেখারচর, ক্যান্টনমেন্ট, নিমসার ও চান্দিনাসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল। নিমসার, চান্দিনা ও গৌরীপুর বাজারে যানবাহনের চাপ থাকলেও কোথাও দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়নি। এ ছাড়া কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর এবং ক্যান্টনমেন্ট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কেও যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল। যানজট ও ডাকাতি প্রতিরোধে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ২৬টি গুরুত্বপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে বিশেষ নজরদারি করা হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রিজিয়নের পুলিশ সুপার মো. খায়রুল আলম জানান, যানজট এড়াতে ২৬টি পয়েন্টে কাজ করা হয়েছে। কুমিল্লা ময়নামতি হাইওয়ে থানার ইনচার্জ ইকবাল বাহার মজুমদার জানান, নিমসার এলাকায় যান চলাচল একেবারে স্বাভাবিক দিনের মতো ছিল এবং নিরাপদ ঈদযাত্রা নিশ্চিত করতে তারা দিনরাত কাজ করছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-সিলেট ও কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কে ঈদের সময় সাধারণত তীব্র যানজটের আশঙ্কা থাকে, বিশেষ করে চলমান উন্নয়ন কাজের কারণে। তবে এবার যানবাহনের চাপ কয়েকগুণ বেড়ে গেলেও বড় ধরনের যানজট সৃষ্টি হয়নি। আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া এবং বিজয়নগরের সাতবর্গ পর্যন্ত চার ও ছয় লেনের সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ চলায় যাত্রীদের কিছুটা ভোগান্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বেহাল রাস্তার অনেকাংশ দ্রুত মেরামত করায় ভোগান্তি কমেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৭৬ কিলোমিটার মহাসড়কে প্রতিদিন প্রায় অর্ধলক্ষ যানবাহন চলাচল করে। ঈদের আগে এসব সড়কে যানজটের শঙ্কা থাকলেও এবার স্বাভাবিকভাবেই যানবাহন চলেছে। খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, যানজট নিয়ন্ত্রণে হাইওয়ে পুলিশের চারটি টিম কাজ করেছে, ফলে বড় ধরনের কোনো যানজট বা দুর্ঘটনা হয়নি। এ ছাড়া আশুগঞ্জ-আখাউড়া চারলেন প্রকল্পের ব্যবস্থাপক শামীম আহমেদ জানান, মহাসড়কের বেহাল অংশগুলো দ্রুত মেরামত করা হয়েছে এবং যানজট এড়াতে নির্মাণাধীন সড়কের একটি লেন খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে কিছু এলাকায় নিয়মিত পানি না দেওয়ায় ধুলোবালির সমস্যা তৈরি হয়েছে, যা যাত্রীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর টিমও কাজ করছে, ফলে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন হয়েছে। দেশের পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যানজট নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের তৎপরতা কার্যকর ছিল।

যমুনা ও পাদ্মা সেতুর গাড়ি পারাপারের খবর

ঈদযাত্রায় যমুনা সেতু দিয়ে একদিনে ৪৮ হাজার ৩৩৫টি যানবাহন পারাপার হয়েছে, যার মধ্যে ৯ হাজার ১৬৩টি মোটরসাইকেল। এ থেকে টোল আদায় হয়েছে তিন কোটি ৩৮ লাখ ৫২ হাজার ৯০০ টাকা। যানবাহনের চাপ থাকলেও ১৮টি টোল বুথ ও মোটরসাইকেলের জন্য পৃথক বুথ থাকায় যানজট হয়নি।

বাংলাদশ সেতু কর্তৃপক্ষ যমুনা সেতু সাইট অফিসর নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবির পাভেল বলেন, ঈদযাত্রায় যমুনা সেতুর দুই পাশে ৯টি করে মোট ১৮টি বুথ রয়েছে। এ ছাড়া দুইপাশেই মোটরসাইকেলে জন্য আলাদা দুটি করে বুথ রয়েছে। সড়কে যানবাহনের চাপ থাকলেও যানজট না থাকায় নির্বিঘ্নে যাতায়াত করছেন ঘরমুখো মানুষ।

দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার পদ্মা সেতু দিয়ে ২৪ ঘণ্টায় ৩৯ হাজার ৬৩৭টি যান পার হয়েছে, যার মধ্যে ১০ হাজারের বেশি মোটরসাইকেল। এতে চার কোটি ২৫ লাখ ৪১ হাজার টাকা টোল আদায় হয়েছে।

মুন্সীগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শ্রীনগর-সার্কেল) আনিছুর রহমান বলেন, যাত্রীদের জানমালের নিরাপত্তাসহ সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা তৎপর রয়েছেন। মহাসড়কে এখন পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ঘরমুখো মানুষ নিবিঘ্নে পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পারছেন।

এবারের ঈদযাত্রায় ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের কোনো নজির নেই; বরং ট্রেন সময়মতো ছাড়ছে এবং অনেক ট্রেন প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের অপেক্ষা করছে। আগের তুলনায় যাত্রীসংখ্যা কম থাকায় স্টেশনে অতিরিক্ত ভিড়ও দেখা যায়নি।

ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন ব্যবস্থাপক শাহাদাত হোসেন বলেন, কোনো ট্রেনই স্টেশন ছাড়তে বিলম্ব করছে না। সকালের দুই তিনটি ট্রেনে যাত্রীর চাপ অনেক বেশি ছিল, তারপর কিছুটা কমে আসে।

নৌপথে স্বস্তি

এবারের ঈদযাত্রায় নৌপথে যাত্রীরা সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় ভ্রমণ করতে পারছেন, তবে শিডিউল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। কিছু লঞ্চ নির্ধারিত সময়ের দুই-তিন ঘণ্টা পর ছেড়েছে এবং অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করেছে।

বিআইডব্লিউটিএ জানায়, ঈদের দ্বিতীয় দিনে বেলা ১১টা পর্যন্ত ৫২টি লঞ্চ সদরঘাটে এসেছে, যার মধ্যে ৩২টি ছেড়ে গেছে এবং ২০টি অপেক্ষমাণ রয়েছে। র‍্যাব-১০ অধিনায়ক কামরুজ্জামান জানান, ঈদযাত্রায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে র‍্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় রয়েছে এবং নাশকতার আশঙ্কা নেই। শিডিউল বিপর্যয়ের অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিষয়:

ঈদযাত্রা
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত