হয়নি তদন্ত, নেয়নি ব্যবস্থা

মেট্রোরেলের ২ লাখ ৪০ হাজার পাস খোয়া নিয়ে রহস্য

মাহফুজ সাদি
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৫, ০৬: ৫০
ছবি: সংগৃহীত

মেট্রোরেলের যাত্রীদের ভাড়ার পাসের সংকটের নেপথ্যে রয়েছে পতিত শেখ হাসিনা সরকারের সময় ২ লাখ ৪০ হাজার পাস খোয়া, হঠাৎ করে পাসের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া, চাহিদা অনুযায়ী সময়মতো পাস সরবরাহ না করা এবং সংশ্লিষ্ট দুই কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৃষ্ট এই সংকটের কারণে যাত্রীরা রয়েছেন চরম ভোগান্তিতে। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, পাসের সংকট অনেকটা কেটেছে, শিগগিরই স্বস্তি মিলবে।

মেট্রোরেলে ভাড়া পরিশোধের স্থায়ী ও একক পাস রয়েছে। স্থায়ী পাস হিসেবে র‍্যাপিড পাস ও এমআরটি পাস এবং একক যাত্রার জন্য আলাদা পাস ব্যবহার করা হয়। প্রতিদিন চার লাখের মতো যাত্রী এসব পাস ব্যবহার করেন। এর মধ্যে স্থায়ী পাস ব্যবহারের ৬০ শতাংশ নিয়মিত যাত্রী আর একক পাস ৪০ শতাংশ অনিয়মিত যাত্রী ব্যবহার করেন।

বিজ্ঞাপন

স্থায়ী পাসের মধ্যে র‌্যাপিড পাস দিয়ে থাকে মেট্রোরেলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঢাকা পরিবহণ সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) আর এমআরটি এবং একক পাস দেয় মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। র‍্যাপিড পাস দিয়ে ঢাকার সব পরিবহনে চলাচল করার সুবিধা থাকলেও এমআরটি পাস দিয়ে শুধু মেট্রোরেল লাইন-৬ এ যাতায়াত করা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মেট্রোরেলে পাস সংকটের মূলে রয়েছে একক পাস। মেট্রোরেল চালুর সময় ২০২২ সালে ৩ লাখ ২০ হাজার একক পাস কেনে ডিএমটিসিএল। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পাস সংগ্রহে দীর্ঘ লাইন দেখা গেলেও পাস খোয়া যাওয়ার কথা প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি পাস খোয়া যাওয়া ঠেকাতে কার্যকর তেমন কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপও দেখা যায়নি।

অন্তর্বর্তী সরকারের সময় হঠাৎ করেই বলা হলো, ২ লাখ ৪০ হাজার পাস যাত্রীরা নিয়ে গেছেন। এ কারণে পাস সংকট দেখা দিয়েছে। সংকট এতটাই প্রকট আকার ধারণ ধারণ করে যে ৩ লাখ থেকে গত বছরের নভেম্বরে একক পাসের সংখ্যা নেমে আসে ৬০ হাজারে। একক পাস প্রতিদিন ব্যবহার করেন দুই লাখের মতো যাত্রী।

এসব যাত্রী পাস না পাওয়ায় চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তবে দ্বিতীয় ধাপে সম্প্রতি ১ লাখ ২০ হাজার একক পাস কেনেছে ডিএমটিসিএল, যা যুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। এগুলো সক্রিয় হলেও একক পাসের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ লাখ ৮০ হাজারে।

এতসংখ্যক পাস কীভাবে হারাল, সে বিষয়ে কোনো তদন্ত করেনি ডিএমটিসিএল। এমনকি পাস হারানো রোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তারও স্পষ্ট জবাব মেলেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাত্রীরা পাস ফেরত না দিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিলে এবং ধীরে ধীরে কমলেও তা পুনরায় পূরণ করা হলে সংকট এত প্রকট হতো না। একক পাসের সংকটের কারণে হঠাৎ করে স্থায়ী পাসের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।

একক না পেয়ে স্থায়ী পাস ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭০ শতাংশে পৌঁছেছে। তারাও প্রয়োজন পড়লে পাস ব্যবহার করছেন, না হলে করছেন না। এতে সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে।

শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন ডিএমটিসিএল তার ২ লাখ ৪০ হাজার পাস খোয়া যাওয়া নিয়ে তদন্ত করেছে কিনা, জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের লাইন-৬-এর প্রকল্প পরিচালক মো. জাকারিয়া আমার দেশকে বলেন, না, না। প্রথমদিকে অনেকে দুটা পাস কিনে একটা নিয়ে গেছে। অনেকে পরিবারের সবার জন্য পাস নিয়েছে, কিন্তু সব জমা দেয়নি।

শুধু আমাদের জন্য নয়, বিশ্বের সব দেশেই মেট্রোরেলে পাস বা টোকেন খোয়া যাওয়া সবারই মাথা ব্যথার কারণ। খোয়া যাওয়ার সময় প্রতি সপ্তাহে সভায়, পাস খোয়া যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে।

কম পাস কিনে বেশি দেখানো হয়েছে কিনা বা মানগত কারণে অনেক পাস নষ্ট হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অল্প পাস কিনে বেশি দেখানোর কোনো সুযোগ নেই, কাস্টমস থেকে শুরু করে অনেক হাত হয়ে আমাদের কাছে পাস আসে।

এই পাসগুলো নষ্টও হয়নি, হলে আমাদের কাছে থাকত অথবা সরবরাহকারীর রিপ্লেস করে দেওয়ার কথা। সেই লটের পাস এখনো কিছু আছে, সেটা চেক করে দেখতে পারেন আপনারা। পাসের বিষয়টি ডিএমটিসিএল (অপারেশন) দেখে, ওনারা ভালো বলতে পারবেন।

এ বিষয়ে ডিএমটিসিএলের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইন্টেন্যান্স) নাসির উদ্দিন আহমেদ আমার দেশকে বলেন, আমাদের পাবলিক রিলেশন অফিসারের সঙ্গে কথা বলেন। কতসংখ্যক পাস ওই সময় অপারেশনে যুক্ত হয়েছে, কতসংখ্যক পাস নষ্ট হয়েছে, কেনার সংখ্যার থেকে কমসংখ্যক পাস যুক্ত করা হয়েছে কিনা— জানতে চাইলে আবারও পিআরের সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি।

সূত্র মতে, স্থায়ী পাসের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কয়েক ধাপে ৬ লাখ ৩৬ হাজার ৫০০ র‌্যাপিড পাস দিয়েছে ডিটিসিএ। ডিএমটিসিএল ৭ লাখ ৩০ হাজার এমআরটি পাস কেনে। ফলে দুই ধরনের মিলিয়ে স্থায়ী পাস থাকার কথা ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ৫০০ পাস।

তবে পাস সংকট ও অস্বাভাবিক চাহিদা দেখা দেওয়ার পর নতুন করে আরো আড়াই লাখ র‌্যাপিড পাস কেনার উদ্যোগ নেয় ডিটিসিএ। যার মধ্যে ৯০ হাজার এরই মধ্যে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, বাকিগুলো নির্ধারিত সময়ে মিলছে না।

পাস সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের লাইন-৬-এর প্রকল্প পরিচালক মো. জাকারিয়া বলেন, প্রথম পর্যায়ে প্রকল্পের আওতায় আমরা ৭ লাখের বেশি পাস কিনেছিলাম। তারপর আর পাস কেনার জন্য ডিটিসিএ’র অনুমতি পাইনি। এজন্য ট্রান্সপোর্ট কী দরকার হয়, সেটা তারা দেয়নি। আমরাও আর পাস কিনতে পারিনি।

পাস কেনার জন্য ওই সময় আগের এমডি, সচিব— সবাই অফিসিয়ালি ট্রান্সপোর্ট কী হস্তান্তর করতে বলেছে ডিটিসিএকে। এখন তারাও চাচ্ছে না, পাসের কাজটা অন্য কেউ করুক।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিটিসিএর সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, মেট্রোরেলে একক পাসের সংকট, এটি তো ডিএমটিসিএল কিনে। একক যাত্রার পাসের তীব্র সংকট তো হঠাৎ হওয়ার কথা নয়। হারালেও তো একবারে লাখ লাখ পাস নাই হয়ে যায়নি।

ডিটিসিএর পাস পাওয়ার কথা জানিয়ে মো. জাকারিয়া বলেন, এখন বলা যায়, আর কোনো সংকট নেই। পাস সরবরাহকারীদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে তারা পাস দিতে পারেনি। এর আগে ১৫ দিনে আপৎকালীন সময়ের জন্য ১৫ হাজার পাস নেওয়া হয়।

ডিটিসিএ’র নির্বাহী পরিচালক ও ডিএমটিসিএল বোর্ডের পরিচালক নীলিমা আখতার আমার দেশকে বলেন, পাস সংকটের একটা কারণ হলো, চাহিদা বেড়েছে কিন্তু সরবরাহ ঠিকভাবে পাওয়া যায়নি।

এই চাহিদা পূরণে নতুন করে ৯০ হাজার পাস ইতোমধ্যে আমরা গ্রহণ করেছি, বাকিটা তারা পরে দেবে। এখন পাসের যে সরবরাহ রয়েছে, তাতে আর সংকট নেই। এই পাস যেন কেউ স্টক করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

২০১৯ সালে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অপারেটর (পিটিও) চুক্তির আওতায় মেট্রোরেলে র‍্যাপিড পাসটি চালুর সিদ্ধান্ত হয়।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জাইকার অর্থায়নে একটি প্রকল্পের আওতায় ডিএমটিসিএল স্থায়ী পাস হিসেবে র‍্যাপিড পাস সংগ্রহ করে ভাড়া আদায় ও সেটেলমেন্টকারী‌ প্রতিষ্ঠান ডিটিসিএ’র কাছে হস্তান্তর করবে। ডিটিসিএ তা বাজারজাত করবে।

অভিযোগ রয়েছে— সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিটিসিএ র‍্যাপিড পাস তৈরির গোপনীয় কোড হস্তান্তর করলে ডিএমটিসিএলের তৎকালীন প্রভাবশালী এমডি এম এ এন সিদ্দিক ওই সময়ের সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের যোগসাজশে গোপনে অনুমোদন নিয়ে এমআরটি পাস করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পিটিও চুক্তি অনুযায়ী মেট্রো স্টেশনের অভ্যন্তরে টিকিট অফিস মেশিন (টিওএম) ও টিকিট ভ্যান্ডিং মেশিন (টিভিএম) থেকে র‍্যাপিড পাসটি বিক্রি করার কথা থাকলেও তৎকালীন ডিএমটিসিএল’র এমডি এম এ এন সিদ্দিকের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তে স্টেশনে পাসটি বিক্রি করতে দেওয়া হয়নি।

এমনকি স্টেশনের বাইরে গণপরিবহনের সমন্বিত ডিটিসিএ’র ক্লিয়ারিং হাউজের ব্যাংক হিসেবে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের অস্থায়ী বিভিন্ন বুথ থেকে পাসটি সরবরাহ করা শুরু করে ডিটিসিএ, তাতেও বাধা দেয় সিদ্দিক।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রায় আট বছর ডিএমটিসিএলের এমডির পদে আসীন ছিলেন এম এ এন সিদ্দিক। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তার নিয়োগ বাতিল করলে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে এমডির দায়িত্ব পান অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রউফ। গত ফেব্রুয়ারিতে ডিএমটিসিএলের নতুন এমডির দায়িত্ব দেওয়া হয় বৈশ্বিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রকৌশলী ফারুক আহমেদকে। তবে এখনো এম এ এন সিদ্দিকের সেটাপ ডিএমটিসিএলে রয়ে গেছে।

কয়েকদিন সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একক পাস কিনতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েও না পেয়ে অনেকে র‍্যাপিড বা এমআরটি পাস কিনছেন। প্রতিদিন মেট্রো স্টেশনগুলোতে এভাবেই ভিড় করছেন যাত্রীরা, চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তাদের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন অনেকে।

এতে সময় নষ্ট হচ্ছে। আবার অনেককে খালি হাতেও ফিরতে হচ্ছে। এমন চিত্র মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশনের প্রতিটির, প্রতিদিনের। একদিন-দুইদিন নয়, মাসের পর মাসের। ফলে যানজটের ঢাকার আধুনিক নগর পরিবহনের ক্ষেত্রে স্বস্তি নিয়ে আসা মেট্রোরেলের সেবা নিয়ে অনেক যাত্রীকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে।

সবশেষ সোমবার ডিটিসিএর সূত্র জানায়, তাদের কার্ড বিক্রয় ও রিচার্জ এজেন্টদের মেট্রো স্টেশনে বসতে দেওয়া হচ্ছে না। স্টেশন কন্ট্রোলার তাদের লিখিত ডকুমেন্টস নিয়ে বসতে বলছেন এবং তাতে লেখা থাকতে হবে স্টেশনের ভেতরে স্থায়ী কার্ড (এমআরটি এবং র‌্যাপিড পাস) রিচার্জ করার অনুমতি দেওয়া হলো। তাহলে বসতে দেওয়া হবে বলে এজেন্টদের স্টেশন থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিটিসিএর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যাত্রী সেবা সহজ ও দ্রুত করতে ডিএমটিসিএলের সম্মতি নিয়ে ডিটিসিএ তাদের স্টেশনে বসিয়েছে। ডিএমটিসিএলের বুথে দীর্ঘ লাইন পড়ে থাকলেও ডিটিসিএর এজেন্টদের বের করে দেওয়ার কারণ জানা নেই। এর ফলে যাত্রীসেবার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ডিএমটিসিএল ট্রান্সপোর্ট কী না পেয়ে ডিটিসিএর নিয়োগকৃত এজেন্টদের স্টেশন থেকে বের করে দিচ্ছে কিনা, সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত