তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি নাকচ সরকারের, শিক্ষার্থীদের শাটডাউন কর্মসূচি

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০: ৫৭
আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০: ০২

রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি নাকচ করে দিয়েছে সরকার। এই কলেজকে বিশেষ কোনও সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সাত কলেজ নিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে রোববার তিনি আরও বলেন, সময় বেঁধে দেয়া দাবির মুখে সরকার আর কোনও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবে না।

তবে শিক্ষা উপদেষ্টার এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে রোববার সন্ধ্যায় তাৎক্ষণিকভাবে মহাখালীর আমতলী মোড়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। প্রায় দেড় ঘণ্টা ব্যস্ততম ওই সড়কে অবস্থান করে শিক্ষার্থীরা। এতে করে মহাখালী থেকে এয়ারপোর্টগামী এবং এয়ারপোর্ট থেকে মহাখালীমুখী সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

এ পরিস্থিতিতে অনাকাঙ্ক্ষিত যেকোনো ঘটনা এড়াতে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পুলিশের জলকামানও দেখা যায় বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।

এক পর্যায়ে মহাখালীর আমতলী এলাকায় ছেড়ে শিক্ষার্থীরা আবারও তিতুমীর কলেজের সামনের সড়কে অবস্থান নেয়। রাত পৌনে ১০টায় তারা কলেজের সামনের সড়কের উভয় পাশে বাঁশ ফেলে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়।

অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষার্থীদের শাটডাউন কর্মসূচি

রোববার রাত ১১টার পর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অনির্দিষ্টকালের জন্য শাটডাউন ঘোষণা করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। একইসঙ্গে সোমবার সকাল ১১ থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বারাসাত ব্যারিকেড টু ঢাকা নর্থ সিটি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতাভুক্ত থাকবে মহাখালী, আমতলী, রেলগেট এবং গুলশান লিংকরোড। এ কর্মসূচি আর শিথিল হবে না।

ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি না মানা পর্যন্ত সোমবার থেকে কলেজের কোন ক্লাস-পরীক্ষা ও একাডেমিক কার্যক্রম চলবে না। দাবি মানলেই তিতুমীরের গেটের তালা খোলা হবে। সোমবার বিকালের মধ্যে আলোচনায় বসতে সরকারের আহ্বান জানান তারা।

এসময় তিতুমীর কলেজ নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টার দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহারেরও দাবি জানান তারা।

কয়েকদিন ধরে চলা শিক্ষার্থীদের এসব কর্মসূচিতে চরম জনভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। এতে সংশ্লিষ্ট মহলে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। জনদুর্ভোগের বিষয়টি মাথায় রাখতে তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীদের অনুরোধ জানিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, তিতুমীর কলেজের অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসে ফিরে যেতে চায়। তারা জনদুর্ভোগ চায় না। সাত কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একে অপরকে চায় না। তাই সাত কলেজকে নিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য একটি কমিটি কাজ করছে। তবে দাবি বাস্তবায়নে সময় বেঁধে দেওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়।

এর আগে দিনের বেলায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানিয়েছিলেন, দ্রুত তাদের দাবি মেনে নিতে হবে। নইলে সোমবার সকাল থেকে পূর্বঘোষিত 'ব্যারিকেড টু নর্থ সিটি' কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করা হবে।

এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অন্যতম মুখপাত্র আলী আহমেদ আমার দেশকে জানিয়েছিলেন, ইজতেমার কারণে রোববার শুধুমাত্র তিতুমীর কলেজের সামনের সড়ক অবরোধ কর্মসূচি থাকছে।

যদিও শনিবার 'ব্যারিকেড টু নর্থ সিটি' কর্মসূচি ঘোষণা করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেছিলেন রোববার বিকেল ৪টার মধ্যে দাবি মানা না হলে রেল ও সড়ক পথ অবরোধ করা হবে।

এদিকে টানা ৫ দিনের অবরোধের কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন বৃদ্ধ, নারী, শিশু, শিক্ষার্থী, চাকরিজীবিসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীর রাস্তা অবরোধের মাধ্যমে দাবি আদায়ের মামার বাড়ির আবদারের সঙ্গে তুলনা করেছেন কেউ কেউ। কেউবা বল প্রয়োগের পক্ষে মত দেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, কলেজের সামনের মহাখালী থেকে গুলশানমুখী সড়কের উভয় পাশে বাঁশ ফেলে সড়কের মাঝখানে অবস্থান নিয়েছেন শ'খানেক শিক্ষার্থী। এ কারণে মহাখালী-গুলশান সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তিতুমীর কলেজের সামনের সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা হ্যান্ড মাইকে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন। এনিয়ে টানা ৫ম দিনের মতো মহাখালী-গুলশান সড়ক অবরোধ করলো শিক্ষার্থীরা।

বনানী থানার ওসি রাসেল সারোয়ার জানান, দুপুর ১২টার দিকে তিতুমীর কলেজের সামনের সড়কের দুইপাশ অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। এই সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিশৃঙ্খলা এড়াতে সতর্ক রয়েছে পুলিশ।

আন্দোলনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে সৌরভ নামের এক শিক্ষার্থী আমার দেশকে জানান, রোববার সন্ধ্যা থেকে তারা মহাখালী-আমতলী মহাসড়কে অবস্থান নিয়েছেন। এদিন আর গুলশানে তারা যাবেন না। মধ্যরাত পর্যন্ত অবস্থান চালানোর প্রস্তুতি রয়েছে। এছাড়া সোমবার থেকে কর্মসূচি আরও কঠোর হবে।

বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের দুর্ভোগ

রাস্তা বন্ধ থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে জনসাধারণকে। পায়ে হেঁটেই গন্তব্যে যেতে দেখা যায় সকলকে। অসুস্থ মানুষ, শিশু ও নারীদের কষ্ট পোহাতে হয়েছে বেশি। সরকারি, বেসরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী, ঢাকামুখী এবং ঢাকা থেকে দূর পাল্লার গন্তব্যে যাওয়া মানুষ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

অসুস্থ পিতাকে দেখতে দুই শিশুসন্তান, ব্যাগেজ ও স্ত্রীকে নিয়ে ময়মনসিংহের গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন সরকারি চাকরিজীবী আলতাফ হোসেন। মহাখালী আমতলী নেমে দেখেন গুলশান ১ নম্বর সার্কেলের দিকে যাওয়ার রাস্তায় কোন গণপরিবহন চলছে না। নেই কোন সিএনজিও। প্রায় ৪০ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটা শুরু করেন। এর মধ্যে তিতুমির কলেজের সামনে এসে দেখেন রাস্তায় বাঁশ ফেলে সড়কে অবস্থান করছেন শিক্ষার্থীরা। কষ্ট করে শিক্ষার্থীদের জটলা পেরিয়ে হোটেল জাকারিয়ার সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন।

এর মধ্যে দূরপাল্লার জার্নির কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়েন দুই শিশু সন্তান। সেখানে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করে বর্ধিত দামে সিএনজি ভাড়া করেন বাড্ডা যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সিএনজিতে উঠার সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ’আমিও এই তিতুমির কলেজে পড়েছি। কিন্তু একেবারে অযৌক্তিক দাবিতে এভাবে মানুষকে দিনের পর দিন কষ্ট দেয়া কোন শিক্ষার্থীর কাজ হতে পারে না। যত্তসব অথর্ব।’

গুলশানের দিক থেকে মহাখালীর দিকে আসা ৪ জন (১ জন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ নারী ও তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নাতনি, ১ জন চাকরিজীবী, ১ জন শিক্ষার্থী) ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, দ্রুত সমস্যা সমাধান করতে হবে। এভাবে দিনের পর দিন চলতে পারে না। বৃদ্ধা নারী বিরক্তি প্রকাশ করেন।

বেলা ২টা ৩০ মিনিট থেকে বেলা ৩টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত অবস্থান করে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার ২০ জন মানুষের সঙ্গে কথা হয়। সবাই বিরক্তি প্রকাশ করেন। কেউ কেউ দ্রুত সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান। কেউবা বল প্রয়োগের পক্ষে মত দেন। ৩ জন বলেন, তিতুমির কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করতে হলে আগে ঢাকা কলেজ, মিরপুর বাংলা কলেজ ও ইডেন কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করতে হবে। কোন যুক্তিতে তিতুমির বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে বুঝে আসছে না তিতুমীর কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী বাপ্পীর। হোটেল জাকারিয়া থেকে পূর্বদিকে গুলশানের দিকে ৩০০ গজ সামনে ডান দিকে বাসা, স্থানীয় বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ’বৃদ্ধ মাকে আগারগাঁও নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে আধা কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বাসায় যাওয়া সম্ভব, ভাই?’ এভাবে আর কত- অসহায় জিজ্ঞাসা স্থানীয় এই বাসিন্দার। কয়েকজন বলেছেন, যার যখন খুশি রাস্তায় বসে পড়ছে। ’এ যেন মামার বাড়ির আবদার।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত