ভূমিকম্পজনিত আতঙ্ক, ক্যাম্পাস বন্ধ, লম্বা ছুটি ও অবকাঠামোগত ঝুঁকিতে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আগামী ২২ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণ হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন পেছানোর আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে ভূমিকম্প পরবর্তী অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণে জকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ২০২৫–এর প্রার্থীদের ডোপটেস্ট কার্যক্রম স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন।
বুধবার (২৬ নভেম্বর) প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোস্তফা হাসানের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নির্বাচ তফসিলের ক্রম–১১ অনুযায়ী আগামী ২৭ ও ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় ডোপটেস্ট কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। নতুন সময়সূচি পরে জানানো হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি রাজধানীসহ আশপাশ এলাকায় একাধিক ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আবাসন সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস-সংলগ্ন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বসবাস করায় ফাটল দেখা দেওয়ার খবরে উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। এ প্রেক্ষাপটে গত ২৩ নভেম্বর একদিনের জন্য ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত সব ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় ৩০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনলাইন ক্লাসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে একমাত্র ছাত্রী হলে ফাটল দেখা দেওয়ার আশঙ্কায় ২৪ নভেম্বর সকাল ১০টার মধ্যে ছাত্রীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয় প্রশাসন।
হঠাৎ দীর্ঘ ছুটি ও শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস ত্যাগ আসন্ন জকসু নির্বাচনের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয় স্বাভাবিক কার্যক্রমে না ফিরলে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হবে। ফলে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন প্যানেল ও প্রার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী চন্দন কুমার দাস বলেন, “এই ছুটি নির্বাচনের ওপর বড় প্রভাব ফেলবে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ১৬ হাজার শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানোর একমাত্র সুযোগ ক্যাম্পাস। তাই নির্বাচন পেছানো যুক্তিযুক্ত হলেও ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হওয়া উচিত।”
অন্যদিকে স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী রাকিব হাসান বলেন, “আমরা ২২ তারিখেই নির্বাচন চাই। সামনে জাতীয় নির্বাচন, এর আগে জকসু নির্বাচন পেছালে আর নির্বাচন হবে না—এই আশঙ্কা থেকেই নির্ধারিত তারিখেই ভোট চাই।”
ছাত্রদল ও ছাত্র অধিকার সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নির্ভীক জবিয়ান’ প্যানেলের জিএস পদপ্রার্থী খাদিজাতুল কুবরা বলেন, আমাদের কাছে সবার আগে জবিয়ানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। নির্বাচন আগানো বা পেছানো নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে আমরা সাদরে গ্রহণ করবো।
ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘অদম্য জবিয়ান ঐক্য’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী আব্দুল আলিম আরিফ বলেন, "জকসু কোনো গোষ্ঠীর খেয়াল-খুশির বিষয় নয়, এটা জবিয়ানদের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন। এই নির্বাচনের সঙ্গে আমাদের আত্মমর্যাদা জড়িত। নির্বাচন পেছানোর অপচেষ্টা মানে শিক্ষার্থীদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া। শহীদ সাজিদের আত্মত্যাগের সঙ্গে বেইমানি করা। ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ, কোনো অপশক্তির কাছে মাথা নত করবে না, ইনশাআল্লাহ।"
ছাত্রশক্তি সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ জবিয়ান’ প্যানেলের এজিএস প্রার্থী শাহিন মিয়া বলেন, এই লম্বা ছুটি অবশ্যই নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। কারণ আমাদের হল নেই, ক্যাম্পাসই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এনগেজমেন্টের একমাত্র সুযোগ। তবে ভূমিকম্পের আতঙ্কে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় যদি নির্বাচন এক সপ্তাহ পেছানো হয়, তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তবে এর বেশি পেছালে সমস্যা। ডিসেম্বর মাসেই নির্বাচন সম্পন্ন হোক এটাই প্রত্যাশা।
বামজোটসহ ৯টি সংগঠনের সমন্বয়ে ‘মওলানা ভাসানী বিগ্রেড’ প্যানেলের জিএস পদপ্রার্থী ইভান তাহসীব বলেন, অবশ্যই ভূমিকম্পজনিত এই ১৪ দিনের ছুটি জকসু নির্বাচনের ওপর অনেকখানিই প্রভাব ফেলবে। শিক্ষার্থীরা ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়েই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময়ে এই দুর্যোগের ঘটনা সেই প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত ঘটাবে।
তিনি আরও বলেন, এদিকে প্রশাসন এমন লম্বা ছুটির পেছনে যথেষ্ট কারণ দর্শাতেও ব্যর্থ হয়েছে। আমরা দাবি করেছিলাম ক্যাম্পাসের সব ভবনের ফিজিবিলিটি টেস্ট ও প্রয়োজনীয় উদ্ধার কার্যক্রমের প্রস্তুতি নিতে যে সময় লাগবে সেটা নিয়ে আবার একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করতে। তবে প্রশাসন তেমন কোনো বক্তব্য স্পষ্ট করেনি।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোস্তফা হাসান বলেন, নির্বাচন পেছানোর এখনও অফিশিয়াল কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আমাদের যে তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে, সেটা ছাড়া বিকল্প তারিখ নেই। তবে চলমান ছুটি নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করবে। তবে অভিযোগ জানানো, আপিল করাসহ অন্য কাজ চলমান আছে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় খোলা না থাকলে নির্বাচনি কার্যক্রম চালানো কঠিন। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় খোলা না থাকলে তো নির্বাচনই হবে না। নির্বাচন পেছালেও খুব বেশি পেছানোর পক্ষে আমি না।
এর আগে গত ৫ নভেম্বর ঘোষিত নির্বাচাস তফসিল অনুযায়ী, ২৩ নভেম্বর প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়। ২৪, ২৫ ও ২৬ নভেম্বর প্রার্থীদের আপত্তি গ্রহণ ও নিষ্পত্তির সময় নির্ধারিত ছিল। একই তফসিল অনুযায়ী ২৭ ও ৩০ নভেম্বর ডোপটেস্ট আয়োজনের সিদ্ধান্ত ছিল। তফসিল অনুযায়ী আগামী ৩ ডিসেম্বর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন। এরপর ৪, ৭ ও ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সুযোগ থাকবে। প্রত্যাহারকৃত প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে ৯ ডিসেম্বর। এ ছাড়া ৯ থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে নির্বাচনী প্রচারণা। আগামী ২২ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। তফসিল অনুযায়ী ভোটগ্রহণের দিনই ভোট গণনা শেষ করে ২২ থেকে ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করার কথা রয়েছে।

