নজিরবিহীন ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল রাজধানী ঢাকা। গতকাল শুক্রবার সকালের এ ভূমিকম্পে মহানগরীতে প্রাণ হারিয়েছেন চারজন। পাশাপাশি আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক মানুষ। ফাটল ধরেছে বহু ভবনে। এ সময় আতঙ্কিত হাজারো মানুষ নেমে আসেন সড়কে। ছুটির দিনের সকালে তাদের চোখেমুখে ছিল আতঙ্ক। কেননা হঠাৎ ঘটে যাওয়া এ বিপর্যয় ছিল তাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন। এভাবে ভয়ংকর একটি দিনের সাক্ষী হলো রাজধানীবাসী।
ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের মতে, শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটের দিকে ভূমিকম্প হয়েছে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির তীব্রতা ছিল ৫ দশমিক ৭। উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর মাধবদী এলাকায়। তারা ভূমিকম্পটিকে মাঝারি মাত্রার বলছে।
ভূমিকম্পের ফলে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা যায় পুরান ঢাকার বংশাল থানাধীন কসাইটুলী এলাকায়। এ সময় একটি পুরোনো পাঁচতলা ভবনের জরাজীর্ণ ব্যালকনির রেলিং ও কার্নিশের বড় অংশ ভেঙে নিচে থাকা পথচারীদের ওপর আছড়ে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনজন মারা যান। নিহতরা হলেন—স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাফিউল ইসলাম (২০), পথচারী আবদুর রহিম (৪৮) ও তার ছেলে মেহরাব হোসেন রিমন (১২)।
এছাড়া মুগদার মদিনাবাগে একটি নির্মাণাধীন ভবনের রেলিং ভেঙে পড়ে মারা যান একজন নিরাপত্তাকর্মী। তার নাম মাকসুদ (৫০)। তিনি ঘটনাস্থলেই গুরুতর আঘাত পান এবং পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়।
মহানগরীজুড়ে আতঙ্ক
ভূমিকম্পের সময় রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ ভবন থেকে দৌড়ে নিচে নামার চেষ্টা করেন। এ সময় সবচেয়ে বেশি মানুষ আহত হন।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, পুরান ঢাকা, মিরপুর, কাকরাইল, গাবতলী, বাড্ডা, রামপুরা এবং মুগদা এলাকায় বহু মানুষ সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। কোথাও মানুষ লাফিয়ে নামতে গিয়ে কোমর ও পায়ে গুরুতর আঘাত পান। কোথাও আবার মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে হাড় ভাঙার ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলেও আতঙ্কে ভবন থেকে লাফ দিয়ে ও সিঁড়িতে পড়ে অন্তত কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন।
বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন
দেড় শতাধিক মানুষ
গতকাল দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত ঢাকার শ্যামলীতে অবস্থিত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে আহতদের লম্বা সারি দেখা যায়।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগ জানায়, বিকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ভূমিকম্প-সংক্রান্ত দুর্ঘটনায় আহত ৯০ জন মানুষ এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৮ জন ভর্তি রাখতে হয়েছে। কারণ তাদের আঘাত গুরুতর।
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম জানান, দুপুর থেকেই রোগীর চাপ দ্রুত বাড়তে থাকে। অতিরিক্ত চিকিৎসক ও নার্স ডেকে বিভাগগুলো সচল রাখতে হয়েছে। বেশিরভাগ রোগীই হাত-পায়ে ফ্র্যাকচার, কোমর বা কাঁধের জোড়া সরে যাওয়ার মতো জটিল অস্থিসংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ভূমিকম্পের পর বিভিন্ন স্থান থেকে আহত হয়ে হাসপাতালে ৪১ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। মিটফোর্ড হাসপাতালেও অন্তত ১০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন।
ভবনে ফাটল ও ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতা
ভূমিকম্পের পরপরই রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ভবন ধস ও ফাটলের খবর আসতে থাকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কন্ট্রোল রুমে। আরমানীটোলার কসাইটুলীতে প্রথমে আটতলা ভবন ধসেপড়ার গুজব ছড়িয়ে পড়লেও ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে নিশ্চিত করে যে, ভবনটি ধসে পড়েনি, বরং পলেস্তারা ও ইট খসে পড়েছে। সূত্রাপুরের স্বামীবাগ এলাকায় একটি আটতলা ভবন পাশে হেলে পড়ার খবরে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। কলাবাগানের আবেদখালী রোডেও একটি ভবন হেলে পড়ার গুজবে আতঙ্ক ছড়ায়, তবে ফায়ার সার্ভিস গিয়ে ভবনটি ঝুঁকিমুক্ত বলে জানায়।
নিউ মার্কেট থানা ভবনের ৩, ৪ ও ৫ তলায় ফাটল দেখা দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল, শহীদুল্লাহ হলসহ বেশ কয়েকটি হলের পলেস্তারা খসে পড়েছে। খিলগাঁওয়ে নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইট পড়ে একজন আহত হন। বারিধারার একটি বাসায় আগুনের খবর পাওয়া গেলেও তা ভূমিকম্পের কারণে কি নাÑতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও পরে তা সঠিক নয় বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মস্থলে আতঙ্ক
কম্পন অনুভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের তিনতলা ও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের চারতলা থেকে নিচে লাফ দিয়ে অন্তত চারজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে এবং হুড়োহুড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হন। আহত শিক্ষার্থীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর কালাচাঁদপুরের একজন মধ্যবয়সি ব্যক্তি জানান, সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে গিয়ে পড়ে যাই, কোমরটা মোচড় খেয়ে মারাত্মক ব্যথা পেয়েছি।

