কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

জুলাই বিপ্লবের রক্তাক্ত দিনগুলো

আব্দুল্লাহ আল মামুন, কুবি
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৫, ০৭: ০২

ফিরে এসেছে জুলাই, মনে করিয়ে দিচ্ছে গত বছরের রক্তাক্ত দিনগুলো। তখন অন্যান্য উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে উত্তাল করে রাখেন পুরো জেলা। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে তাদের ধারাবাহিক আন্দোলন শুধু কুমিল্লা নয়, সারা দেশের নজর কাড়ে। একপর্যায়ে তাদের সংগ্রাম স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে পরিণত হয়।

গত বছরের ৪ জুলাই শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে নেমে আসে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। টানা তিন ঘণ্টা তারা অবরোধ করে রাখেন সড়কটি। এতে মহাসড়কজুড়ে তীব্র যানজট তৈরি হয়। সেদিন জেলা প্রশাসকের কাছে চার দফা দাবিও জানান তারা।

বিজ্ঞাপন

৬ জুলাই : মশাল মিছিলের আহ্বান

দাবি আদায়ে এদিন দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত দ্বিতীয়বারের মতো কোটবাড়ী বিশ্বরোড (ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক) অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। আবার রাতে তারা মশাল মিছিল শুরু করেন এবং কোটা সংস্কারের দাবি আদায় না হলে মহাসড়ক এবং রেললাইন অবরোধের হুঁশিয়ারি দেন।

৭ জুলাই : আবারও মহাসড়ক অবরোধ

৭ জুলাই রোববার বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে রাত পৌনে ৮টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা আবারও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন। কয়েক ঘণ্টার এ অবরোধের ফলে প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়।

৮ জুলাই : বাংলা ব্লকেড, ৪র্থ দিনের অবরোধ

৮ জুলাই সোমবার আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে। বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে শিক্ষার্থীরা আবার মহাসড়ক অবরোধ করেন। অবরোধের সময় ক্রিকেট-ফুটবলে মেতে উঠে আন্দোলনটি এক ধরনের উৎসবে রূপ দেয়।

১০ জুলাই : ৫ম বারের মতো অবরোধ

১০ জুলাই বুধবার সকাল থেকেই তারা ফের মাঠে নামেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবস্থান নেয়। দিনব্যাপী এ অবরোধে রাস্তার দুই পাশে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়।

১১ জুলাই : সংঘর্ষ ও রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচনা

১১ জুলাই বৃহস্পতিবার আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। দুপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উদ্দেশে রওনা দিলে আনসার ক্যাম্পসংলগ্ন রাস্তায় (বর্তমান ছাত্র আন্দোলন চত্বর) পুলিশ শিক্ষার্থীদের বাধা দেয়। এতে প্রথমে ধস্তাধস্তি, তারপর লাঠিচার্জ এবং শটগান ও টিয়ার শেল নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে এটি সংঘর্ষে রূপ নেয়। পুলিশের হামলায় ২০ জনের বেশি শিক্ষার্থী আহত হন।

সন্ধ্যার দিকে আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে ওঠে। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রশাসনকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেন।

১২ জুলাই : ছাত্র আন্দোলন চত্বরের ঘোষণা

১২ জুলাই শুক্রবার বিকালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আনসার ক্যাম্পের সামনে পুলিশের হামলার স্থানকে ‘ছাত্র আন্দোলন চত্বর’ নামে ঘোষণা করেন।

এদিনই শিক্ষার্থীরা ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে প্রক্টরের অপসারণ এবং হামলায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানান।

১৪ জুলাই : গণপদযাত্রা ও স্লোগানে উত্তাল কুবি ক্যাম্পাস

কোটা-বৈষম্য নিরসন এবং পুলিশি হামলার বিচার দাবিতে কুবির শিক্ষার্থীরা ১৪ জুলাই একটি গণপদযাত্রার আয়োজন করেন। তাদের সঙ্গে কুমিল্লার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও একাত্মতা প্রকাশ করেন।

এদিন সন্ধ্যায় শেখ হাসিনা চীন সফর থেকে ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য—‘মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না, তো কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে’—শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। মধ্যরাতে ‘রাজাকার, রাজাকার’ ধ্বনিতে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত হয়।

১৫ জুলাই : ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’

শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে কুবির শিক্ষার্থীরা বিকালে আবারও বিক্ষোভ মিছিল করেন। ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ এবং ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা দেশটা কারো বাবার না’—এমন প্রতিবাদী স্লোগান দিতে থাকেন।

১৬ জুলাই : বিক্ষোভ, পুলিশের গুলি এবং উত্তাল মহাসড়ক

কোটা আন্দোলনকারীদের দমনে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে তালা লাগিয়ে দিলে শিক্ষার্থীরা সেই তালা ভেঙে বেরিয়ে মিছিল করেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধের সময় পুলিশ রাবার বুলেট নিক্ষেপ করলে দুইজন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন।

এদিন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কুবির আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।

১৭ জুলাই : প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আলটিমেটাম

সরকারের নির্দেশে কুবি প্রশাসন অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা এবং শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল করেন এবং চার দফা দাবিতে প্রশাসনকে আলটিমেটাম দেন।

১৮ জুলাই : কুমিল্লায় শিক্ষার্থী ও পুলিশের সংঘর্ষ

১৮ জুলাই কোটা আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। কুবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মিলে বিক্ষোভ মিছিল করেন। প্রধান ফটক থেকে শুরু হয়ে মিছিলটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পৌঁছলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

দুপুরের দিকে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। সরেজমিন দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে।

ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বাধা এবং শহরজুড়ে উত্তেজনা

১৮ জুলাই শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আন্দোলনকারীরা কোটবাড়ী অভিমুখে মিছিলে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সদস্যরা তাদের বাধা দেয় বলে অভিযোগ ওঠে।

ইন্টারনেট বন্ধ : আন্দোলন দমনের আরেকটি পদক্ষেপ

১৭ জুলাই রাত থেকে প্রথমে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই রাত ৯টা থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই নিষেধাজ্ঞা পাঁচদিন ধরে চলতে থাকে। মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ছিল ১০ দিন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার বন্ধ ছিল ১৩ দিন।

১৯ জুলাই : বিক্ষোভ মিছিল

শিক্ষার্থীদের হল ছেড়ে দিতে বাধ্য করায় এদিন ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীশূন্য হয়ে পড়ে। ১৮ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। এর মধ্যেই জুমার নামাজের পর ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন।

২৯ জুলাই : অস্ত্রের ছায়ায় প্রতিবাদ দমন

২৯ জুলাই শহরের বিভিন্ন মোড়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্র হাতে মহড়া দেন। কুবি ছাত্র আন্দোলন চত্বর থেকে কোটবাড়ী মোড় পর্যন্ত এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

১ আগস্ট : শিক্ষকদের পথে পথে বাধা

শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন কুবি শিক্ষকরাও। পূর্বঘোষিত মানববন্ধনে অংশ নিতে চাইলেও কোটবাড়ী মোড় ও ক্যাডেট কলেজের সামনে তাদের বাধা দেয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা।

২ আগস্ট : রাজনৈতিক দল নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল

২৯ তারিখে ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীদের ওপর আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো হামলা করলে আন্দোলনের স্থান পরিবর্তন করে কুমিল্লা শহরে নেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২ আগস্ট জুমার নামাজের পর পুলিশ লাইনসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা।

৩ আগস্ট : গুলির শব্দ ও রক্তাক্ত দিন

এদিন টাউন হল, পুলিশ লাইনসে আন্দোলন চালিয়ে যায় স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেদিন শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসীরা হামলা চালালে অনেক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন।

এ সময় ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ কুমিল্লা শহরজুড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণসহ বর্বরোচিত হামলা চালায়।

৪ আগস্ট : আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিবর্ষণ

৪ আগস্ট পুনরায় কোটবাড়ী বিশ্বরোড অবরোধের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও বিশ্বরোডে অবস্থান নিয়ে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। তারা বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালান। এ সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে আলেখারচর পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্ট দখল করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা।

৫ আগস্ট : শেখ হাসিনার পতন

৫ আগস্ট ২০২৪ এই দিনে বৈধম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষণা অনুযায়ী লংমার্চ টু ঢাকা বাস্তবায়নের জন্য দেশের জনগণ ঢাকায় জড়ো হন। এদিন কুমিল্লা থেকে অনেকে ঢাকায় যান। শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ এবং দেশ ত্যাগ করেন।

শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেলে কুমিল্লার জনগণ আনন্দ-উল্লাস করতে রাস্তায় নেমে আসে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীরা আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেন। ভেঙে ফেলা হয় শেখ মুজিবের ভাস্কর্য।

শোক ও প্রতিবাদে ক্যাম্পাসের নতুন নামকরণ

৫ আগস্ট শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নাম পরিবর্তন করে ‘বিজয় ২৪ হল’ রাখা হবে। শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন করে ‘সুনীতি-শান্তি হল’ ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা।

৬ আগস্ট : কুবি শিক্ষার্থী কাইয়ুমের আত্মত্যাগ

৫ আগস্ট ঐতিহাসিক লংমার্চে অংশ নিতে গিয়ে সাভারে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন কুবি শিক্ষার্থী আব্দুল কাইয়ুম। তার মৃত্যু শিক্ষার্থীদের মনোবলে নতুন উদ্দীপনা জোগায়।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত