দক্ষিণাঞ্চলের গর্ব ব্রজমোহন কলেজ

নিকুঞ্জ বালা পলাশ, বরিশাল
প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ৫৮

দক্ষিণবঙ্গের অক্সফোর্ডখ্যাত সরকারি ব্রজমোহন কলেজ। সংক্ষেপে বিএম কলেজ নামে পরিচিত। বরিশালসহ এ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ ও দেশসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৩৬ বছরের ঐতিহ্যকে ধারণ করে জ্ঞান বিলিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠটি।

এখানে অধ্যয়ন করে হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী নিজেকে বিকশিত করে দেশ ও সমাজকে আলোকিত করে চলেছেন। দেশ পরিচালনাসহ জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, চিকিৎসা, আইন, রাজনীতি, প্রকৌশল, সাংবাদিকতাসহ সৃজনশীল পেশায় এই কলেজের শিক্ষার্থীদের রয়েছে অনন্য অবদান। সমৃদ্ধ ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে ঐতিহ্যের স্মারক প্রতিষ্ঠানটি ধুঁকছে নানা সংকটে।

বিজ্ঞাপন

কলেজকে আলোকিত করেছেন যারা

কলেজের অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী দেশ পরিচালনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপরিচিত ও আলোচিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মনসুর আলী, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস, বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বিখ্যাত আইনজীবী-রাজনীতিবিদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, ভাষাবিদ-শিক্ষাবিদ ও ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ কাজী আবুল কাশেম, প্রখ্যাত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, বিখ্যাত কবি জীবনানান্দ দাস, বিখ্যাত ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্ল বর্মণ, বিখ্যাত কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক নির্মলেন্দু গুণ, রাজনীতিবিদ ও ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিখ্যাত লেখক-কলামিস্ট ও ভাষাসৈনিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী আতাউর রহমান খান, প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের মতো প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বরা।

এছাড়াও শিক্ষাবিদ ও লেখক ড. মীজানুর রহমান শেলী, শিক্ষাবিদ-লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বিখ্যাত কবি আসাদ চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী ও ছাত্রনেতা তোফায়েল আহম্মেদ, সাবেক মন্ত্রী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ, সাবেক মন্ত্রী আমীর হোসেন আমু, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সাবেক হুইফ আ স ম ফিরোজ, বিচারপতি আব্দুর রহমান, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ অগণিত মেধাবী শিক্ষার্থী। যারা দেশ-সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে।

প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

জানা যায়, ১৮৫৩ সালে বরিশাল জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে বরিশাল অঞ্চলে আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নবজাগরণ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বরিশালের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রমেশ চন্দ্র দত্তের অনুরোধে প্রখ্যাত সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী ও আধুনিক বরিশালের রূপকার অশ্বিনী কুমার দত্তের বাবা ব্রজমোহন দত্তের নামে ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বিএম স্কুল ক্যাম্পাসে ব্রজমোহন কলেজ স্থাপন করেন।

১৯১৭ সালে ৫০ বিঘা জমির ওপর কলেজটি তার বর্তমান ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়। ১৯১৮ সালে সরকারি অর্থে ব্রজমোহন কলেজ ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়। এ সময় কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। শিক্ষার মান ছিল অনেক উন্নত। যে কারণে কলেজটিকে দক্ষিণ বাংলার অক্সফোর্ড হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো।

শিক্ষা কার্যক্রম

১৯৬৪ সালে ব্রজমোহন কলেজে অর্থনীতিতে অনার্স কোর্স চালু করা হয়। ১৯৬৫ সালের ১ জুলাই কলেজটি সরকারিকরণ করা হয়। ১৯৭২ সালে কলেজে বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস, হিসাব বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় অনার্স এবং বাংলা, অর্থনীতি, ইতিহাস ও রসায়নে মাস্টার্স কোর্স চালু হয়। এছাড়া পর্যায়ক্রমে ইতিহাস, ইংরেজি ও মৃত্তিকা বিজ্ঞান, ইংরেজি, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, গণিত, ও প্রাণিবিজ্ঞান বিষয়ে পাঠ্যক্রম চালু করা হয়। বর্তমানে ২৫ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী এখানে পড়ালেখা করে। শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় রয়েছে আটটি অ্যাকাডেমিক ভবন।

কলেজটি প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ ছিলেনÑ শ্রীযুক্ত জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরী। বর্তমানে অধ্যাপক ড. শেখ মো. তাজুল ইসলাম অধ্যক্ষ এবং অধ্যাপক ড. এস কাইয়ুম উদ্দীন আহম্মেদ উপাধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত।

সুযোগ-সুবিধা

কলেজের অবকাঠামাগত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে রয়েছে- পশ্চিম প্রান্তে প্রশাসনিক ভবন ও কেন্দ্রীয় মসজিদ। এছাড়া ক্যাম্পাসে রয়েছে একটি মন্দির। আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য দুটি খেলার মাঠ। দুই প্রান্তে দুটি ও মাঝে একটি দীঘি কলেজের সৌন্দর্যকে করে তুলেছে মনোমুগ্ধকর। এছাড়াও কবি জীবনানন্দ দাসের নামে একটি ক্যাফে রয়েছে। রয়েছে লাইব্রেরি ভবন। এতে মোট বইয়ের সংখ্যা ৯৩ হাজার ৩৪৭টি।

শিক্ষার্থীদের প্রতিভা ও সৃজনশীলতা বিকাশে রয়েছে ডিবেটিং ক্লাব, ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ক্লাব, বাঁধন, রোভার, বিএনসিসি। ছাত্রদের জন্য চারটি ছাত্রাবাস ও ছাত্রীদের জন্য রয়েছে তিনটি ছাত্রী নিবাস। কলেজটিতে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষসহ ১৯০ জন শিক্ষকের পদ থাকলেও বর্তমানে ১৫৬ জন কর্মরত আছেন।

এ বিষয়ে বিএম কলেজের সাবেক ছাত্রনেতা বাংলাদেশ জাসদের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আনিচুজ্জামান আনিচ আমার দেশকে বলেন, প্রাচ্যের ভ্যানিস নামে খ্যাত ব্রজমোহন কলেজে অধ্যয়ন করে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী দেশ বিনির্মাণে কাজ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, বিচারপতিসহ প্রশাসনিক বিভিন্ন উচ্চ পদে কর্মরত আছেন।

ব্রজমোহন কলেজের ছাত্রসংসদ বাকসুর সাবেক এজিএস বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস আক্তার জাহান শিরিন আমার দেশকে বলেন, বিএম কলেজটি শুরু থেকেই মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরির কারখানা হিসেবে বিবেচিত। এখানে অধ্যয়ন করে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী রাষ্ট্র পরিচালনাসহ রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এখানে অধ্যয়ন করেই আমি শিখেছি বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক সহবস্থান।

এ বিষয়ে বিএম কলেজের সাবেক ছাত্রনেতা বরিশাল প্রেস ক্লাবের সভাপতি অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম খসরু বলেন, ১৯৮৭ সালে বিএম কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভিপি পদে নির্বাচন করেছিলেন তিনি । এ কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করছেন। তিনি বলেন, এই কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে যারা ভিপি-জিএস বা এজিএস হয়েছিলেন তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তবে বর্তমানে কলেজটি তার ঐতিহ্য পুরোপুরি ধরে রাখতে পারছে না। কলেজের ঐতিহ্য রক্ষায় অধ্যক্ষ নিজেকে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করবেন বলে আমার বিশ্বাস।

এ কলেজ থেকে সারা দেশের মধ্যে সেরা হয়ে রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক পুরস্কার জিতেছেন পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী কামরুন্নাহার নিপু। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ সব ক্ষেত্রে বিএম কলেজকে আরো উচ্চশিখরে পৌঁছে দিতে।

এ বিষয়ে বিএম কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. শেখ মো. তাজুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, এক সময়ে বিএম কলেজ ছিল দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সারা দেশ থেকে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী এখানে ভর্তি হতো। কিন্তু এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েছে। এ কারণে মেধাবী শিক্ষার্থীরাও বিকেন্দ্রীকরণ হচ্ছে। যে কারণে এখন মেধাবী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। তবে সে তুলনায় র‌্যাংকিংয়ে কলেজটি এখনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত