পরপর ভূমিকম্পে নড়ে ওঠা ঢাকার সঙ্গে কেঁপে উঠছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জরাজীর্ণ বিভিন্ন অবকাঠামো। গত শুক্রবারের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে বিভিন্ন হলে ফাটল দেখা দেয় এবং পলেস্তারা খসে পড়ে। আতঙ্কে শিক্ষার্থীদের লাফিয়ে পড়ার মতো ঘটনাও ঘটে। আহত হন প্রায় ৩০ শিক্ষার্থী।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক হল বছরের পর বছর ধরে গুরুতর ঝুঁকির মুখে আছে। জরাজীর্ণ ভবনগুলো ঘিরে শিক্ষার্থীদের ভয়, ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ১৫ দিনের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করেছে এবং শিক্ষার্থীদের হল খালি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা পাল্টা প্রশ্ন তোলেনÑএ সংকট কি সত্যি এখনই তৈরি হয়েছে, নাকি বহুদিনের অব্যবস্থাপনার ফল আজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে?
জরাজীর্ণ-ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন হলের চিত্র
পরপর কয়েক দফা ভূমিকম্পে সর্বাধিক ক্ষতির মুখে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, শেখ মুজিবুর রহমান হলের পুরোনো ভবন, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, নবাব সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, কবি জসীম উদ্দীন হল, মাস্টারদা সূর্যসেন হল, শামসুন্নাহার হল, স্যার এএফ রহমান হল, রোকেয়া হলসহ ঢাবির একাধিক পুরোনো ভবন।
এসব হলের দেওয়ালে ফাটল, ছাদের প্লাস্টার খসে পড়া, পিলার দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং দীর্ঘদিন ধরে চলমান অবহেলার বাস্তবচিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল এবং হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের পরিস্থিতি ভয়াবহ।
জানা যায়, ২০১৪ সালে বুয়েটের একদল গবেষক মুহসীন হলকে ‘বাসযোগ্য নয়’ বলে রিপোর্ট দেয়। কিন্তু ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও বড় কোনো সংস্কার হয়নি। শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রতিটি রুমে ছোটবড় ফাটল, বড় জায়গাজুড়ে পলেস্তারা খসে যাওয়া এখন নিত্যদিনের ঘটনা।
হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ইউনিয়নের ভিপি সাদিক হোসেন সিকদার জানান, আমরা আর এ জরাজীর্ণ হলে থাকতে চাই না। নিরাপদ থাকতে চাই, আমাদের নতুন ভবন দরকার।
এদিকে ভূমিকম্পের পর হলের সমাজকল্যাণ সম্পাদক সাইফুল্লাহর নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা পলাশীর স্টাফ কোয়ার্টারের খালি কক্ষ দখল করে সেখানে থাকার জন্য বিক্ষোভ করেন। তিনি সামাজিকমাধ্যমে লিখেনÑ‘আজ থেকে মুহসীন হলের শিক্ষার্থীরা এখানেই থাকবে।’
অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ভিপি মুহিউদ্দিন মাহবুব জানান, শুধু হলের নাম মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হওয়ার কারণে ফ্যাসিবাদী আমলে এ হলে কোনো সংস্কার হয়নি। ফলে ভূমিকম্পে হলটির জীর্ণশীর্ণ অবস্থা তৈরি হয়েছে।
শুধু জিয়াউর রহমান হল আর হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলেই নয়, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল, ফজলুল হক মুসলিম হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল এবং কবি জসীম উদ্দীন হলেও একই ধরনের ক্ষতির চিহ্ন দেখা গেছে।
সরেজমিন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে দেখা যায়, ভবনের ফাটল আরো বিস্তৃত হয়েছে। একই অবস্থা পাশে থাকা আরেক হল ফজলুল হক মুসলিম হলেরও।
ফজলুল হক মুসলিম হলের ভিপি আবু নায়েম জানান, আমাদের এ ভবনগুলো বহু বছরের পুরোনো। ভূমিকম্পে এখন ছাদ থেকে প্লাস্টার খসে পড়ছে, ফাটল দেখা দিয়েছে। এগুলো পর্যবেক্ষণ করে মেরামত করা খুবই জরুরি।
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ভিপি আহসান হাবিব জানান, জহুরুল হক হলের ভবনের বিভিন্ন দেওয়াল ও স্তম্ভে নতুন করে ফাটল দেখা গেছে। অন্যদিকে কবি জসীম উদ্দীন হলেও একাধিক দেওয়ালে নতুন ফাটল ও দুই কক্ষে প্লাস্টার পড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে রাত কাটাচ্ছে।
মাস্টারদা সূর্যসেন হলের অবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। সরেজমিন দেখা যায়, একাত্তর হলসংলগ্ন সূর্যসেন হলের ভবনটি কিছুটা উত্তর দিকে বেঁকে গেছে, যা কম্পাস ব্যবহার করা ছাড়াই সবার নজরে আসছে।
অন্যদিকে নারী শিক্ষার্থীদের হলগুলোর পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। শিক্ষার্থীরা জানান, শামসুন্নাহার হলের বারান্দার পুরোনো ফাটল আরো প্রসারিত হয়েছে। সুফিয়া কামাল হলের ‘প্রত্যাশা ভবন’ ও ‘প্রদীপ ভবন’-এ নতুন ফাটল দেখা গেছে। কুয়েত-মৈত্রী হলে বৃহৎ ক্ষতি না হলেও দুটি স্থানে প্লাস্টার পড়ে গেছে।
এদিকে শুক্রবার ভূমিকম্পে ঢাবির বিভিন্ন হলে অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থী আহত হন। স্যার এএফ রহমান হলের আহত শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান বলেন, এ দুর্ঘটনা বড় বিপর্যয়ের সতর্কবার্তা। রানা প্লাজার মতো ঘটনা হলে প্রশাসন কি শুধুই শোক জানাবে?
হল ছাড়ার নির্দেশ, বিভ্রান্ত শিক্ষার্থীরা
ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট জরুরি বৈঠক করে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাবি বন্ধ ঘোষণা করে। সব আবাসিক শিক্ষার্থীকে ২৩ নভেম্বর বিকাল ৫টার মধ্যে হল ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়। এমনকি হলের ডাইনিং ও ক্যান্টিনও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এদিন ঢাবির বিভিন্ন হলে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা ব্যাগ হাতে বাড়ির পথে রওনা হচ্ছে। তবে অনেকেই বলছেন, হঠাৎ করে হল ছাড়তে বলা অমানবিক। টিউশন, চাকরিসহ নানা দায়িত্ব থাকায় অনেকেই বাড়িতে যেতে পারছেন না।
হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ২০২০-২১ সেশনের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রাব্বি বলেন, ১৫ দিনে কি সত্যিই এসব ভবন টেকসই করা সম্ভব? নাকি এটি নিছক একটি লোক দেখানো কারসাজি?
এ নিয়ে হল বন্ধের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শনিবার রাতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে শিক্ষার্থীরা তিন দফা দাবি তোলেনÑহল বন্ধের সিদ্ধান্ত স্থগিত করা, ঝুঁকিপূর্ণ হলের বাসিন্দাদের স্বাধীনতা টাওয়ারে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা এবং হলে সমস্যা হলে শিক্ষকদের কোয়ার্টারসহ পুরো ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করা। তবে রোববার সকালে আর তাদের দেখা যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবস্থান
এদিকে ভূমিকম্পের পর পরিস্থিতি মূল্যায়নে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জরুরি সভা করছে। সভায় সিদ্ধান্ত আসে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলসহ পুরোনো সব ভবন অবিলম্বে বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা পরিদর্শন করবেন। প্রতিটি কক্ষের কারিগরি মূল্যায়ন হবে, ঝুঁকি পাওয়া গেলে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে নেওয়া হবে এবং পর্যবেক্ষণ শেষ পুরো রিপোর্ট উন্মুক্ত করা হবে।
সভায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান জানান, ১৪৯ কোটি টাকার সংস্কার প্রকল্প ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে শুরু হবে। এছাড়া দুই হাজার ৮৪১ কোটি টাকার ‘ঢাবির অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’-এর আওতায় ২০২৬ সালের মধ্যে নতুন ছাত্র ও ছাত্রীহল নির্মাণ শুরু করা হবে।

