ডাকসু নির্বাচন

নজর কাড়ছেন নারী প্রার্থীরা

মাহির কাইয়ুম, ঢাবি
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৫, ০৭: ৩৯

দীর্ঘ ছয় বছরের স্থবিরতার অবসান ঘটিয়ে আসন্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে প্রথমবারের মতো নারী প্রার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এবারের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বিভিন্ন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন মোট ৬০ জন নারী শিক্ষার্থী। শীর্ষপদসহ প্রায় সব কয়টি পদের বিপরীতে লড়ছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) পদে লড়বেন পাঁচ নারী শিক্ষার্থী। তারা হলেন উমামা ফাতেমা, তাহমিনা আক্তার, মারজিয়া হোসেন জামিলা, শেখ তাসনীম আফরোজ ইমি এবং জান্নাতি বুলবুল। সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে একমাত্র নারী প্রার্থী সাবিনা ইয়াসমিন এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে লড়বেন চারজন— আশরেফা খাতুন, অদিতি ইসলাম, ফাতেহা শারমিন ও সানজানা আফিফা।

মুক্তিযুদ্ধ ও ছাত্র আন্দোলন সম্পাদক পদে ১ জন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ১, ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক পদে ২, মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক পদে ৩, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে ৩, ক্রীড়া সম্পাদক পদে ১, গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে ৪, কমনরুম-রিডিং রুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ৯, সাহিত্য সম্পাদক পদে ২ এবং সদস্য পদে ২৪ জন নারী শিক্ষার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

এছাড়া ছাত্রীদের পাঁচটি হলে ১৩টি করে পদের বিপরীতে মোট ১৮৮ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ৩১ জন, রোকেয়া হলে ৪৫, শামসুন নাহার হলে ৩৬, ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে ৩৬ এবং কবি সুফিয়া কামাল হলে ৪০ জন।

অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায়, ডাকসুর দীর্ঘ ইতিহাসে নারী নেতৃত্বের নজির হাতেগোনা। মাত্র দুজন নারী ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারা হলেন ১৯৬০-৬১ শিক্ষাবর্ষে বেগম জাহানারা আক্তার এবং ১৯৬৬-৬৭ শিক্ষাবর্ষে মাহফুজা খানম। এরপর থেকে আর কোনো নারী ভিপি নির্বাচিত হননি। দীর্ঘ বিরতির পর ২০২৫ সালের নির্বাচনে আবারও শীর্ষ তিন পদে নারী প্রার্থীদের উপস্থিতি শিক্ষার্থীদের মনে নারী নেতৃত্ব নিয়ে আশা সৃষ্টি করছে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪৮ শতাংশ ভোটার নারী হওয়ায় এই প্রার্থীদের জয়ের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনের মতে, এবার নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ শুধু ডাকসুর নয়, ভবিষ্যতের জাতীয় রাজনীতিতেও নারী নেতৃত্বের নতুন ধারা তৈরি করতে পারে।

আসন্ন নির্বাচনে নারী নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল। আন্দোলন ও সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় পরিচিত এসব নারী প্রার্থী ছাড়াও প্রতিটি প্যানেলেই রয়েছেন নারী প্রার্থীরা।

উমামা ফাতেমা

জুলাই অভ্যুত্থানের পরিচিত মুখ উমামা ফাতেমা এবার ভিপি পদে স্বতন্ত্র প্যানেল থেকে লড়ছেন। উমামা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকে বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর সেপ্টেম্বরে ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য সচিব পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এই শিক্ষার্থী পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকেও সরে দাঁড়ান। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও তিনি বিভিন্ন ইস্যুতে সরব ছিলেন এবং সর্বপ্রথম স্বতন্ত্র প্যানেল গঠন করার ঘোষণা দেন। তার প্যানেলে জিএস পদে লড়বেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (ডুজা) সাবেক সভাপতি আল সাদী ভূঁইয়া ও এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জাহেদ আহমেদ।

উমামা ফাতেমা বলেন, আমাকে অনেকে বলেছে, আমি মেয়ে মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মেয়ে মানুষকে ভোট দেবে না। তাই আমাকে অনেকে বলেছে সরে আসতে। যদিও আমি তাদের নাম বলছি না। আমাকে বলেছে, কোনো সম্পাদক পদ হলে আমি নাকি জিতে আসব। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে এখনো অনেক দূর হাঁটতে হবে। আমরা আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ পাইনি। ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা সেই আকাঙ্ক্ষার দিকে এগিয়ে যাব।

শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি

বামপন্থি সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেল থেকে ভিপি পদে লড়ছেন শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি। তিনি সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে শামসুন্নাহার হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাতীয় নাগরিক কমিটির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন ইমি। তার সঙ্গে একই প্যানেল থেকে জিএস পদে লড়বেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মেঘমল্লার বসু।

ইমি বলেন, নির্দিষ্ট কোনো সাংগঠনিক কাঠামোর অংশ নয় এমন মানুষদের সমন্বিত করে আমরা একটি প্যানেল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। এটি শুধুই গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট বা বামপন্থিদের প্যানেল নয়, একাত্তর ও চব্বিশের গণহত্যাকারীদের ঘৃণা করে যারা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণের লড়াইয়ে অংশীজন হতে চাই, তাদের নিয়ে আমরা প্যানেল করছি। আশা রাখছি আমরা ভালো কিছু করব।

জিএস পদে সাবিনা ইয়াসমিন

ডাকসু নির্বাচনে জিএস পদে একমাত্র নারী প্রার্থী হলেন সাবিনা ইয়াসমিন। বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের প্যানেল থেকে লড়ছেন তিনি।

সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসার পরপরই সাত কলেজকে ঢাবি থেকে পৃথকীকরণ আন্দোলন, নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই আন্দোলন, জুলাই আন্দোলনের সময় রোকেয়া হলের হয়ে প্রথম সারিতে থেকেই আন্দোলন করেছি। এ ছাড়া পিএসসি সংস্কার আন্দোলনসহ সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমার আন্দোলন ও প্রতিবাদ ছিল। তা ছাড়া ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পেছনে অনেক লড়াই সংগ্রাম ছিল।’

সাবিনা বলেন, আগামীতে নারী শিক্ষার্থীসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর অধিকার রক্ষা ও দাবি আদায়ের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করতে সবার সমর্থন চাই।

এজিএস পদে এ্যানি-আশরেফারা

ডাকসুর এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী ফাতেহা শারমিন এ্যানি এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আশরেফা খাতুন। এ্যানি শিক্ষাজীবনে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি বহ্নিশিখা, সজ্জা, গ্রিন ভয়েসসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। করোনাকালে ব্লাড ব্যাংকেও কাজ করেছেন।

এ্যানি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস ডাকসুকে নিয়মিতভাবে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে ঢাবিতে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির নোংরা সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন হয়ে আসবে। থাকবে না কোনো ভয়ের সংস্কৃতি; প্রভুত্ব কিংবা দাসত্ব। সর্বাবস্থায় শিক্ষার্থীরা তাদের যৌক্তিক দাবি নিশ্চিন্তভাবে উপস্থাপন করতে পারবে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে। এটাই এই মুহূর্তে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর দাবি। আর শিক্ষার্থীদের সব যৌক্তিক দাবিই আমার অঙ্গীকার।’

অন্যদিকে আশরেফা খাতুন নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, সাত কলেজ বাতিল আন্দোলন এবং আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদসহ নানা আন্দোলনে সরব ছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ও তিনি সম্মুখ সারিতে নেতৃত্ব দেন। বর্তমানে তিনি গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের মুখপাত্র।

আলোচনায় মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে লড়বেন জুমা

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে লড়বেন ইনকিলাব মঞ্চের ফাতিমা তাসনিম জুমা। তিনি সুফিয়া কামাল হলের ২০২১-২২ সেশনের আবাসিক শিক্ষার্থী। বর্তমানে তিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশ আলোচনায় রয়েছেন।

জুমা বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হলে আওয়ামী কালচারাল হেজিমনির বিরুদ্ধে লড়ব। জনতার চেতনাকে যারা নিজেদের স্বার্থে কুক্ষিগত করে তাদের কুঠারাঘাত করব। আমি আমার নির্ধারিত পদ থেকে আমার দায়িত্বগুলোর প্রতি ফোকাস থাকব।’

ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থী জুমা বলেন, ‘আমি জুলাইয়ের পর এমন এক নারী চরিত্র যেসব পক্ষ, মত, দলের কাছে বারংবার ভুক্তভোগী হয়েছি। তথাপি কোনো বাধা আমাকে দমাতে পারেনি। আমি সেসব নারীর প্রতিনিধিত্ব করি, যারা হার না মানা সংগ্রাম করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে। যারা পদে পদে সব বাধা ডিঙিয়ে স্বপ্ন ছোঁয়। সেই গল্পও বলব হয়তো একদিন।’

এদিকে এখন পর্যন্ত ঘোষিত ৯টি পূর্ণাঙ্গ প্যানেলে মোট ৩৮ জন নারী প্রার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ থেকে ১২ জন, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ থেকে ৬ জন, ইসলামী ছাত্রশিবিরের ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ থেকে ৪ জন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল থেকে ২ জন, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ও ছাত্রলীগ-বিসিএলের (বাংলাদেশ জাসদ) যৌথ প্যানেল ‘অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪’ থেকে ২ জন, ছাত্র অধিকার পরিষদের ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ’ থেকে ১ জন, সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ থেকে ২ জন এবং স্বতন্ত্র ঐক্যজোট থেকে ৬ জন নারী প্রার্থী রয়েছেন।

নারী প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ সাইবার বুলিং

নারী প্রার্থীরা আশাবাদী হলেও তাদের বড় উদ্বেগ সাইবার বুলিং নিয়ে। প্রার্থীদের অনেকে মনে করেন— এ ধরনের আক্রমণ ভোটের ফলাফলেও প্রভাব ফেলতে পারে। নারী প্রার্থীদের অভিযোগ, ইতোমধ্যেই সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন তারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে শুরু করে কটূক্তি ও অশালীল ভাষার ব্যবহার তাদের আতঙ্কিত করেছে।

এজিএস প্রার্থী আশরেফা খাতুন বলেন, ‘আওয়ামী শাসনামলে নারী নেত্রীদের হেনস্তা করা হতো। ভেবেছিলাম অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তা থাকবে না। কিন্তু এখন আবার শুরু হয়েছে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলো কঠোর হলে নারী নেতৃত্ব আরো শক্তিশালী হবে।’

ডাকসুতে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক প্রার্থী ফাতিমা তাসনীম জুমা বলেন, ‘আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বারবার নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হয়েছি এবং হচ্ছি। সেই নোংরামির বিপরীতে আমাদের কিছু করার থাকে না।’ তিনি বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হলে নারীদের জন্য সাইবার সুরক্ষা নিয়ে কাজ করব। নারীরা যাতে রাজনীতিতে আগ্রহী হয়, তারা যেন রাজনীতিতে নিরাপদ পরিবেশ পায়— সে বিষয়ে বিশেষ নজর থাকবে।’

উল্লেখ্য, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে এবার মোট ১ হাজার ৫৭০ জন প্রাথমিক প্রার্থী তালিকায় স্থান পেয়েছেন। ২৬২টি পদের বিপরীতে এই দেড় হাজারের বেশি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। আগামী ২৬ আগস্ট চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে এবং ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত