আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

বাংলার মুক্তিযুদ্ধ

ড. আহমদ আনিসুর রহমান
বাংলার মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সংক্ষিপ্ত ও বেদনাবিধুর হলেও বাংলার জনগণের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কিন্তু এই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ নয়। আর ১৯৭১ সাল কেবল আমাদের দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামের শুরু বা শেষ নয়; এটি যুগ-যুগান্তরের মুক্তিযুদ্ধের অংশ। সেই দীর্ঘ মুক্তির লড়াই কখনো কখনো সশস্ত্র সংঘাতের রূপ নিয়েছে এবং ১৯৭১ সালের মতো প্রকাশ্য যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছে।

যদি সশস্ত্র রূপ ধারণ করা ছাড়াই মুক্তি সংগ্রাম বা বৃহত্তর অর্থে মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য অর্জিত হতো, তবে সেটি রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র রূপে যেতে না দেওয়াই শান্তিপ্রিয় বাঙালির কাছে অভিপ্রেত হতো।

বিজ্ঞাপন

ওই মুক্তিযুদ্ধের মূল থেকে তার প্রজন্মান্তরে বিবর্তনের ধারণা না থাকলে আমাদের সময়ের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী চলমান মুক্তিসংগ্রামের তাৎক্ষণিক পটভূমি, তাৎপর্য ও ভবিষ্যৎ গতিপথ সঠিকভাবে বোঝা যাবে না। আর তা না বুঝলে হাজারো বছরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণের যে প্রয়োজন ও দায়িত্ব রয়েছে, সেটিও যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব হবে না।

মূল

জাতি হিসেবে আমাদের মতোই আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধেরও মূল বাংলাদেশের আজকের যে ভৌগোলিক অবস্থান, তার বাইরে, দূর পশ্চিমে দুই উপত্যকায়। বাঙালি জাতির মূল, দজলা-ফোরাত উপত্যকায়; আর তাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল সিন্ধু-গাঙ্গেয় অববাহিকায়।

নূহ-নবী সম্ভবত মহানূহ, সংক্ষেপে ‘মনু’—এর নৌকার উৎসভূমি হলো দজলা ও ফোরাত নদীদ্বয়ের উৎস এলাকা, যা আজকের সিরিয়া, ইরাক ও তুরস্কের মিলনক্ষেত্র। প্লাবন-প্রলয়ে আজকের তুলনায় সেকালের ক্ষুদ্র মানবজাতিটিও ধ্বংস হয়ে যায়, মাত্র একশ’ জনেরও কম ছাড়া। এই শতের কম মানুষ দিয়েই নতুন মানবসভ্যতার সূচনা হয় এলাকায়। আর সেখান থেকেই সেই অতি ক্ষুদ্র মানবগোষ্ঠীর সদস্যরা বিভিন্ন দিকে ছড়ায়। তাদের প্রায় সবাই নূহের তিন পুত্রসন্তান—ইয়াফেস, সাম বা শাম ও হাম ও তাদের বংশধর। সাম বা স্যাম, শেম বা সেম—তাকেই সম্ভবত শ্যামও বলা হয়—এর বংশধরদের ‘সামী’, ‘সামীয়’ বা ‘সেমিটিক’ বলে। তাদের ‘শ্যামল’-ও বলা যায়। তাদেরই একটি শাখা সম্ভবত পূর্ব ইয়েমেন, আর যাকে ওমান বলে আজকাল, সে এলাকা হয়ে আজকে যাকে সিন্ধু নদী বলে, তার অববাহিকায় এসে বসতকারীরাই সিন্ধু সভ্যতা সৃষ্টি করে। তাদের বিবর্তনের কোনো একপর্যায়ে তাদের গোত্রপ্রধান ‘আবির’-এর বংশধররা ‘দার-আবির’—সংক্ষেপিত রূপে, ‘দ্রাবির’ বা ‘দ্রাবিড়’ বলে পরিচিত হয়। তাদের অধস্তনদেরই একটি শাখা থেকেই বাংলা জাতির উৎপত্তি হয়। সে অর্থে বাংলা জাতি, মূলত ও প্রধানত দ্রাবিড়।

দ্রাবিড়রা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পূর্ব দিকে বিস্তৃত হয়ে গাঙ্গেয় অববাহিকায় বসতি স্থাপন করেন এবং তাদেরই এক শাখা সে অববাহিকার পূর্ব প্রান্তে এসে বাংলা জাতি হন, বাংলাদেশ করেন।

এভাবে উত্তর ভারতবর্ষে যখন দ্রাবিড় সভ্যতা উজ্জ্বল ও সুপ্রতিষ্ঠিত, তখন উত্তর-পশ্চিমের পর্বতমালার ওপার থেকে হিংস্র ও দুর্ধর্ষ বলে পরিচিত হয়ে ওঠা ‘আর্য’ নামে পরিচিত ইয়াফেসের বংশধরদের আগ্রাসন শুরু হয়। সাম বা শ্যামের বংশধর ‘সামী’, ‘সামীয়’, ‘সেমিটিক’ বা ‘শ্যামল’ জাতির অনেক শাখার মতোই ইয়াফেসের বংশধরদের প্রায় সবাই দজলা-ফোরাত নদীর উৎসভূমিতে অবস্থিত তাদের আদি নিবাস ত্যাগ করে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের এক শাখা কাশ্মীর হয়ে অন্যান্য শাখা-প্রশাখাসহ সিন্ধু ও গঙ্গা নদীর উর্বর অববাহিকায় এসে উপস্থিত হয়।

এর আগেই ইয়াফেসের ভাই সামের বংশধর—‘সামী’, ‘সেমিটিক’ বা শ্যামল জাতির বিভিন্ন শাখা এবং দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী সেখানে এসে অনাবাদি উর্বর জমি ও পর্যাপ্ত পানির সদ্ব্যবহার করে এক উন্নত কৃষিভিত্তিক সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। সে সময় মধ্য এশিয়ার প্রায় মরুপ্রায়, কৃষির অনুপযোগী বিস্তৃত স্তেপ অঞ্চলে বসবাসকারী ইয়াফেস-বংশীয়রা জীবনধারণের কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ধারার বিচারে তারা তখনো পশুপালনভিত্তিক জীবনব্যবস্থার পর্যায়ে আবদ্ধ ছিল, যেখানে সিন্ধু-গঙ্গা অববাহিকার শ্যামল জনগোষ্ঠী কৃষিভিত্তিক উন্নত সভ্যতার স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল।

পশুপালনভিত্তিক জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পশুর জন্য নতুন চারণভূমি ও পানির সন্ধানে বারবার স্থান পরিবর্তন করা। শত শত বছর ধরে মধ্য এশিয়ার রুক্ষ ও অনুর্বর প্রান্তরে টিকে থাকার এই কঠোর সংগ্রামে ইয়াফেস-বংশীয়রা ধীরে ধীরে সভ্যতার অনেক রীতি-নীতি ভুলে গিয়ে রুক্ষ, হিংস্র ও দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে তারা মধ্য এশিয়ার দীর্ঘ দক্ষিণ সীমান্ত অতিক্রম করে খাদ্য ও লুটের উদ্দেশ্যে ঝটিকা আক্রমণ শুরু করলে সম্ভবত পারস্য অঞ্চলে বসবাসকারী তুলনামূলকভাবে সভ্য ‘সামী’, ‘সেমিটিক’ বা শ্যামল জাতির কোনো শাখা—যেমন ‘এলাম’ বা অন্য কোনো আক্রান্ত সমাজ—তাদের ‘আরয়’ নামে অভিহিত করতে শুরু করে। এই শব্দের অর্থ ছিল ‘নগ্ন’, ‘বেহায়া’, ‘নির্লজ্জ’, অর্থাৎ ‘অসভ্য’ বা ‘বর্বর’।

তৎকালীন দ্রাবিড় ও সেমিটিক সভ্যতা ছিল উন্নত, যেখানে লজ্জাশীলতা ও শালীনতা গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচিত হতো। তাই শরীর আবৃত রাখা ও পরিশীলিত পোশাক পরার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। অপরদিকে মধ্য এশিয়া থেকে আগত ইয়াফেস-বংশীয়রা তখনো সম্ভবত পুরোপুরি পোশাক পরার অভ্যাস রপ্ত করতে পারেনি। সে কারণেই আরব অঞ্চল থেকে আগত সাম-বংশীয় ‘সামী’ বা ‘সেমিটিক’ জনগোষ্ঠী তাদের এই নামে ডাকত। কালের প্রবাহে ইয়াফেস-বংশীয়রাও সেই নাম নিজেরাই গ্রহণ করতে শুরু করে, আর ধীরে ধীরে শব্দটির আদি অর্থ সাধারণ মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়।

বিভিন্ন ভাষায় ‘য়’ ধ্বনিটি অনেক সময় ‘য’ হিসেবে উচ্চারিত হয়। সেই ধারাতেই ‘আরয়’ শব্দটি কখনো কখনো ‘আরয’ রূপে উচ্চারিত বা লিখিত হয়েছে। লেখার সুবিধা ও সংক্ষিপ্ততার জন্য ‘য’ ধ্বনি প্রকাশ করা হয়েছে ‘য-ফলা’ দিয়ে। এর ফলে বাংলায় মূল ‘আরয়’ শব্দটি ‘আর্য্য’ হিসেবে লেখা হতে থাকে, যা পরে সংক্ষেপিত হয়ে দাঁড়ায় ‘আর্য’। তবে সংস্কৃত ও হিন্দিসহ উপমহাদেশের অন্যান্য ভাষায় এবং যতদূর জানা যায়, বিশ্বের অন্যান্য ভাষাতেও এখনো শব্দটি মূলত ‘আরয়’ রূপেই উচ্চারিত হয়।

সিন্ধু-গঙ্গা অববাহিকায় আর্য দখল

মধ্য এশিয়ার বিস্তৃত যাযাবর ‘স্তেপ’ অঞ্চলের দীর্ঘ দক্ষিণ সীমান্ত পেরিয়ে যে কারণে ও যেভাবে আর্যরা দক্ষিণ-পশ্চিমে পারস্যের দ্রাবিড় বসতিতে আক্রমণ চালিয়ে তাণ্ডব ঘটায় এবং ‘অসভ্য’ বা ‘আর্য’ নামে পরিচিত হয়, ঠিক একই কারণ ও পদ্ধতিতেই তারা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে উত্তর ভারতবর্ষে আক্রমণ করে এবং একই রকম তাণ্ডব চালায়। শুরুতে এসব আক্রমণ সীমান্তবর্তী কাশ্মীর অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ছিল ঝটিকা হামলা।

কিন্তু পরে মধ্য এশিয়ার প্রায় মরুভূমিসদৃশ স্তেপ অঞ্চলে আর্যদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ব্যবহারযোগ্য চারণভূমি ক্রমে কমে আসায় খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পশুপালের ব্যাপক বৃদ্ধির প্রয়োজন ও পানির সংকটে তাড়িত হয়ে তারা এক সময় স্থায়ীভাবেই দক্ষিণ সীমান্ত অতিক্রম করে উত্তর পারস্য ও উত্তর ভারতের সিন্ধু-গঙ্গা অববাহিকায় নেমে আসতে শুরু করে। একের পর এক একই ধরনের হিংস্র ও দুর্ধর্ষ ঝটিকা আক্রমণের মাধ্যমে তারা ক্রমেই অধিক থেকে অধিকতর ভূমি দখল করে নেয়।

এই ভূমি দখল ও তা ধরে রাখার জন্য সভ্যতাবিবর্জিত, তথাকথিত বর্বর আর্যরা যে নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতনের তাণ্ডব চালাত, সেখান থেকে নিজেদের মুক্ত করতেই অনার্য দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটে। এই সংগ্রামই পরবর্তীকালে মূলত দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীরই অধস্তন পুরুষদের একটি শাখা হিসেবে বিকশিত বাংলা জাতির সব পরবর্তী মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বীজ হয়ে থাকে।

বীজ থেকেই বৃক্ষ ও ফলের জন্ম। বীজের যে মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকে, তা থেকে জন্ম নেওয়া গাছের সব সময়ের সব ফলের মধ্যেই সেই বৈশিষ্ট্য অনিবার্যভাবে উপস্থিত থাকে—হাজারো বছর পর হলেও। তেমনি আমাদের কালের বাংলা জাতির মুক্তিযুদ্ধ, তার আগের ও পরের চলমান মুক্তিসংগ্রামেও সেই প্রাচীন অতীতের আদি মুক্তিযুদ্ধের বীজে নিহিত মৌলিক দিকগুলো অবধারিতভাবেই বিদ্যমান।

তাই বাংলার মুক্তিযুদ্ধ সব সময়ই হয়েছে এবং হয়ে এসেছে প্রধানত তিনটি উদ্দেশ্যে—

১. বিজাতীয় দখল থেকে বাংলার নিজস্ব ভূমিকে উদ্ধার ও রক্ষা করা।

২. বিজাতীয় দখলদারদের বর্বরতা, নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতনের তাণ্ডব থেকে নিজেদের উদ্ধার ও রক্ষা করা।

৩. নিজেদের মাটি তথা দেশে নিজেদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা ও পুনরুদ্ধার করা।

এখানে বাংলার নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতি বলতে বোঝাবে, বাংলা জাতি মূলত ও প্রধানত সেই অনার্য ‘সামী’ বা ‘সেমিটিক’ মহাজাতির অংশ এবং এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—

(ক) আদি ও মূল বিশ্বাসের অবিকৃত রূপ এবং সেই মূল বিশ্বাসের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ নয় এমন সব বিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত ধর্মীয় দিকগুলো।

(খ) ওই বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত সব মূল্যবোধ এবং সেই মূল্যবোধের প্রকাশ মাধ্যম।

(গ) ভাষা।

(ঘ) ব্যক্তিগত আচার-আচরণ ও জীবনধারা।

(ঙ) সামাজিক রীতিনীতি।

বাংলার প্রধানতম বিশালাংশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য রূপে উপরোক্ত বিষয়গুলোর সমষ্টিই বাংলার সভ্যতা। মাটি, মানুষ আর এই সভ্যতার রক্ষাই বাংলার মুক্তিযুদ্ধের মূল, প্রকৃত ও যথার্থ উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য সাধনই বাংলার মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। এই চেতনায় দীপ্ত হয়ে বাংলা জাতি হাজারো বছর ধরে প্রায় লাগাতারই মুক্তি সংগ্রাম করে গেছে, তারই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধও করেছে বারবার।

আবহমান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা

মধ্য এশিয়া থেকে সিন্ধু-গঙ্গা অববাহিকায় এসে হামলা করে আর্যরা। সেখানে সে সময় অনার্য দ্রাবিড়রা যে শান্তিপূর্ণ সমৃদ্ধ কৃষিনির্ভর সভ্যতা গড়ে তুলেছিল, তা ধ্বংস করে তারা জমি দখল করতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়ায় তারা একদিকে অনার্য দ্রাবিড়দের জমি দখল করতে শুরু করে, অন্যদিকে অনার্য দ্রাবিড়দের গণহত্যা ও তৎ-সংশ্লিষ্ট নৃশংস নিষ্ঠুর অত্যাচারের তাণ্ডব করে। তা থেকে মুক্তির জন্য সিন্ধু-গাঙ্গেয় অববাহিকা তথা উত্তর ভারতের স্থানীয় অনার্য দ্রাবিড়রা মধ্য এশিয়া থেকে আগত বহিরাগত আর্যদের প্রতিপক্ষ হয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে।

সভ্যতার একটি দিক হলো তাতে সভ্য মানুষের সহিংসতার প্রবণতাসহ পাশবিক দিকগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় এবং কমে আসে। সিন্ধু-গঙ্গা অববাহিকার অনার্য দ্রাবিড় এক অত্যুচ্চ পর্যায়ের সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। সে সভ্যতায় সুসভ্য সেই ‘সেমিটিক’ অনার্যরা আক্রমণকারী বহিরাগত দুর্ধর্ষ আর্যদের তুলনায় হয়ে পড়েছিল অতি ভদ্র, নম্র ও সহিংস সংঘর্ষমূলক যুদ্ধে অপারগ। ফলে আর্য দখলদারদের বিপক্ষে মুক্তিযুদ্ধে তারা পেরে উঠছিল না। ফলে ক্রমে দখলদার আর্যরা সিন্ধু উপত্যকার উত্তরাংশ, অর্থাৎ আজকের ‘পাঞ্জাব’, আর গাঙ্গেয় অববাহিকার পূর্বাংশ, অর্থাৎ আজকের ‘উত্তর প্রদেশ’-এর স্থানীয়, তথা ‘সেমিটিক’ অনার্য দ্রাবিড়দের অনেককে হত্যা করে এক বিশাল অংশকে দাসে পরিণত করে এবং ওই দুই এলাকা নিজেদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে এনে সেখানে ‘আর্যাবর্ত’, অর্থাৎ ‘আর্যদেশ’ প্রতিষ্ঠিত করে। সেখানকার ‘সেমিটিক’ অনার্য দ্রাবিড়দের গণহত্যা বা দাসত্ব থেকে বেঁচে যেতে সমর্থ বিশাল অংশ মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে গিয়েই দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে সরে যেতে থাকে। পরাজয়ের পর পরাজয়ের ভেতর দিয়েও পিছু হটতে হটতেও ‘সেমিটিক’ অনার্য দ্রাবিড়রা মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যায় তাদের সভ্যতায় বিধৃত তার চেতনায় দীপ্ত থেকে।

এই চেতনাকে নির্মূল করতে একপর্যায়ে বহিরাগত আগ্রাসী আর্য দখলদাররা ‘সেমিটিক’ অনার্য দ্রাবিড়দের সভ্যতা-সংস্কৃতির ভিত্তি—তাদের মূলত সেমিটিক মূল্যবোধ ও তার উৎস—আদি ‘সেমিটিক’ একেশ্বরবাদী ধর্মের বিশ্বাসমালাকে ধ্বংস বা বিদূরিত করতে তৎপর হয়। যান্ত্রিক শিল্পায়নভিত্তিক নিরঙ্কুশ পুঁজিবাদী পর্যায়ের আগের আর্থ-সামাজিক বিবর্তনের সব পর্যায়েই সমাজের মূল্যবোধ সাধারণত হয়ে থাকে ধর্ম-জাত। এজন্যই এসব পর্যায়ের যে কোনোটাতেই বেড়ে ওঠাদের মন-মানসিকতা তাদের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে, সচেতনতায় বা অবচেতনায় রূপায়িত ও চালিত হয় ধর্মজাত মূল্যবোধে। সেই প্রাচীন আর্য ও অনার্যদের চেতনা রূপায়িত হয় তাদের যার যার ধর্মবিশ্বাসজাত মূল্যবোধ দ্বারা।

সেমিটিক দ্রাবিড় অনার্যদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নির্বাপিত করার জন্য দখলদার আর্যরা দুই প্রধান কৌশল অবলম্বন করত। একদিকে তারা সেমিটিক অনার্যদের একেশ্বরবাদী বিশ্বাস, ধর্ম ও চেতনাকে তাদেরই ভেতরে আর্যধর্মের বহু ঈশ্বরের পূজা প্রভৃতির সঙ্গে প্রতিস্থাপন করত। অন্যদিকে আর্যদের দাসত্ব ও বর্ণবিভাজিত সামাজিক ব্যবস্থা দ্বারা অনার্যদের সর্বনিম্ন অবস্থানে রেখে প্রজন্মান্তরে ‘মগজ ধোলাই’সহ নানা নিপীড়নমূলক কৌশল প্রয়োগ করা হতো।

এই ধরনের ‘মগজ-ধোলাই’-এর মাধ্যমে ত্রাস বা গণহত্যার ভয় দেখিয়ে জীবনরক্ষার তাগিদে অনার্যদের আর্য-ধর্মে দীক্ষিত করা হতো। বর্ণবিভাজিত আর্যশাসিত সামাজিক ব্যবস্থায় নিম্নবর্ণে রাখা হতো এবং ক্রমে বিশ্বাস তৈরি করা হতো যে, তাদের দুরবস্থা পূর্বজন্মের পাপের ফল। সেই পাপ নিবারণের উপায় হিসেবে তারা উচ্চবর্ণের আনুগত্য ও সেবা করলে পরবর্তী জন্মে তারা উচ্চবর্ণে জন্মে সুখী হবে। এর এক অর্থ হলো, আগ্রাসী দখলদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা ও চেতনাকে পরবর্তী প্রজন্মে ভয়ংকর কর্মফলের আশঙ্কায় পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা।

এই পরিস্থিতিতে, ‘সেমিটিক’ অনার্য দ্রাবিড়দের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে দেশ রক্ষা এবং নিজেদের জীবন ও জীবিকা রক্ষার পাশাপাশি তাদের স্বকীয়তা রক্ষা করা। এই স্বকীয়তা রক্ষার উদ্দেশ্য ছিল আর্যদের প্রতিপক্ষে নিজেদের মূল ও আদি ‘সেমিটিক’ একেশ্বরবাদী বিশ্বাস, ধর্ম ও সেই চেতনাজাত মূল্যবোধের জীবনধারাকে বাঁচিয়ে রাখা। এই বিশ্বাস ছিল মূলত এক ও একক নিরাকার বিমূর্ত উপাস্যকে কেন্দ্র করে।

অন্যদিকে আর্য আগ্রাসীদের দেশ দখল, গণহত্যা ও নিপীড়ন ছিল তাদের প্রতিপক্ষ। দীর্ঘ ঐতিহাসিক বিবর্তনের মাধ্যমে আর্যাবর্তের আর্যদের বিশাল অংশে যে প্রকৃতি-পূজামূলক, বহু দেবদেবীর মূর্তি-মাধ্যমে উপাসনার বিশ্বাস ও ধর্ম প্রচলিত ছিল, দ্রাবিড়দের সংগ্রাম ছিল তার বিপরীতে।

বাংলা জাতি ও বাংলাদেশ

উপরোক্ত মাটি, মানুষ ও নিজেদের স্বকীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি রক্ষা ও উদ্ধার করার মুক্তিযুদ্ধ চালাতে চালাতে গাঙ্গেয় অববাহিকার সেমিটিক অনার্য দ্রাবিড়রা পিছু হটতে হটতে অববাহিকার পূর্বাংশে এসে পৌঁছায়। সেখানেই তাদের এক সন্তান, ‘বংগ’-এর সন্তান ও বংশধরেরা পৃথক জাতিসত্তারূপে আবির্ভূত হন, যাকে ‘বংগের আল’, সংক্ষেপে ‘বংগাল’ বলা হয়।

কালক্রমে ‘বংগাল’ ধীরে ধীরে ‘বাংগাল’ রূপ নেয়, এবং সেখান থেকে ‘বাংগলা’ বা ‘বাংলা’-তে রূপান্তরিত হয়। তখনো পূর্ব গাঙ্গেয় অববাহিকার বাকি অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় সেটাকেও ‘বংগ’, ‘বংগাল’ বা ‘বাংলা’ বলে অভিহিত করা হতো; কখনো কখনো ‘বাংলা দেশ’ বলা হতো। শুরুতে এর বিস্তৃতি আজকের ‘বিহার’ অন্তর্ভুক্ত করে এর পশ্চিম সীমান্ত থেকে শুরু করে পূর্ব দিকের আজকের ‘বাংলাদেশ’-সহ সমস্ত অঞ্চলজুড়ে ছিল।

যদি আর্যদের আগ্রাসনে মূলত ও প্রধানত ‘সেমিটিক’ অনার্য দ্রাবিড়, অর্থাৎ ‘বাংগালি’-রা মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যান, তবুও বারবার হিংস্র ও নৃশংস প্রতিপক্ষের গণহত্যার মুখে টিকে থাকতে না পারায় তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ফলে প্রাচীন বাংলা ধীরে ধীরে সংকীর্ণ হয়ে বর্তমান বাংলা ভাষাভাষী প্রধান অঞ্চলে সীমিত হয়। এরপর সেই সীমিত অঞ্চলে সুলতান হাজি শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহর নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো ‘বাংলা’ নামে একটি ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

কিন্তু প্রাচীন কালের বহিরাগত আর্যাবর্তীয় আর্য, সাগরপারের ব্রিটিশ আর্য এবং পরবর্তী সময়ে আগত অন্যান্য আর্য বহিরাগত—এছাড়া আর্যাবর্তের পশ্চিম অংশ, পাঞ্জাবের শ্যামায়িত আর্যদের সঙ্গে একত্র হয়ে মূলত ও প্রধানত ‘সেমিটিক’ দ্রাবিড় অনার্য বাংলা একসময় এই সব আর্যশক্তিকে পরাজিত করে ১৯৪৭ সালে তাদের হাত থেকে মুক্তি লাভ করে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে। তবে সেই সময়ের আমলা ও সামরিক স্বৈরশাসকচক্রসহ সবার বিভিন্ন বৈরী নীতির কারণে বাংলা তার স্বকীয় সত্তার স্বীকৃতি হারিয়ে বসে এবং নির্মম গণহত্যার শিকার হয়। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এটি বাংলার হাজার বছরের আবহমান মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পর্যায়ের রূপ হিসেবে সংঘটিত হয়। সেই যুদ্ধে জয়ী হয়ে বাংলা তার অধিকার পুনরুদ্ধার করলেও নানা কারণে তার অর্জিত স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি ক্ষয়িত হতে শুরু করলে হাজার বছরের মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় বাংলাকে বারবার জেগে উঠতে হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে।

এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধের সীমিত পরিসরে হাজার বছরের মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতার সর্বশেষ সশস্ত্র যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী চলমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে সবিস্তারে কিছু লেখার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে অন্যরা লিখছেন, আমিও আগে লিখেছি এবং ভবিষ্যতেও লিখব।

লেখক : অধ্যাপক ড. আহমদ আনিসুর রহমান বিশ্বের সর্বোচ্চ বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি থেকে রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব ও সংস্কৃতির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ওপর উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার ভিত্তিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এর আগে তিনি অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয় বলে পরিচিত এএনইউ থেকে বিপ্লবী যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সংকটসহ বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা সম্পন্ন করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পর তিনি বর্তমানে স্বরোপিত ঔষধি বৃক্ষবাগানের পরিচর্যা করে সময় কাটাচ্ছেন এবং কনিষ্ঠ পুত্র, স্ত্রীসহ মোটামুটি নির্লিপ্ত জীবন অতিবাহিত করছেন।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন