কোরআনের পরিভাষায় আমরা ‘কওম বাংলাদেশ’ বা ‘বাংলাদেশি কওম’

মোসলেহ ফারাদী
প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৬: ১৪
আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৭: ০৫

বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় দেশ। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান, তবে এর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসী সম্প্রদায়ও রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন ভাষাভাষী নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীও এখানে বসবাস করেন। এদেশের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে; বিশেষ করে ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা, দেশভাগের ক্ষত এবং মুক্তিযুদ্ধের বেদনা এই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু এরপর থেকে একটি বড় প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের বারবারই হতে হয়েছে, আর তা-হলো আমাদের সামষ্টিক পরিচয় কী? ঠিক কোন পরিচয়টি লালন করলে জাতি হিসেবে আমরা বিভক্ত হওয়ার চেয়ে বরং অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ হতে পারবো? দশকের পর দশক ধরে এই প্রশ্নের ভিন্ন ভিন্ন উত্তর এসেছে। কিছু অভিজাত শ্রেণি, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক দল পরিচয় নির্ধারণ করতে গিয়ে জোর দিয়েছেন ভাষাগত-জাতিগত পরিচয় ‘বাঙালি’র ওপর। অন্যরা চেষ্টা করেছেন জাতিগত পরিচয়কে হালকা করে নাগরিক বা ভূখণ্ডভিত্তিক পরিচয়কে সামনে নিয়ে আসতে। এই ধারার নেতৃত্ব দিয়েছেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যিনি ‘বাংলাদেশি’-পরিচয়কে ধারণ করার মাধ্যমে ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের মিশ্রণ ঘটাতে চেয়েছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে আবার একটি ধারা দেখা যাচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে বাঙালি-নৃতাত্ত্বিক প্রভাব কমিয়ে ইসলামীকরণের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বেশ কিছু টানাপোড়েন রয়ে গেছে। বিশেষ করে জাতিগত পরিচয় বনাম ধর্মীয় পরিচয়, অন্তর্ভুক্তি বনাম বর্জন, ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের মাঝে এখনো বেশ কিছু দ্বিধা ও অস্বস্তি বিদ্যমান রয়েছে। এই বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগে যে- কোন পরিচয়টি আমরা ব্যবহার করবো যা দেশের মুসলমান-অমুসলিম, আদিবাসী, সংখ্যালঘু-সব নাগরিককে ধারণ করবে, সাথে সাথে সংখ্যা গুরুর ন্যায্য অবস্থান নিশ্চিত করবে? আমার বিবেচনায় কুরআনিক শব্দ "কওম" এই সংকটের উত্তরণে একটি শক্তিশালী সমাধান দিতে পারে। কোনো একটি শব্দকে দিয়ে জাতীয় পরিচয় বোঝানোর ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, জাতীয় পরিচয় কেবল গৌরবের বিষয় নয়, এটি দায়িত্বেরও বিষয়। আল কোরআনে "কওম" শব্দটি প্রায়ই ন্যায়বিচার ও নৈতিকতার আহ্বানে ব্যবহৃত হয়েছে (যেমন, নবীগণ তাদের কওমকে ব্যবসায়িক লেনদেনে ন্যায়পরায়ণতা, সততা, দরিদ্রের প্রতি যত্নশীলতা ইত্যাদির জন্য আহ্বান জানিয়েছেন)। সুতরাং, আমরা যদি কওম বাংলাদেশ ধারণাটি জাতীয় পরিচয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারি তাহলে একদিকে তা যেমন নাগরিক অর্থ বহন করবে অন্যদিকে একটি জাতি হিসেবে আমাদের ন্যায়, সাম্য ও ঐক্য রক্ষা করতেও বেশ সহায়ক হবে।

বিজ্ঞাপন

কুরআনে “কওম” শব্দের অর্থ কী? কুরআনে "কওম" শব্দটি বহুবার এসেছে। একটি জনগোষ্ঠী, জাতি, সম্প্রদায় বা একই ধরনের বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে বোঝাতে কওম ব্যবহৃত হয়। নবীগণ তাদের জাতিকে সম্বোধন করতে এ শব্দ ব্যবহার করেছেন, যেমন-"ইয়া কওমি" ("হে আমার জাতি/জনগণ)"। এই সম্বোধন ঘনিষ্ঠতা, মালিকানা ও জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। এখানে বিবেচ্য যে, নবিগণ "ইয়া উম্মতি" বলেননি, কেননা তা বললে কেবলই ঈমানদারদেরকেই বোঝানো হতো। শুধু ঈমানদারদের বোঝাতে তারা "ইয়া উম্মতি" ব্যবহার করেছেন। আর মুসলিম-অমুসলিম সকলকে বোঝাতে "ইয়া কাওমি" ব্যবহার করেছেন। যদি বাংলাদেশিরা নিজেদের "বাংলাদেশি" হিসেবে দেখতে শুরু করে, তাহলে "আমরা এক জাতি, আমাদের সবার যৌথ দায়িত্ব আছে"-এই চেতনা গড়ে তুলতে সহজ হবে। কোরআনে নবিগণ কোন প্রেক্ষাপটে এবং কীভাবে তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়কে সম্বোধন করেছেন এর কিছু উদাহরণ নিম্নোক্ত আয়াতগুলোতে পাওয়া যাবে। যেমন:

"নূহ আ. তার জাতিকে বললেন, হে আমার কওম, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো ইলাহ নেই। আমি তোমাদের জন্যে একটি মহাদিবসের শাস্তির আশঙ্কা করি।" (৭:৫৯)। এই আয়াতে কওম বলতে ভৌগোলিক ও বংশ পরম্পরায় থাকা একটি জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়েছে। কেবল বিশ্বাসীদেরই বোঝানো হয়নি। কেননা, নূহ আ. এর এই কওমের মধ্যে অনেকেই ছিল যারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহর ওপর ঈমান আনেনি।

হুদ আ. তার কওমকে বলেছিলেন, "হে আমার কওম, আল্লাহর বন্দেগী কর, তিনি ভিন্ন তোমাদের কোন মাবুদ নেই, তোমরা সবাই মিথ্যা আরোপ করছ।" (১১:৫০)। এখানেও কওম বলতে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী সবাইকেই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ কওম শব্দটি একটি জাতীয় পরিচয়স্বত্ত্বা বোঝাতে ব্যবহৃত হতে পারে।

হজরত সালেহ আ. সামুদ জাতিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, "হে আমার কওম। আল্লাহর দাসত্ব কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো ইলাহ নাই। তিনিই জমিন থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, সেখানেই তোমাদেরকে বসতি দান করেছেন।" (১১:৬১)

যখন মূসা আ. বণী ইসরাইলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "হে আমার কওম, তোমাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্যে পয়গম্বর সৃষ্টি করেছেন, তোমাদেরকে রাজ্যাধিপতি করেছেন এবং তোমাদেরকে এমন জিনিস দিয়েছেন, যা বিশ্বজগতের কাউকে দেননি। (৫:২০) এখানেও কওম বলতে বংশ পরিক্রমায় একটি জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়েছে।

লূত আ. তার জাতিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, "হে আমার কওম, এ আমার কন্যারা রয়েছেন, এরা তোমাদের জন্য অধিক পবিত্রতমা। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং অতিথিদের ব্যাপারে আমাকে লজ্জিত করো না, তোমাদের মধ্যে কি কোনো ভাল মানুষ নেই।" (১১:৭৮) এখানে যে বিষয়টি বিশেষভাবে নজর দেয়া জরুরি তাহলো, কওম শব্দটির সাথে ঈমানের সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কওম মুসলিমও হতে পারে, অমুসলিমও হতে পারে। কওমের মূল ধারণার সাথে ঈমানকে জুড়ে দেয়া হয়নি। কওম বলতে এমন জনসম্প্রদায়কে বোঝায় যারা একসাথে দৈনন্দিন জীবনযাপন করে, পাশাপাশি থেকে বসবাস করে, যাদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে সামঞ্জস্য রয়েছে, যারা একই পরিবেশে থাকে এবং যাদের চাহিদা ও অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য রয়েছে। তাফসিরবিদরা উল্লেখ করেছেন যে অনেক প্রেক্ষাপটে "কওম" শব্দটি ব্যাপক অর্থ বহন করে। আবার কওম শব্দটি ধর্মীয় বা ভৌগোলিক একটি জনগোষ্ঠীকে ইঙ্গিত করেও হতে পারে। সংক্ষেপে বলা যায়, কুরআনিক পরিভাষায় "কওম" এমন এক শব্দ যা ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাস নির্বিশেষে একটি জাতিগোষ্ঠীকে সামগ্রিকভাবে বোঝানোর ক্ষেত্রে উপযুক্ত।

অন্যান্য শব্দ: উম্মাহ, মিল্লাত কি বিকল্প হতে পারে? এই শব্দগুলোও ভালো শব্দ তবে কওমই তুলনামূলক ভালো শব্দ। কেননা যখন আমরা উম্মাহ বলছি তখন এর মাধ্যমে মূলত ঈমানদারদের সম্প্রদায়কে বোঝানো হয়। উম্মাহ ধারণার মূল ভিত্তিই হলো ঈমান বা বিশ্বাস। আল কুরআনের সূরা আল-বাকারার ২১৩ নম্বর আয়াতে ব্যবহৃত "উম্মাহ" শব্দটি বিভিন্ন আলেম ও মুফাসসিরগণ তাদের ধর্মতাত্ত্বিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যদিও এই ব্যাখ্যাগুলোর মূলভিত্তি মানবজাতির ঐক্যবদ্ধ ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত, তবুও এর মাঝে পার্থক্য রয়েই গেছে। অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় ধর্মীয়, নৈতিক কিংবা ভৌগোলিক সত্তা হিসেবে গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে উম্মাহ শব্দটিকে বাড়তি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মূলত কুরআনিক "উম্মাহ" ধারণাটি এমন এক রূপান্তরমূলক সমাজব্যবস্থার দৃষ্টান্ত, যা প্রচলিত সামাজিক-রাজনৈতিক ও জাতিগত সীমানাকে অতিক্রম করে। আখতার (২০২৫) এই ধারণাটিকে বিশদভাবে পর্যালোচনা করেছেন এবং ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, এটি সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে-যেখানে বংশ, জাতি বা গোত্র নয়; বরং অভিন্ন বিশ্বাস, নৈতিক আচরণ এবং ন্যায়ের প্রতি অঙ্গীকারই উম্মাহ হয়ে ওঠার প্রধান ভিত্তি। একাধিক বই বিশ্লেষণ এবং নববী মডেলের আলোচনার মাধ্যমে আখতার যুক্তি দিয়েছেন যে, ইসলাম এক এমন সর্বজনীন মানবসমাজের কল্পনা করে যা করুণা, সাম্য ও সংহতির ওপর প্রতিষ্ঠিত-এবং এই আদর্শ আজকের বৈষম্য ও বৈশ্বিক অবিচারের মতো সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সাথে গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক। আবার যখন আমরা মিল্লাত বলি এর মধ্য দিয়েও একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় বা মতবাদকে বোঝায়। যেমন কুরআনে "মিল্লাত-ই ইবরাহীম" শব্দটি দিয়ে ইবরাহীম (আ.)-এর ধর্মদর্শনের কথা বলা হয়েছে। এর বাইরে শায়ব, কাবিলা প্রভৃতি শব্দ জাতিগত বা গোত্রভিত্তিক পরিচয় নির্দেশ করে, তবে এগুলোর পরিসর অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ, কারণ এগুলো সাধারণত বংশানুক্রমিক পরিচয় বহন করে। অতএব, ধর্মীয় পরিচয়ের আলোচনায় উম্মাহ ও মিল্লাত যথাযথ; কিন্তু একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় পরিচয়ের জন্য এগুলো যথাযথ নয়।

অন্তর্ভুক্তিমূলক শব্দের প্রয়োজনীয়তা যেমনটা আমরা লেখার শুরুতেই বলেছি যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ জাতির জন্য জাতীয় পরিচয় নির্ধারণের বেশ কয়েকটি প্রয়াস নেয়া হয়েছে। যেমন: বাঙালি জাতীয়তাবাদ: মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসভিত্তিক এ পরিচয় ব্যবহৃত হয়। তবে অনেকের কাছেই এই পরিচয়টি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অমোঘ সাদৃশ্য তৈরি করে। ফলশ্রুতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ও অ-বাঙালি আদিবাসীরা বাঙ্গালি পরিচয় দেয়ার মাঝে খুব বেশি স্বস্তি পাননি। তাদের কাছে মনে হয়েছে যে, এই পরিচয়টি নিজেদের পরিচয় ও স্বতন্ত্র অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক নয়। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ: প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর প্রচলন করেন। এটি কেবল জাতিগত পরিচয় নয়, বরং ভূখণ্ডভিত্তিক পরিচয় দেয়ার প্রয়াস যার উদ্দেশ্য ছিল দেশের প্রতিটি নাগরিককে একটি সাধারণ পরিচয়সত্ত্বার আওতায় নিয়ে আসা। কিন্তু এই পরিচয়টিও পরবর্তীতে নানাবিধ কারণে বিতর্কিত হয়েছে। যারা বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের সমর্থক তারা এই পরিচয়টি মেনে নিতে পারেননি। আবার যারা নিয়মিত ধর্ম অনুশীলন করেন তারাও এই পরিচয়ের মাঝে ধর্মের সাথে কোনো যোগাযোগের সূত্র আবিষ্কার করতে পারেননি। এখানে স্পষ্ট করেই বলা প্রয়োজন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল বা উত্তরাঞ্চলের সমতলভূমির আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রায়ই নিজেদের "বাঙালি" পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে, আর "বাংলাদেশি" পরিচয়ের ক্ষেত্রে তারা মনে করে এটি যেন তাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্বাস ও বহুত্ববাদ: সাম্প্রতিক সময়ে কিছু চিন্তক ও কর্মী এমন একটি জাতীয় পরিচয় গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন, যার ভিত্তি ঈমান হলেও অত্যন্ত স্বার্থকভাবে প্রতিটি নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করবে। তবে তারা এখনো পর্যন্ত এমন কোনো পরিচিতির উদ্ভব ঘটাতে পারেননি যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থেই এমন একটি পরিচয়ের সন্ধান করছে, যা- ১. ধর্ম বর্ণ বা জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে সব নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করে। ২. নৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কেও ধারণ করে। ৩. সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘু উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, এবং ৪. যৌথ আকাঙ্ক্ষা ও সাধারণ অন্তর্ভুক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।

‘কওম বাংলাদেশের’ বা ‘বাংলাদেশী কওম’ ধারণাটি কেন বাংলাদেশের জন্য যথার্থ? এক্ষেত্রে বেশ কিছু কারণের কথা উল্লেখ করা যায়। যথা: ১. অন্তর্ভুক্তিমূলক: কওম নির্দিষ্টভাবে কোনো ধর্মীয় পরিচয়কে ধারণ করে না। মুসলিম-অমুসলিম উভয়েই কওমের আওতায় চলে আসতে পারে। এখানে স্পষ্ট করে বলা দরকার যে, যখন "বাঙালি" বা "বাংলাদেশি" পরিচয়কে সংকীর্ণভাবে উপস্থাপন করা হয়, তখন বাঙালি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিজেদের প্রান্তিক মনে করতে পারে। কিন্তু "কওম" একটি তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ শব্দ। কারণ কুরআনের দৃষ্টিতে "কওম" শব্দটি ধর্মনিরপেক্ষ-একটি কওমের সদস্য মুমিনও হতে পারে, অবিশ্বাসীও হতে পারে। তাই সংখ্যালঘুরাও "কওম বাংলাদেশ"-এর অংশ হিসেবে নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যে মেনে নিতে পারে। ২. সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক মিল: ঔপনিবেশিক ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, পরিবেশ ও দৈনন্দিন জীবনের মতো বিষয়গুলোকে কওমের আওতায় সমান গুরুত্বের সাথে ধারণ করা যায়। ৩. নৈতিকতা: নবীগণ তাদের জাতিকে কওম বলে ডাকতেন, সত্য ও ন্যায়ের আহ্বান জানাতেন। তাই এই পরিচয়টি নিছক বর্ণনামূলক নয়, বরং কর্মের আহ্বানও বহন করে। ৪. ধর্মীয় পরিচয়ের ভারসাম্য: মুসলিমরা চাইলে উম্মাহ বা মিল্লাত ব্যবহার করতে পারেন, তবে পাশাপাশি "বাংলাদেশি কওম" পরিচয়টিও সাদরে বরণ করে নেয়া সম্ভব। ৫. স্বাভাবিক উপযোগিতা: ইসলামি পরিভাষায় কওম বহুল ব্যবহৃত ও পরিচিত। তাই এটি গ্রহণ করা মুসলিমদের কাছে স্বাভাবিক মনে হবে, অন্যদিকে অমুসলিমরাও এতে অস্বস্তিবোধ করবে না। ৬. রাজনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা: এই পরিচয়টি সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্ত করে, বিভাজন কমায়, এবং বহুত্ববাদকে সমর্থন করে। দক্ষিণ এশিয়ায় "কওম" বা "কওমিয়াত" শব্দটি পাকিস্তান ও ভারতে সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই ধারণাটিকে নতুনভাবে ইতিবাচক অর্থে উপস্থাপন করতে পারে-ধর্মীয় বিভাজনের প্রতীক হিসেবে নয়, বরং অন্তর্ভুক্তিমূলক নাগরিক জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে। এইভাবে "কওম বাংলাদেশ" ধারণা বাংলাদেশকে ভারতের ক্রমবর্ধমান হিন্দুত্বকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ থেকে আলাদা করবে এবং দেশটিকে একদিকে ইসলামি, অন্যদিকে বহুত্ববাদী ও সহনশীল জাতি হিসেবে উপস্থাপন করবে।

সম্ভাব্য আপত্তি ও জবাব

"কওম" কি কেবল ইসলামি শব্দ? এই পরিচয় ধারণ করলে অমুসলিমরা স্বাভাবিকভাবেই কি বাদ পড়বে না? উত্তর: না। কুরআনে কওম বহুবার নিরপেক্ষভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হলো জাতীয় পরিসরে এই পরিচয়টিকে অন্তর্ভুক্তিমূলকভাবে সংজ্ঞায়িত করা।

"এটি কি কেবল নতুন নাম দেওয়া? এতে কী আহামরি কোনো পরিবর্তন হবে?" উত্তর: পরিচয়সত্ত্বা খুবই প্রভাব বিস্তার করে। নাগরিকরা নিজেদের যেভাবে দেখে, তাদের নীতি, অধিকার, সামাজিক আচরণে তেমনটাই প্রতিফলিত হয়।

"বিদ্যমান পরিচয়গুলোর (বাঙালি, বাংলাদেশি, ধর্মীয়) সাথে কওম পরিচয়টি কি নতুন করে কোনো সংঘাত তৈরি করবে?" উত্তর: অবশ্যই নয়। পরিচয় একাধিক হতে পারে। কেউ একইসঙ্গে সংস্কৃতিতে বাঙালি, ধর্মে মুসলিম এবং নাগরিক পরিচয়ে বাংলাদেশি কওম হতেই পারে।

কওম শব্দটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অপরিচিত? উত্তর: আরবি-ফারসি-উর্দু সূত্রে গৃহীত "কওম" শব্দটি বাংলা সাহিত্য, সুফিবাদ ও রাজনীতিতে "সম্প্রদায়" বা "জনগণ" অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ঊনবিংশ শতকের সংস্কারক নবাব আবদুল লতিফ ও স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রায়ই "ভারতের মুসলিম কওম"-এর কথা উল্লেখ করতেন। অর্থাৎ, এই শব্দটি উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শব্দভাণ্ডারের অংশ-এটি কোনো বিদেশি বা অপরিচিত ধারণা নয়। সুতরাং "কওম বাংলাদেশ" একসাথে ইসলামি ঐতিহ্য ও বাঙালিত্বের ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন ঘটায়।

"কওম বাংলাদেশ" পরিচয় বাস্তবায়নের উপায়

১. রাজনৈতিক বক্তব্যে বহুল ব্যবহার: জাতীয় ভাষণ, নীতি দলিল, সংবিধান ও শিক্ষা পাঠ্যক্রমে "বাংলাদেশি কওম" বা "কওম বাংলাদেশ" শব্দটির ব্যবহার প্রবর্তন করা। উদাহরণস্বরূপ, স্কুলের পাঠ্যবই, গণমাধ্যম এবং সরকারি ঘোষণা-নির্দেশনাগুলোতে জনগণ বা জাতিকে বোঝাতে এই পরিভাষাটি ব্যবহার করা যেতে পারে।

২. প্রতীকে ও আচারাদিতে ব্যবহার: যে সব জাতীয় অনুষ্ঠান, যেমন স্বাধীনতা দিবস, ভাষা দিবস, নাগরিক সমাবেশ বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি ও পটভূমির মানুষ একত্রিত হয়-সেগুলোর মাধ্যমে অভিন্ন জাতিসত্তার চেতনা জোরদার করা যেতে পারে।

৩. শিক্ষাখাতে: বিদ্যালয়ে "কওম" ধারণা শেখানো। বিশেষত এর কুরআনিক ব্যবহার, অন্তর্ভুক্তি ও বহুত্ববাদের তাৎপর্য তুলে ধরা। নিশ্চিত করতে হবে যাতে অমুসলিম সম্প্রদায়ও এই ধারণার মধ্যে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

৪. আইন ও নীতিগত পদক্ষেপ: কোনো একক পরিচয়কে প্রাধান্য না দিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভাষা, সংস্কৃতি ও নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারী নীতিমালায় জাতিগত, ধর্মীয় ও শ্রেণিগত বিভাজন দূর করার প্রয়াস থাকতে হবে।

৫. গণমাধ্যম ও সংস্কৃতি: সাহিত্য, সংগীত ও গণমাধ্যমে "কওম বাংলাদেশ" বা "বাংলাদেশি কওম" ধারণা তুলে ধরা-যেখানে বহুমাত্রিক কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সংখ্যালঘুদের অবদান, আন্তঃধর্মীয় সহযোগিতা ও সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত বেশি বেশি প্রচার করতে হবে।

উপসংহার, পরিচয়সত্ত্বা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এ মুহূর্তে ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে মর্যাদা দিয়ে, সংখ্যালঘুদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে, এমন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিচয় প্রয়োজন যার সীমানা থেকে কোনো সম্প্রদায়ই বাদ পড়বে না। কুরআনিক শব্দ "কওম" এক্ষেত্রে একটি উত্তম সমাধান হতে পারে। "বাংলাদেশি কওম" বা "কওম বাংলাদেশ" হতে পারে এমন একটি যৌথ পরিচয়, যা সবাইকে একত্রিত করে ন্যায়, মর্যাদা ও অভিন্ন ভবিষ্যতের পতাকাতলে নিয়ে আসতে সক্ষম। যদি বাংলাদেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এই শব্দটি বেছে নিতে পারে, তাহলে কওম একটি পরিচয় হয়ে উঠবে না বরং একইসাথে নাগরিকত্বের মান, সমাজের ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতিকেও ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে।

লেখক: লন্ডনে বসবাসরত একজন কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট, শিক্ষাবিদ ও প্যারেন্টিং কনসালট্যান্ট

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত